বন্যা পরিস্থিতি

কুড়িগ্রাম গাইবান্ধা রংপুরে অবনতি, সিলেটে উন্নতি

আরো বাড়তে পারে তিস্তা ও ধরলার পানি

বণিক বার্তা ডেস্ক

ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। পানি বেড়েছে রংপুর ও গাইবান্ধার বিভিন্ন অঞ্চলেও। যমুনা নদীর পানি বাড়ায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে সিরাজগঞ্জে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় তিস্তা ও ধরলা নদীতে পানি আরো বাড়বে। সে ক্ষেত্রে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটতে পারে রংপুর বিভাগে।

এদিকে বৃষ্টিপাত কমে আসায় সিলেটের অনেক অঞ্চলে বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। তবে গতকালও সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি বিভিন্ন পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, তিস্তা ও ধরলার পাশাপাশি ব্রহ্মপুত্রসহ আরো ১৬টি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে জেলার বেশির ভাগ অঞ্চলে। গতকাল বিকালে ধরলা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে শিমুলবাড়ী পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমার নদের পানি বাড়লেও গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত তা বিপৎসীমার নিচে ছিল।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্থানীয় কর্মকর্তারা জানান, এসব নদ-নদীর অববাহিকার নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলের ১০ হাজারের বেশি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ভেঙে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। 

কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার ৪৫৩ হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসল তলিয়ে গেছে। উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের মুসারচরের বাসিন্দা মতিয়ার রহমান বলেন, ‘আমাদের বাড়ির উঠানে পানি উঠতে শুরু করেছে। পানি আরো বৃদ্ধি পেলে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করবে।’

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ জানান, বন্যা মোকাবেলায় ১৩ লাখ টাকা, ২৫১ টন চাল ও ২৫০ বান্ডিল ঢেউটিন বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান বলেন, ‘আগামী ৪৮ ঘণ্টায় কুড়িগ্রামের নদ-নদীর পানি আরো বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে।’

বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। গতকাল বিকালে তিস্তার পানি রেলসেতু পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এ পয়েন্টে টানা তিনদিন ধরে পানি বাড়ছে। 

রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, কাউনিয়া উপজেলার গদাই, ঢুসমারার চর, তালুক শাহবাজ, গোপীডাঙ্গা, আরাজি হরিশ্বর, চর প্রাণনাথ, শনশনিয়া, চর হযরত খাঁ, চরগনাই ও আজম খাঁর চরে পানি প্রবেশ করেছে। 

বালাপাড়া ইউনিয়নের ঢুসমারার চর এলাকার কৃষক নজরুল ইসলাম জানান, তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেকের বীজতলা ডুবে গেছে। তলিয়ে গেছে বিভিন্ন সবজি খেত। 

বালাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আনছার আলী বলেন, ‘আমার এলাকায় অন্তত পাঁচটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।’

রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রবিউল ইসলাম বলেন, ‘আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দুধকুমার, তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি আরো বাড়তে পারে। ফলে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও নীলফামারীর নিম্নাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।’

রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান বলেন, ‘বন্যা মোকাবেলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।’

সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। পানি বাড়ার কারণে জেলার নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলের ফসিল জমি তলিয়ে যাচ্ছে। সদর উপজেলার কাওয়াকোলার কৃষক বাবুল সরকার বলেন, ‘যমুনার পানি দ্রুত বাড়ছে। চরের নিচু জমিতে পানি প্রবেশ করতে শুরু করছে। তিন বিঘা জমিতে তিল ও চার বিঘা জমিতে পাটের আবাদ করেছি। যেভাবে পানি বাড়ছে, তাতে ফসল নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।’ 

সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী রণজিৎ কুমার সরকার জানান, গতকাল সকাল থেকে পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় সিরাজগঞ্জ হার্ড পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি ২০ সেন্টিমিটার বেড়েছে। তবে তা বিপৎসীমার ৯৩ সেন্টিমিটার নিচে রয়েছে। অন্যদিকে কাজিপুর উপজেলার মেঘাই পয়েন্টে ২৪ ঘণ্টায় পানি বেড়েছে ২৬ সেন্টিমিটার। তিনি আরো জানান, ৩০ জুনের পর থেকে পানি কমতে শুরু করবে। বড় ধরনের বন্যার আশঙ্কা নেই। 

এদিকে যমুনার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় শাহজাদপুর উপজেলায় নদী-তীরবর্তী বিভিন্ন এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। কয়েকদিনের ব্যবধানে দেড় শতাধিক ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। 

গাইবান্ধা জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট ও করতোয়া নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ফুলছড়ি পয়েন্টে ১৫ সেন্টিমিটার, ঘাঘট নদীর পানি নিউব্রিজ পয়েন্টে ১৫ সেন্টিমিটার ও করতোয়া নদীর পানি চকরহিমাপুর পয়েন্টে ৫৮ সেন্টিমিটার বেড়েছে।

গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানি, মোল্লারচর, গিদারি ও ঘাগোয়া এলাকার নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে ফুলছড়ি উপজেলার এরেন্ডাবাড়ি ও ফজলুপুরে। সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তারাপুর, কাপাসিয়া ও হরিপুর ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলেও পানি ঢুকতে শুরু করেছে।

বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে ময়মনসিংহ বিভাগের নেত্রকোনায়। পাহাড়ি ঢল ও ভারি বৃষ্টির কারণে সীমান্তবর্তী কলমাকান্দাসহ তিন উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। উপদাখালী নদীর পানি গতকাল কলমাকান্দা অংশে বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। 

এদিকে বৃষ্টি কমে আসায় সুরমা ও কুশিয়ারাসহ সিলেটের নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। তবে গতকালও বেশির ভাগ পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫২ সেন্টিমিটার ও সিলেট পয়েন্টে ৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। একই সময়ে কুশিয়ারা নদীর পানি আমলশীদ পয়েন্টে ৩৬ সেন্টিমিটার, ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে ১০৩ সেন্টিমিটার ও শেরপুর পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। 

সিলেট আবহাওয়া অফিসের সহকারী পরিচালক সজীব হোসাইন গতকাল সন্ধ্যায় জানান, ২৪ ঘণ্টায় সিলেটে বৃষ্টিপাত হয়েছে ২০ মিলিমিটার। ভারতের চেরাপুঞ্জিতেও বৃষ্টিপাত কমেছে। এ কারণে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে।

জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল পর্যন্ত ৩৮৩টি আশ্রয় কেন্দ্রে ২৯ হাজার মানুষ অবস্থান করছিলেন। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে সুপেয় পানিসহ খাদ্যসামগ্রীর সংকট তৈরি হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রের বাসিন্দারা বলছেন, তাদের যে খাবার দেয়া হয়, তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। 

জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গতকাল ছয় উপজেলায় দেড় হাজার মানুষের মাঝে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হয়। শুকনো খাবার দেয়া হয় প্রায় ৫০০ জনকে। জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, ১৩টি উপজেলাসহ সিলেট সিটি করপোরেশনের ২৩টি ওয়ার্ডের ১০ লাখ ৪৩ হাজার ১৬১ জন মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে।

সিলেট নগরীর শাহজালাল উপশহর, ঘাসিটুলা, মাছিমপুর, ছড়ারপার, তালতলা, কুয়ারপার, মেন্দিবাগ, কামালগড়, চালিবন্দর, যতরপুর, সোবহানীঘাট, কালীঘাট, শেখঘাট, তালতলা ও জামতলা ঘুরে দেখা যায়, ঘর-বাড়িতে হাঁটুসমান পানি। স্থানীয়রা জানান, রিজার্ভ ট্যাংকে নর্দমার পানি প্রবেশ করায় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে।

সদর উপজেলার খাদিমনগর ইউনিয়নের ১৪-১৫টি গ্রামে বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি করেছে। স্থানীয় চেয়ারম্যান মো. দিলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আজ (শুক্রবার) পর্যন্ত চার টন চাল ও কিছু শুকনো খাবার বরাদ্দ পেয়েছি, যা পর্যাপ্ত নয়।’ জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বলেন, ‘বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে।’

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন বণিক বার্তার সিলেট, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও নেত্রকোনা প্রতিনিধি)   

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন