বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ

এত বছরেও আমরা দেশ শাসনের টেকসই বন্দোবস্ত ঠিক করতে পারিনি

নিজস্ব প্রতিবেদক

‘‌বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় আগামীর করণীয়’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে অতিথিরা ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ‘স্বাধীনতার এত বছর পরও আমরা দেশ শাসনের টেকসই বন্দোবস্ত ঠিক করতে পারিনি। এখন আমাদের প্রশ্ন করা হয় দেশে কোন ধরনের সরকার রয়েছে। হাইব্রিড রিজিম বলা হচ্ছে, অর্থাৎ গণতান্ত্রিক কাঠামোয় এক দলের প্রাধান্যের সরকার।’

রাজধানীতে গতকাল ‘বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় আগামীর করণীয়’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠান হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত গবেষণা সংস্থা বিআইডিএস ও ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি এ অনুষ্ঠান আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান।

দেশের ব্যাংক খাতের বিষয়ে ড. মসিউর রহমান বলেন, ‘ব্যাংক সংস্কারের নীতি হলেও তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকমের জটিলতা রয়েছে।’

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘ভিয়েতনাম ও চীনের মতো দেশের সরকারও উন্নয়ন চায়। কারণ জনগণের দৃষ্টিতে বৈধতা পাওয়া নির্ভর করে অর্থনৈতিক উন্নতির ওপরে।’ তিনি বলেন, ‘উচ্চ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে শুধু রাজনৈতিক আনুগত্য দেখা হলে মেধা বঞ্চিত হয়। তাই সব ক্ষেত্রে না পারলেও কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই মেধাকে গুরুত্ব দিতে হবে।’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এ উপদেষ্টা বলেন, ‘অর্থনৈতিক সমাধান অনেক সময় রাজনীতিতে প্রতিফলিত হয় না।’ উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং একজন অর্থনীতিবিদ ছিলেন, কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় গিয়ে তিনিও সব ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি।’ 

‘বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় আগামীর করণীয়’ নামের বইটি লিখেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিন আহমেদ। নিজের লেখা বইয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংস্কার ছাড়া অর্থনৈতিক অগ্রগতি সম্ভব নয়। গত ১০ বছর টাকার অবমূল্যায়ন, মুদ্রার বিনিময় হার ও নিয়ন্ত্রিত সুদহারের বিষয়টি সরকারপ্রধানের কাছে ঠিকঠাক তুলে ধরা হয়নি। এ তিনটি বিষয় দেশের যে ক্ষতি করেছে, সেখান থেকে ফিরে আসতে অনেক সময় লাগবে। ঋণখেলাপি, কর ফাঁকি আর টাকা পাচার একই সূত্রে গাঁথা। একই ধরনের লোকজন এসবের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। তাই এসব নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে বোঝাতে পারলে কাজ হবে।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার জন্য গভর্নরের পদকে সাংবিধানিক পদ করার প্রস্তাব দেন ড. ফরাসউদ্দিন। আর টেলিনরের মতো বিদেশী কেম্পানিতে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত দেশীয় শেয়ার রাখার পরমর্শ দেন সাবেক এ গভর্নর। এতে দেশের লাভ বাড়বে বলে মনে করছেন তিনি।    

ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘রাজনীতিবিদরা অর্থনীতিবিদদের গৃহভৃত্য না হলেও হুকুমের আজ্ঞাবহ হিসেবে দেখতে চান। বড় বড় খেলাপিরা সাত, আট, নয়বার করে ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারছেন।’ ফরাসউদ্দিন প্রস্তাব দেন, ‘অর্থনীতিবিদেরা জ্ঞানী; গণমাধ্যমে বা টেলিভিশনে তারা কথা বলেন। রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের উচিত আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের কথা শোনা; সেটা করা গেলে খুব ভালো হতো।’

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা এখন ঝড়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। তবে যথাযথ পদক্ষেপ নিলে ঝড় বেশি ক্ষণ স্থায়ী হতে পারে না। এরই মধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তাই অচিরেই অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। কিছু পদক্ষেপ আগে নেয়া গেলে পরিস্থিতি এমন হতো না। তবে রাজনীতিকে ধনী শ্রেণীর প্রভাব থেকে মুক্ত করতে হবে। এটা নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলাপ চলছে। সারা বিশ্বেই এমন প্রভাব দেখা যাচ্ছে। আর ব্যাংকিং, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর ব্যবস্থাপনায় রাজনৈতিকীকরণ বন্ধ করা গেলে বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যেও রাষ্ট্র এগিয়ে যেতে পারে।’ 

ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. একে এনামুল হক বলেন, ‘টেলিনরের মতো বিদেশী কোম্পানিতে জোর করে কিছু করতে গেলে দেশে বিদেশী বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। আর প্রকল্প ব্যয় ৫০০ গুণ বাড়লে সম্ভাব্যতা যাচাই করে কোনো লাভ হবে না। কারণ যে প্রকল্পের এত ব্যয় বাড়ে, সেটা ফিজিবল কোনো প্রকল্প ছিল না।’ 

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘রাজনৈতিক সংযোগের কারণে দেশে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা প্রকট হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যবসায়ীদের চাপে এতদিন সুদের হার বাড়াতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর এখন বিনিয়োগ বলতে অবকাঠামো বোঝানো হয়, কিন্তু শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে জিডিপির মাত্র ১-২ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। ফলে দেখা যাবে অবকাঠামো পরিচালনার মতো দক্ষ জনবল পাওয়া যাচ্ছে না।’ 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ এমএম আকাশ বলেন, ‘গর্ভনর পদ সাংবিধানিক করা হলে সেখানে দুষ্ট লোক বসবে। সেটা আরো খারাপ হবে। কতিপয় চক্রের মধ্যে বাণিজ্য ও আর্থিক নীতিগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। আর ব্যাংক কমিশন করেও লাভ হবে না। কারণ এসব কমিশনের সুপারিশ গ্রহণ করা হয় না।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন