ব্লাড ক্যান্সার

শুরুতে শনাক্ত হওয়া ও সঠিক চিকিৎসায় ক্যান্সার নিরাময় সম্ভব

ডা. এ যুবায়ের খান

ছবি : সংগৃহীত

মানবদেহের রক্তের কণিকাগুলোর অনিয়ন্ত্রিত ও অকার্যকর বৃদ্ধির ফলে রক্তের যে অবস্থার সৃষ্টি হয় তাকেই বলে রক্তের ক্যান্সার। দেহের অন্যান্য অংশের ক্যান্সারের মতো ব্লাড ক্যান্সার হলেও এর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। রক্ত যেহেতু দেহের সর্বত্রই প্রবাহিত তাই রক্তের ক্যান্সার শুরুতেই দেহের সবখানে ছড়িয়ে পড়ে। শুরু থেকেই দেহের প্রতিটি অংশই রক্তের ক্যান্সারের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

আমাদের দেশে রক্তের ক্যান্সারের সঠিক কোনো তথ্য খুব একটা পাওয়া যায় না। সীমিত তথ্যে দেখা যায়, সব ধরনের ক্যান্সারের মধ্যে রক্তের ক্যান্সার ১৫ শতাংশ। বিভিন্ন রকমের ব্লাড ক্যান্সার আমরা দেখতে পাই। বড়দের এবং ছোটদের ক্ষেত্রে এর কিছুটা পার্থক্য হয়, ছোটদের সবচেয়ে কমন ব্লাড ক্যান্সার হচ্ছে এ.এল.এল., এরপরে এ.এম.এল., এবং লিম্ফোমা। বড়দের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় সি.এল.এল. ও সি.এম.এল.। এরপরে এ.এম.এল. এ.এল.এল. এবং লিম্ফোমা ও মাল্টিপল মায়োলমা। একেক ক্যান্সারের লক্ষণ একেক রকম। মোটা দাগে অ্যাকিউট ব্লাড ক্যান্সারগুলো শুরুতেই খুব মারাত্মক লক্ষণ দিয়ে প্রকাশ পায়, যেমন শরীরের বিভিন্ন অংশে চামড়ায় রক্তের ছোট ফুসকুড়ি থেকে চাকা চাকা জমাট বাঁধা রক্ত, দাঁতের মাঢ়ি বা নাক দিয়ে, কখনো কখনো প্রস্রাব বা পায়খানার রাস্তা দিয়ে তাজা রক্তক্ষরণ, প্রচণ্ড জ্বর, রক্তাল্পতার কারণে মাথা ঘোরা, অতিরিক্ত অবসাদ বা বিভিন্ন ইনফেকশনের লক্ষণ। অন্যদিকে ক্রনিক ব্লাড ক্যান্সারগুলো অনেক বছর ধরে অল্প অল্প মাত্রায় অগ্রসর হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগীরা বুঝতে পারে না। একদম অ্যাডভান্স স্টেজে এ রোগগুলো নিয়ে রোগীরা ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়। যারা নিয়মিত হেলথ চেকআপ করে তারা শুধু শুরুতেই এ রোগগুলো ধরতে পারে।

রক্তের ক্যান্সার নির্ণয়ের পরীক্ষা

রক্তের ক্যান্সার আছে কিনা এ ব্যাপারে প্রাথমিক ধারণা পাওয়ার জন্য খুব কম খরচের একটি সিবিসি বা কমপ্লিট ব্লাড কাউন্টই যথেষ্ট, যেটি কিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোয় সবচেয়ে কমন একটি টেস্ট। সবচেয়ে ভালো হয়, ভালো ডায়াগনস্টিক সেন্টার যেখানে ভালো সি.বি.সি. করার সেল কাউন্টার মেশিন আছে এবং আরো বেশি ভালো হওয়ায় যদি সেই রিপোর্টটি একজন রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ বা হেমাটোলজিস্ট কর্তৃক ভেরিফায়েড হয়। সি.বি.সি.তে সমস্যা থাকলে সঙ্গে সঙ্গে পেরিফেরাল ব্লাড ফিল্ম বা পি.বি.এফ. করে আরো ভালো ধারণা পাওয়া যায় যা কিনা রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ বা হেমাটোলজিস্টরাই সবচেয়ে ভালো দেখে থাকেন। প্রতি বছর একটি ভালো জায়গা থেকে সিবিসি ও পিবিএফ করার মাধ্যমেই রক্তের ক্যান্সারের রুটিন স্ক্রিনিং করা যেতে পারে। এরপর রক্তের ক্যান্সার প্রাথমিকভাবে ধরা পড়লে একেক ক্যান্সার নিশ্চিত করার জন্য একেক রকমের পরীক্ষার প্রয়োজন হয়। যেমন অ্যাকিউট লিউকেমিয়া শনাক্ত করার জন্য ফ্লো সাইটোমেট্রি একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। শুধু ঢাকার কয়েকটি সেন্টার ছাড়া আর কোথাও এ পরীক্ষা হয় না। এছাড়া বোনম্যারো স্টাডি, বোন ম্যারো বায়োপসি বা ট্রিফাইন স্টাডি, রক্তের বিভিন্ন বায়োকেমিক্যাল পরীক্ষা, সর্বোপরি রক্তের সব ধরনের ক্যান্সার সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়ার জন্য সাইটোজেনেটিক ও কেরিওটাইপিং খুবই প্রয়োজনীয় টেস্ট। আমাদের দেশে শেষোক্ত এ দুটি পরীক্ষার ব্যাপারে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্যাম্পলগুলো বিদেশে পাঠানো হয়। তবে কিছু কিছু জায়গায় এ পরীক্ষাগুলো এখন শুরু হয়েছে। বিশেষ করে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন আগারগাঁওয়ে উন্নত পরীক্ষা পদ্ধতি কিছু কিছু চালু হয়েছে এবং শিগগিরই বাকি পরীক্ষাগুলোও চালু হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নেক্সট জেনারেশন সিকোয়েন্সিং যা কিনা সারা বিশ্বের ক্যান্সার ধরার ক্ষেত্রে সবচেয়ে উত্তম ও কার্যকর পরীক্ষা। এছাড়া রক্তের লিম্ফোমা ক্যান্সার সুনিশ্চিত করার জন্য ভালো বায়োপসি ও ইমিউনোহিস্টোকেমিস্ট্রি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে অনেক জায়গায়ই ইমিউন কেমিস্ট্রি হয় কিন্তু তা খুবই ব্যয়বহুল এবং অনেক ক্ষেত্রেই রিপোর্টিংয়ের মান ভালো হয় না। অনেক সময় শরীরের বাইরের দিকে কোনো লিম্ফনোড পাওয়া না গেলে শরীরের ভেতরের লিম্ফনোড বা সন্দেহজনক টিস্যু থেকে কোর নিডেল বায়োপসি করতে হয় যে ব্যাপারে পারদর্শী বিশেষজ্ঞের এ দেশে যথেষ্ট অভাব রয়েছে।  

যেহেতু রক্তের ক্যান্সারও অনেক রকম হয়। একেক রক্তের ক্যান্সারের চিকিৎসা একেক রকম এবং যেহেতু বেশির ভাগ রক্তের ক্যান্সারই প্রাণঘাতী তাই সঠিকভাবে ক্যান্সার শনাক্তকরণ এবং তার স্বরূপ চিহ্নিতকরণসহ শরীরের কতটুকু ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেছে সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে না পারলে ক্যান্সারের চিকিৎসা করে কোনো ফায়দা হয় না উপরন্তু অর্থের অপচয় হয়। এ কারণে রক্তের ক্যান্সার শনাক্তকরণ করার পর তার সুনিশ্চিতকরণ এবং সঠিক গাইডলাইন অনুযায়ী উন্নত বিশ্বে যে ধরনের চিকিৎসা ব্যবহার করা হয় তা নিশ্চিত করার মাধ্যমেই রক্তের ক্যান্সার থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব। একটি বিষয় আমাদের সবার খেয়াল রাখতে হবে যে প্রায় সব ধরনের ক্যান্সারই নিরাময় করা সম্ভব যদি তা তাড়াতাড়ি শনাক্ত করা যায় এবং সঠিক মাত্রার চিকিৎসা প্রয়োগ করা সম্ভব হয়, কিন্তু আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগীদের অসচেতনতা, বিশেষজ্ঞের অভাব, মানসম্পন্ন পরীক্ষার অপ্রতুলতার কারণে রোগের যথাযথ নির্ণয়ে অনেক সময়ক্ষেপণ হয় উপরন্তু আমাদের দেশে চিকিৎসকদের মধ্যে রেফারেল প্র্যাকটিস কম থাকার কারণেও রোগী অনেক হেনস্থা হয়।

চিকিৎসা 

আমরা আগেই বলেছি, একেক রক্তের ক্যান্সারের চিকিৎসা একেক রকম। যে ক্যান্সারের চিকিৎসা যে রকম সর্বজনগ্রাহ্য গাইডলাইন অনুযায়ী সেই চিকিৎসা না দিতে পারলে ওই ক্যান্সার ভালো হওয়া সম্ভব না। ক্যান্সারের চিকিৎসা এমনিতেই ব্যয়বহুল। আমাদের দেশে উপরন্তু চিকিৎসার খরচ রোগীকে নিজেরই বহন করতে হয়। এ দেশে হেলথ ইন্স্যুরেন্সের সুবিধা বা প্র্যাকটিস নেই বললেই চলে। সেহেতু রোগীরা যদি চিকিৎসা খরচ শেষ পর্যন্ত বহন করতে না পারে তাহলে অর্থের অভাবে চিকিৎসার মাঝখানে বন্ধ করার চেয়ে স্ট্যান্ডার্ড খরচের চিকিৎসা শুরু না করাই ভালো। এ ধরনের রোগীদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে পরামর্শ সাপেক্ষে পেরিয়েটিভ বা ঠেকা কাজ চালানোর মতো চিকিৎসা করা হয় যাতে সে কম কষ্টে, কম খরচে ধীরে ধীরে মৃত্যুবরণ করতে পারে। শুনতে খারাপ লাগলেও এটিই বাস্তবতা। বেঁচে থাকতে কে না চায়। কিন্তু খরচের চিকিৎসা শুরু করে ঘরবাড়ি, ভিটে বিক্রি করে, সুদে ধারকর্য করে, চিকিৎসা শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ না করার কারণে রোগী মৃত্যুবরণ করলে আর এতে যদি তার পরিবার-পরিজন, ছেলেমেয়ে তার মৃত্যুর পরে পথের ফকির হয়ে যায় তাহলে কার লাভ? সেহেতু চিকিৎসার শুরুতে চিকিৎসকদের এ বাস্তবতাগুলো অবশ্যই মাথায় রাখতে হয়।

ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসা মূলত কেমোথেরাপি, এছাড়া বিভিন্ন রকমের ইমিউনোথেরাপি রয়েছে। ইমিউনোথেরাপি বা বায়োলজিকস ওষুধগুলোর খরচ অনেক বেশি। যদিও বেশির ভাগ ওষুধই আমাদের দেশে তৈরি হয় এবং এদের মান যথেষ্ট ভালো। এছাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে রক্তের ক্যান্সার থেকে সম্পূর্ণ ভালো হওয়ার জন্য বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন প্রতিস্থাপনে প্রয়োজন হয় এটি খুবই ব্যয়বহুল। একটি চিকিৎসা আমাদের দেশে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রক্ত রোগ বিভাগ ও ঢাকা সিএমএইচসহ কয়েকটি প্রাইভেট সেন্টারে বেশ ভালোভাবেই শুরু হয়েছে। এর মধ্যে এভারকেয়ার হসপিটাল, আজগর আলী হসপিটাল, ইউনাইটেড হসপিটাল উল্লেখযোগ্য।

পরামর্শের ঠিকানা

পৃথিবীতেই রক্ত রোগ বিশেষজ্ঞ বা হেমাটোলজিস্টরাই রক্তের ক্যান্সারের চিকিৎসা করার ক্ষেত্রে অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করেন। তবে লিম্ফোমাজাতীয় ক্যান্সার রক্ত রোগ বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ বা অনকোলজিস্টরাও চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। বোনম্যারো  ট্রান্সপ্লান্টেশন একটি টিমওয়ার্ক। এতে হেমাটোলজিস্টের পাশাপাশি ব্লাড ট্রান্সফিউশন স্পেশালিস্ট, ইন্টারনাল মেডিসিন স্পেশালিস্ট, ক্রিটিক্যাল কেয়ার স্পেশালিস্টসহ একটি বড় টিমের প্রয়োজন হয়। এ কারণে এর খরচ আকাশছোঁয়া।

ক্যান্সার একটি জীবনঘাতী রোগ হলেও সূচনাতেই রোগটি ধরা পড়লে এবং সঠিক চিকিৎসা করা গেলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ক্যান্সার সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। আমাদের দেশের যদিও সঠিক তথ্য নেই, কিন্তু অন্যান্য ক্যান্সারের মতো রক্তের ক্যান্সারও দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে বলে আমাদের ধারণা। অনেক ক্যান্সারের সঙ্গে পারিবারিক বা বংশগতির যোগসূত্র থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ ক্যান্সার কেন হচ্ছে তা আমরা জানি না। এ ব্যাপারে আমাদের দেশে কোনো গবেষণা নেই। তবে পরিবেশ দূষণ ও খাদ্যের যথেষ্ট ভেজাল একটি বড় কারণ হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের দৃঢ় সন্দেহ রয়েছে। তাই নিরাপদ ও পরিমিত খাদ্যাভ্যাস, স্বাস্থ্যসচেতনতা, নিয়মিত ক্যান্সার স্ক্রিনিংই হতে পারে এ রোগ থেকে বেঁচে থাকার উপায়।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, হেমাটোলজি বিভাগ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টার (এনআইএলএমআরসি), ব্লাড ক্যান্সার ও থেলাসিমিয়া বিশেষজ্ঞ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন