সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স

বরখাস্ত সিইওর শিক্ষা সনদ ভুয়া, মিলেছে অর্থ লোপাটের প্রমাণ

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : সংগৃহীত

সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের বরখাস্ত হওয়া মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মীর রাশেদ বিন আমানের বিরুদ্ধে কোম্পানির প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ মিলেছিল বেশ আগেই। এবার তার জমা দেয়া শিক্ষা সনদ ও অভিজ্ঞতা সনদও ভুয়া বলে প্রমাণ পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সিইও রাশেদ অস্ট্রেলিয়ার ‘ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি সিডনি’র স্নাতকোত্তর (এমবিএ) সনদ নিজেই বানিয়ে নিয়েছিলেন। বানিয়েছিলেন মেঘনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের নামে একটি ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদও। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কাছে তিনি এ দুই ভুয়া সনদই জমা দিয়েছিলেন।

সনদ জালিয়াতি ও কোম্পানির অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় রাশেদের বিরুদ্ধে একটি মামলাও করেছে সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। কোম্পানিটির মানবসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা নাঈমুর রহমান ২২ মার্চ বাদী হয়ে রাজধানীর রামপুরা থানায় মামলাটি করেন। এর আগে অর্থ আত্মসাৎ ও নৈতিক স্খলনের অভিযোগে চলতি বছরের জানুয়ারির শুরুতে রাশেদ বিন আমানকে সিইও পদ থেকে বরখাস্ত করে সোনালী লাইফের পরিচালনা পর্ষদ। পরে তার বিরুদ্ধে একই থানায় কোম্পানির অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করা হয়। ওই মামলায় গ্রেফতার হয়ে রাশেদ এখন কারাগারে।

মামলার এজাহার ও সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্যমতে, রাশেদ বিন আমান সোনালী লাইফে ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি সিডনির স্নাতক (বিবিএ) ও স্নাতকোত্তর (এমবিএ) সনদ জমা দেন। ওই সনদের ভিত্তিতেই তাকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএর অনুমোদনের পর কোম্পানিটির সিইও পদে নিয়োগ দেয়া হয়। অস্ট্রেলিয়ার ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে ৪ মার্চ রাশেদ বিন আমানের সনদের সত্যতার বিষয়ে জানতে চেয়ে সোনালী লাইফ থেকে ই-মেইল পাঠানো হয়। ১৫ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়টির পক্ষ থেকে জানানো হয়, রাশেদ বিন আমানের বিবিএ সনদটি সঠিক হলেও এমবিএ সনদ ভুয়া। এর পরিপ্রেক্ষিতেই বরখাস্তকৃত সিইওর বিরুদ্ধে মামলা করে সোনালী লাইফ। 

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, চাকরির ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা দেখানোর জন্যও প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিলেন রাশেদ বিন আমান। এক্ষেত্রে তিনি জমা দিয়েছিলেন মেঘনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের একটি ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ। 

রাশেদ বিন আমান ২০১৫ সালের মার্চে সোনালী লাইফের সিএফও পদে যোগ দিয়েছিলেন। পরে তাকে অতিরিক্ত এমডি পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। আইডিআরএ থেকে তাকে সোনালী লাইফের সিওই পদে নিয়োগ দেয়া হয় ২০২২ সালের ২৪ এপ্রিল। নিয়োগের চিঠিতে বলা হয়, ‘আবেদনপত্রের সঙ্গে দাখিলকৃত দলিলাদি ভবিষ্যতে অসত্য বা সঠিক নয় বলে প্রমাণ হলে তার দায়ভার কোম্পানি ও সিইওকে বহন করতে হবে। সেক্ষেত্রে এ নিয়োগ অনুমোদন বাতিল বলে গণ্য হবে।’

সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের একাধিক পরিচালক জানান, সিইওর ভুয়া সনদের বিষয়টি তাদের জানার সুযোগ ছিল না। তার সনদ ভুয়া হওয়ার অর্থ হলো তার নিয়োগটি শুরু থেকেই অবৈধ। সে হিসেবে রাশেদ বিন আমান কোম্পানি থেকে বৈধ যে বেতন-ভাতা পেয়েছিলেন, সেগুলোও ফেরত দিতে হবে। মামলার এজাহারে সে বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে।

২০১৩ সালে নিবন্ধন নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিটির বর্তমান মূলধন ও দায়ের পরিমাণ ১ হাজার ৪৮ কোটি টাকা। ৮৬৮ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে কোম্পানিটির লাইফ ইন্স্যুরেন্স তহবিলের আকার। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ১৭২ কোটি টাকা আয় করেছে কোম্পানিটি। একই সময়ে কোম্পাটির ব্যয় ছিল ৩০৩ কোটি টাকা। সারা দেশে সোনালী লাইফের ২০৫টি শাখা ও প্রায় আট লাখ বীমা গ্রাহক রয়েছে।

গত বছরের শেষের দিকে সিইও রাশেদ বিন আমানের অনিয়ম-দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনাগুলো সামনে আসতে থাকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের শুরুতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে সোনালী লাইলের পরিচালনা পর্ষদ। ওই কমিটির তদন্তে কোম্পানির প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া যায়। এর আগে নিরীক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘এমএবিএস অ্যান্ড জে পার্টনারস’-এর মাধ্যমে সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সে নিরীক্ষা চালানো হয়। ওই নিরীক্ষায়ও সিইও রাশেদ বিন আমানের বিরুদ্ধে ৬৩ ধরনের অপরাধ সংঘটনের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। 

তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০২২ সালের ২৭ জুন সিইও রাশেদ বিন আমানের অনুকূলে কোম্পানির মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের হিসাব থেকে ১ কোটি ও শাহ্‌জালাল ইসলামী ব্যাংকের হিসাব থেকে ৫০ লাখ টাকা পে অর্ডার করা হয়। যদিও কোম্পানির নথিতে দেখানো হয়, ‘মেয়াদি ঋণ’ ও ‘এসওডি’ দায় পরিশোধের জন্য এ অর্থ ব্যয় হয়েছে। তদন্ত কমিটি পর্যালোচনা করে দেখেছে, উত্তোলনকৃত অর্থ দিয়ে সোনালী লাইফের কোনো ঋণ বা দায় সমন্বয় করা হয়নি। বরং সিইও রাশেদ পুরো অর্থই আত্মসাৎ করেছেন। 

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামেও ভুয়া বিল তৈরি করে অর্থ স্থানান্তরের প্রমাণ পায় তদন্ত কমিটি। যেমন কোম্পানির নথিতে দেখানো হয়, ২০১৯ সালের ২০ জানুয়ারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে থাকা কোম্পানির হিসাব থেকে র‍্যানকন মোটরসের নামে ৪৭ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে। যদিও এ টাকা র‍্যানকন মোটরসের হিসাবে না গিয়ে সিইও রাশেদ বিন আমানের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছে। আবার ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর কোম্পানির একই ব্যাংক হিসাব থেকে ৪০ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়। এ অর্থের পুরোটাই সিইও আত্মসাৎ করেছেন। কিন্তু কোম্পানির নথিতে ভুয়া একটি খাত দেখানো হয়েছে।

সোনালী লাইফের নিজস্ব আইন অনুযায়ী, কোম্পানির হিসাব বিভাগ থেকে নথিপত্র ছাড়া সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা নগদ উত্তোলন করার বিধান রয়েছে। যদিও সিইও নিজেই এ আইন ধারাবাহিকভাবে ভঙ্গ করেছেন। কোনো প্রকার নথিপত্র ছাড়াই হিসাব বিভাগ থেকে ২০২০ সালে ৩৯ লাখ ৯০ হাজার, ২০২১ সালে ৬০ লাখ ৯৫ হাজার, ২০২২ সালে ১ কোটি ২১ লাখ ও ২০২৩ সালে ৩ কোটি ৮ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়। নগদ উত্তোলনকৃত এসব অর্থ কোম্পানির হিসাব বইয়ে নথিভুক্তও করা হয়নি।

রাশেদ বিন আমান কোম্পানি থেকে কোনো লভ্যাংশ কিংবা কমিশন নিতে পারবেন না এমন শর্তেই আইডিআরএ থেকে তাকে সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সিইও পদে নিয়োগ দেয়া হয়। যদিও নিয়ন্ত্রক সংস্থার দেয়া এ শর্তেরও বরখেলাপ করেছেন তিনি। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর কোম্পানিটির ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের হিসাব থেকে ৩২ লাখ ৫০ হাজার টাকা নগদে উত্তোলন করা হয়। কোম্পানির নথিতে এ অর্থ ব্যয়ের খাত দেখানো হয়েছে ‘রাশেদ বিন আমানের বার্ষিক প্রণোদনা পরিশোধ’। আবার ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি একই ব্যাংকের হিসাব থেকে ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়। কোম্পানির নথিতে এ অর্থ ব্যয়ের খাত দেখানো হয় ‘নির্বাহীর বার্ষিক লক্ষ্য পূরণ প্রণোদনা পরিশোধ’। 

পুঁজিবাজার থেকে সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কেনার ক্ষেত্রেও প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন রাশেদ বিন আমান। প্রাপ্ত নথিপত্র অনুযায়ী, ২০২২ সালের ২৯ জুন কোম্পানির টাকায় সোহানা আক্তার নামে কানাডা প্রবাসী এক নারীর নামে ৩০ লাখ টাকার শেয়ার কেনা হয়। ওই নারী রাশেদ বিন আমানের চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রী। একইভাবে সিইওর অন্য স্বজনের নামেও শেয়ার কেনা হয়। প্রতারণামূলক বেনামি শেয়ার কেনায় সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে বলে তদন্ত কমিটি প্রমাণ পেয়েছে।

আইডিআরএ থেকে অনুমোদিত বেতন-ভাতা অনুযায়ী, সিইও হিসেবে রাশেদ বিন আমান ২০২০-২৩ চার বছরে ঈদ বোনাসসহ ১ কোটি ৭৮ লাখ ৬১ হাজার ৯৮০ টাকা বেতন-ভাতা প্রাপ্য হন। যদিও তিনি এ চার বছরে প্রণোদনাসহ সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স থেকে ৪ কোটি ৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা উত্তোলন করেছেন। 

ভুয়া নথিপত্র বানিয়েও সোনালী লাইফের হিসাব বিভাগ থেকে ৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা তুলে নেন রাশেদ বিন আমান। এ টাকা গ্যালাক্সি হলিডেজ লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে পরিশোধ দেখানো হয়। যদিও গ্যালাক্সি হলিডেজের নীতি অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি নগদে কোনো অর্থ গ্রহণ করে না। তদন্ত কমিটি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে থাকা রাশেদ বিন আমানের ব্যক্তিগত একটি হিসাব বিবরণী উত্তোলন করে। ওই ব্যাংক হিসাবে ২০১৮ সালে ৬১ লাখ ৯০ হাজার ৩৭১, ২০১৯ সালে ৬২ লাখ ৬৮ হাজার ৬৯৮, ২০২০ সালে ৯৮ লাখ ৮০ হাজার ৭০০, ২০২১ সালে ৮৬ লাখ ৮২ হাজার ৬১৪, ২০২২ সালে ৪ কোটি ১৬ লাখ ৪৮ হাজার ৫৫৬ ও ২০২৩ সালে ২ কোটি ১৩ লাখ ৫০ হাজার ৫১২ টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। যদিও এ ব্যাংক হিসাবটি কখনই রাশেদ বিন আমানের বেতন-ভাতা জমার কাজে ব্যবহার হয়নি। অর্থাৎ শুধু এই একটি হিসাবেই মাত্র ছয় বছরে সাড়ে ৮ কোটি টাকার বেশি লেনদেন করেছেন তিনি।

সিইও পদে থাকা অবস্থায় ফাতেমা তামান্না সুইটি নামে কোম্পানির একজন সাধারণ কর্মচারীর সঙ্গে পরকীয়ায় জড়ান রাশেদ বিন আমান। পরে ওই কর্মচারীকে বিয়েও করেন। বিষয়টিকে সিইওর নৈতিক স্খলনের পাশাপাশি কোম্পানির আইন ভঙ্গ হিসেবে দেখছে তদন্ত কমিটি। কারণ সিওই হিসেবে অধীনস্থ কর্মচারীর সঙ্গে এ ধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া সোনালী লাইফের মানবসম্পদ রীতিনীতির বিরুদ্ধ।

সোনালী লাইফের একজন পরিচালক নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বলেন, ‘কোম্পানি থেকে আত্মসাৎকৃত অর্থে রাশেদ বিন আমান বিলাসী জীবন যাপন করেছেন। অভিজাত একটি আবাসন কোম্পানি থেকে গুলশানে সাত হাজার বর্গফুটের অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন। এটি কিনতে তার ব্যয় হয়েছে ২২ কোটি টাকা। ৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা দামের পোর্শে টাইকান ও ২ কোটি ৭৫ লাখ টাকায় মার্সিডিজ জিএলই কিনেছেন। আবার কোম্পানি থেকে আত্মসাৎকৃত বিপুল অর্থ অস্ট্রেলিয়ায় পাচারও করেছেন।’

তবে কারাগারে যাওয়ার আগে আইডিআরএ, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনসহ (বিএসইসি) বিভিন্ন সংস্থার কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন রাশেদ বিন আমান। সে অভিযোগপত্রে তিনি সোনালী লাইফের তৎকালীন চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অর্থ তছরুপের অভিযোগ তোলেন। শিল্প উদ্যোক্তা মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের মেয়ের জামাই ছিলেন রাশেদ বিন আমান।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রাশেদ বিন আমান বিশ্বাস ও ভালোবাসার ভয়ংকর প্রতিদান দিয়েছেন। পরিচালনা পর্ষদ তাকে কোম্পানি পরিচালনায় পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পুরোপুরি অপব্যবহার করেছেন।’

কারাগারে থাকায় এ বিষয়ে রাশেদ বিন আমানের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তার পিতা মীর এনামুল করিম আমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন