ডাউন সিনড্রোম

ডাউন সিনড্রোম ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা

ডা. অজন্তা রানী সাহা

ছবি : সংগৃহীত

ডাউন সিনড্রোম নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই জানা দরকার ডাউন সিনড্রোম কী? কেন হয়, এর প্রতিকারই বা কী? ডাউন সিনড্রোম একধরনের ক্রোমোজোমাল সমস্যা। এ সমস্যায় আক্রান্ত শিশু বা ব্যক্তিরা স্নায়ু বিকাশজনিত প্রতিবন্ধী হিসেবে পরিচিত। সাধারণত একটি শিশু বাবার কাছ থেকে ২৩টি ও মায়ের কাছ থেকে ২৩টি ক্রোমোজম নিয়ে মাতৃগর্ভে ভ্রূণ আকারে জন্মলাভ করে। ফলে ২৩ জোড়া বা ৪৬টি ক্রোমোজম থাকে। কিন্তু ডাউন সিনড্রোমের বেলায় ৪৬টির জায়গায় ৪৭টি ক্রোমোজোম দিয়ে মাতৃগর্ভে ভ্রূণ তৈরি হয়। এ অতিরিক্ত ক্রোমোজমই শিশুটির সব অসুস্থতা ও প্রতিবন্ধিতার কারণ। প্রশ্ন হলো এ অতিরিক্ত ক্রোমোজমের অবস্থান কোথায়? কোথা থেকেই বা এর উৎপত্তি? কারণই বা কী? এর উত্তর এখন পর্যন্ত সঠিকভাবে জানা যায়নি। পরম করুণাময় স্রষ্টাই জানেন। তবে অতিরিক্ত ক্রোমোজম ২১তম অবস্থানে থাকে। তাই একে ট্রাইসমি ২১ (Trisome ) বলা হয়। 

যেহেতু ২১তম পজিশনে দুটির পরিবর্তে তিনটি ক্রোমোজম থাকে তাই বছরের তৃতীয় মাস মার্চে বিশ্ব ডাউন সিনড্রোম দিবস হিসেবে বিশ্বব্যাপী দিবস পালন করা হয়। বাংলাদেশে ২০১৪ সাল থেকে জাতীয় অধ্যাপক এমআর খানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে একটি অ্যাসোসিয়েশন করে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে দিবসটি পালন শুরু করি। তৎকালীন সচিব নাসিমা বেগম নিজে উপস্থিত থেকে এ দিবস পালনে একাত্মতা ঘোষণা করেন। পরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ২০১৭ সাল থেকে সরকারি উদ্যোগে দিবসটি প্রতি বছর পালন করে আসছে। এটি আমার স্বপ্ন ছিল। তাই আমি নিজে আত্মতৃপ্তি পাই যখন দেখি আমার স্বপ্নের বাস্তবায়ন হচ্ছে। এবারো সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন এনডিডি ট্রাস্ট দিবসটি পালন করে। সরকারের পাশাপাশি প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করে এ ধরনের সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন পারমিতা, ডাউন সিনড্রোম সোসাইটি, সুইড বাংলাদেশ, প্রয়াস ইত্যাদি এ দিবস পালনে একাত্মতা ঘোষণা করে। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘‌চিরাচরিত ধারণার শেষ, প্রবেশগম্যতায় স্মার্ট বাংলাদেশ’। 

ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তি বা পরিবারকে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে এবং ২১ মার্চের গুরুত্বকে মর্যাদা দেয়ার লক্ষ্যে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ২১ জন দক্ষ ও যোগ্য ডাউন সিনড্রোম শিশুকে উপবৃত্তি দেয়। তাছাড়া ডাউন সিনড্রোম শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করে তাদের মাঝে পুরস্কার প্রদান করে।

১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে একজন ব্রিটিশ চিকিৎসাবিজ্ঞানী জন ল্যাঙ্গডন ডাউন এ ডাউন সিনড্রোম বিষয়টি উপস্থাপন করেন। তিনি তার প্র্যাকটিসের সময় দেখতে পান কিছু রোগী তার কাছে একই ধরনের গঠন ও সমস্যা নিয়ে আসে। তাদের নিয়ে গবেষণা করে তিনি তাদের ক্রোমোজমাল সমস্যা, অসুস্থতা ও গঠন এনং বিকাশসংক্রান্ত বিষয়গুলো বর্ণনা করেন। তাই এ বিজ্ঞানীর নামানুসারে এদের ডাউন সিনড্রোম বলা হয়।

ডাউন সিনড্রোম চেনার উপায়

একটি শিশু ডাউন সিনড্রোম কিনা তা নির্ণয়ের তিনটি পর্যায় রয়েছে। প্রথমত, মাতৃগর্ভের শিশুটি ডাউন সিনড্রোম কিনা তা নির্ধারণ করা সম্ভব। 

  মায়ের শরীর থেকে রক্ত নিয়ে বিশেষ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে।

  আল্ট্রাসনোগ্রাম করে—বিশেষ কিছু ফাইন্ডিংস দেখে চিকিৎসকরা বলতে পারেন শিশুটি ডাউন সিনড্রোম হতে পারে। তবে সাধারণ আল্ট্রাসনোগ্রাম করে সম্ভব না। বিশেষজ্ঞ সনোলজিস্ট তা শনাক্ত করতে পারেন।

  মায়ের গর্ভফুল বা গর্ভের পানি সংগ্রহ করে বিশেষ পরীক্ষার মাধ্যমে সঠিকভাবে শিশুটি ডাউন সিনড্রোম কিনা তা শনাক্ত করতে পারেন। 

বাংলাদেশে এ রোগ নির্ধারণ করান সম্ভব। তবে সুযোগ সীমিত। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিটোম্যাটারনাল বিভাগে এর কিছু সুবিধা রয়েছে। আর যেহেতু বিশেষজ্ঞ সনোলজিস্ট, বিশেষজ্ঞ প্রসূতিবিদের সংখ্যা সীমিত, তাই এ সংখ্যা না বাড়া পর্যন্ত এর সুবিধা সব প্রত্যাশী মানুষের নাগালের বাইরেই থাকবে।  

দ্বিতীয়ত, শারীরিক গঠন দেখে ডাউন সিনড্রোম শিশুদের শনাক্ত করা—

ক) জন্মের সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারা—

নবজাতক শিশু জন্মের সঙ্গে সঙ্গে নবজাতক বিশেষজ্ঞের সেবা পাওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের দেশে সব ক্ষেত্রে তা সম্ভব না। তাই সেবা দেন সেবিকা। কাজেই প্রসূতি বিশেষজ্ঞ যত্নসহকারে দেখলেই বুঝতে পারবেন শিশুটি ডাউন সিনড্রোম কিনা। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো হলো—


 মাথা তুলনামূলক ছোট

 চোখ আড়াআড়ি

 কান ছোট, নাক চ্যাপ্টা

 তুলনামূলক বেশি নরম 

 হাতে একটি আড়াআড়ি দাগ

 পায়ে স্যান্ডেল গ্যাপ ইত্যাদি


খ) শিশুটি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে—

 অন্যান্য শিশুর থেকে তুলনামূলক খর্বাকৃতির

 মুখমণ্ডল বিশেষ জাতিগোষ্ঠীর মতো—নাক চ্যাপ্টা, চোখ আড়াআড়ি, কান ছোট ও অবস্থান নিচে, মুখ হাঁ করান, জিহ্বা  বের হয়ে থাকা

 ঘাড় ছোট

 হাতে সিমিয়ান ক্রিজ

 পায়ে স্যান্ডেল গ্যাপ

তৃতীয়ত, জেনেটিক স্টাডি (karyotyping) করে সঠিকভাবে নিশ্চিত করা যায়।

ডাউন সিনড্রোমকে দ্রুত শনাক্তকরণ আবশ্যক

ডাউন সিনড্রোম জন্মগত অনেকগুলো মেডিকেল সমস্যা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তাদের দ্রুত শনাক্ত করা গেলে চিকিৎসার মাধ্যমে এসব সমস্যা দূরীকরণের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়ে বুদ্ধিমত্তা বাড়ানোসহ পড়াশোনা শিখিয়ে মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করে স্বাবলম্বী করা সম্ভব। তা না হলে তারা পরিবারের, সমাজের ও দেশের বোঝায় পরিণত হয়ে পড়বে। আসুন জন্মের সঙ্গে সঙ্গে ডাউন সিনড্রোমকে চিনে নিই এবং প্রতিবন্ধকতা উত্তরণে অবদান রাখি। 

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, শিশু বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং স্নায়ুবিকাশ প্রতিবন্ধিতা ও ডাউন সিনড্রোম বিশেষজ্ঞ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন