ইসলামী ব্যাংকের গড়ে তোলা উদ্যোক্তারা এখন দেশের অর্থনীতির নেতৃত্ব দিচ্ছেন

ছবি : বণিক বার্তা

মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)। দেশের সর্ববৃহৎ এ ব্যাংকটির জন্ম, বিকাশ, সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাছান আদনান

প্রতিষ্ঠার ৪১ বছর পূর্ণ করেছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি। দীর্ঘ এ পথচলায় আপনাদের অর্জন সম্পর্কে জানতে চাই।

ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ১৯৮৩ সালের ৩০ মার্চ। সে হিসাবে এ ব্যাংকের বয়স আজ ৪১ বছর পূর্ণ হয়েছে। এটি ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম সুদমুক্ত ব্যাংক। শুরুর দিকে এ ব্যাংকের পথচলা ছিল চ্যালেঞ্জিং। প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থার বিপরীতমুখী কার্যক্রম নিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করা সহজ ছিল না। কিন্তু প্রতিষ্ঠার প্রথম দশকেই ইসলামী ব্যাংক গ্রাহকদের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়। এরপরের দশকগুলোয় এ ব্যাংকের কার্যক্রম ক্রমাগত প্রসারিত হয়েছে। আমানত, বিনিয়োগ, আমদানি-রফতানি, রেমিট্যান্স আহরণ, শিল্পায়ন, উদ্যোক্তা উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়নসহ প্রতিটি সূচকে ইসলামী ব্যাংকের অবস্থান এখন সবার শীর্ষে। দেশের মোট ব্যাংক আমানতের ১০ ভাগ এবং বিনিয়োগের ৯ ভাগ এককভাবে ইসলামী ব্যাংক ধারণ করছে।

ইসলামী ব্যাংকের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো স্রোতের বিপরীতে দেশের আর্থিক খাতে একটি বিপরীত ধারা সৃষ্টি করা। বর্তমানে দেশের ব্যাংক খাতের প্রায় ৩০ শতাংশ ইসলামী ধারায় পরিচালিত হচ্ছে। গড়ে উঠেছে ১০টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ধারার ব্যাংক। দেশে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থায় বিদ্যমান এ জনপ্রিয়তা ইসলামী ব্যাংকেরই অর্জন।

কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও উদ্যোক্তা তৈরিতে ইসলামী ব্যাংকের ভূমিকা কী?

ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সময়ে দেশের রফতানি খাত ছিল সীমিত। পাট, চামড়াসহ অল্প কিছু পণ্য তখন বিদেশের বাজারে রফতানি হতো। তৈরি পোশাক খাতের পরিসরও তখন একেবারে ছোট। সেই সময় দেশের উৎপাদনমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানও ছিল হাতে গোনা। এ অবস্থায় ইসলামী ব্যাংক উদ্যোক্তা তৈরি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও শিল্পায়নে জোর দিয়ে কার্যক্রম শুরু করে। আমাদের ব্যাংকের হাত ধরে গড়ে ওঠে একঝাঁক প্রতিশ্রুতিশীল শিল্প উদ্যোক্তা, যারা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অনবদ্য অবদান রেখে চলেছে। বিশেষ করে দেশের তৈরি পোশাক খাতের ভিত্তি তৈরি হয়েছে আমাদের ব্যাংকের বিনিয়োগের মাধ্যমে। দেশের তৈরি পোশাক খাতের বিকাশে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে ব্যাক-টু-ব্যাক ঋণপত্র বা এলসি। ব্যতিক্রমধর্মী এ ঋণপত্রের প্রবর্তন ও জনপ্রিয় করে তুলতে আমাদের ব্যাংকই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে।

বর্তমানে দেশের বৃহৎ শিল্প উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিত অনেক ব্যবসায়ীই ইসলামী ব্যাংকে এসেছিলেন শূন্য হাতে, হেঁটে কিংবা রিকশায় চড়ে। এ ব্যাংকের সহায়তায় তারা শিল্পোদ্যোক্তা হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন। ইসলামী ব্যাংকের গড়ে তোলা উদ্যোক্তারা এখন দেশের অর্থনীতির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ ব্যাংক প্রায় সাড়ে ৬ লাখ কোটি টাকার আমদানি আর ৪ লাখ কোটি টাকার রফতানি বাণিজ্য করেছে। এ ব্যাংকের বিনিয়োগে দেশে প্রায় ৮৫ লাখ মানুষের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে। বর্তমানে দেশে ছয় হাজারের বেশি শিল্প-কারখানা এবং দুই হাজারের বেশি কৃষিভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান এ ব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে। দেশের মোট এসএমই বিনিয়োগের প্রায় ১১ শতাংশ এককভাবে ইসলামী ব্যাংক ধারণ করছে। এর মাধ্যমে গড়ে তুলেছে প্রায় তিন লাখ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা।

ডলার সংকটের কারণে ইসলামী ব্যাংক যথাসময়ে আমদানি ঋণপত্রের (এলসি) দায় পরিশোধ করতে পারছে না বলে অভিযোগ ছিল। এখন পরিস্থিতি কী?

এটি শুধু ইসলামী ব্যাংকের একক সমস্যা ছিল না। বরং বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশের ব্যাংকই এ সংকটে পড়েছিল। তবে ইসলামী ব্যাংক বেশ আগেই এ সংকট কাটিয়ে উঠেছে। গত সপ্তাহ পর্যন্ত আমাদের কোনো এলসি দায়ই অনিষ্পন্ন অবস্থায় ছিল না। বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংক দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক। সরকারি এলসি বাদ দিলে আমাদের ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয়। রফতানি ও রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রেও ইসলামী ব্যাংকের অবস্থান সৃদৃঢ়। শুধু ২০২৩ সালে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে ৫৭ হাজার ৩৪১ কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়েছে। ২০২২ সালে আমাদের ব্যাংকের মাধ্যমে আমদানির পরিমাণ ছিল সাড়ে ৭৫ হাজার কোটি টাকা। আমদানির ক্ষেত্রে আমরা খাদ্যপণ্য, সার, জ্বালানিসহ অত্যাবশ্যকীয় পণ্যকে অগ্রাধিকার দিয়েছি। ২০২৩ সালে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে ৩৩ হাজার ৮০৬ কোটি টাকার পণ্য রফতানি হয়েছে। গত বছর আমরা ৫৬ হাজার ৬১২ কোটি টাকার রেমিট্যান্স দেশে এনেছি, যা দেশের মোট রেমিট্যান্সের প্রায় ২৭ শতাংশ।

আতঙ্কিত গ্রাহকরা ইসলামী ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নিচ্ছিল। সে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে কিনা।

ইসলামী ব্যাংক দেশের দুই কোটিরও বেশি গ্রাহকের প্রতিষ্ঠান। এত বড় গ্রাহক ভিত্তি দেশের অন্য কোনো ব্যাংকের নেই। আমাদের কিছু গ্রাহক আতঙ্কিত হয়ে আমানতের টাকা তুলে নিয়েছিল। তবে সেটি ছিল কেবলই অল্প সময়ের জন্য। পরবর্তী সময়ে একই গ্রাহক টাকা এনে ব্যাংকে জমা দিয়েছে। এখন আমানত পরিস্থিতি পুরোপুরি স্থিতিশীল। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আমাদের ব্যাংকের চলতি হিসাবে যে ঘাটতি ছিল, সেটি নেই। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকে গ্রাহকদের জমা আমানতের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৫৩ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। এত পরিমাণ আমানত দেশের অন্য কোনো ব্যাংকের নেই।

ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ কতটা সুরক্ষিত?

করোনা মহামারী, রাশিয়া-ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধসহ নানা কারণে আমেরিকা, ইউরোপ, চীনসহ সারা বিশ্বের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর প্রভাবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতও বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে। ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ক্ষতিগ্রস্ত হলে ফরোয়ার্ড লিংকেজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এটাই স্বাভাবিক। এসব কারণে দেশের ব্যাংক খাতও কিছুটা ক্ষতির মুখে পড়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও গ্রাহকদের সহযোগিতায় সে ক্ষতি আমরা কাটিয়ে উঠছি। ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহকরা বিনিয়োগ নিয়মিত রাখতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত আমরা ১ লাখ ৫০ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছি। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা দেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান, উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতা বিবেচনা করি।

নিজেদের সংকট সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আপনারা ডলার বিক্রি ও সোয়াপ করছেন। সেটি কেন?

ইসলামী ব্যাংকের বৈদেশিক বাণিজ্যের কার্যক্রম অনেক বড় ও বিস্তৃত। রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের মাধ্যমে আমরাই সবচেয়ে বেশি ডলার দেশে আনি। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ইসলামী ব্যাংক নিজেদের আমদানি দায় মিটিয়ে অতিরিক্ত ডলার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বিক্রি করে আসছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আমাদের বিক্রি করা বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ ১৩ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। এ ডলারে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। প্রয়োজন হলে আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার সহায়তা নিই। আবার যখন উদ্বৃত্ত থাকে তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বিক্রি করি। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।

দেশের ব্যাংক খাতে মার্জার-অ্যাকুইজিশন নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। সুশাসন ফেরাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করছে। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই?

যেকোনো দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হলো ব্যাংক খাত। বাংলাদেশে এখন ৬১টি তফসিলি ব্যাংক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ব্যাংক ভালো করছে। আবার কিছু ব্যাংক তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে পড়েছে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয় বিবেচনা করে পেছনে থাকা ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে। এরই মধ্যে একটি দুর্বল ব্যাংক একীভূত করে দেয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। দেশের অর্থনীতি ও ব্যাংক খাতের সুদিন ফিরিয়ে আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানাই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক খাত সংস্কারে যে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে, সেটিও সময়োপযোগী ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এটি ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

৪১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এ দিনে গ্রাহকদের উদ্দেশে আপনার বার্তা কী?

আমাদের সব গ্রাহক, শুভাকাঙ্ক্ষী ও দেশবাসীর প্রতি আমাদের বার্তা হলো আপনারা কোনো অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হবেন না। ইসলামী ব্যাংকের মূলধন ও আর্থিক ভিত অত্যন্ত শক্তিশালী। চার দশকে গ্রাহকদের যে আস্থা আমরা অর্জন করেছি, ছোটখাটো ঝড়ে সেটি নড়বে না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন