আমাদের যেন ঋণ এনে ঋণ পরিশোধ করতে না হয়

ছবি : বণিক বার্তা

অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ ২৫ বছর শিক্ষকতা করেছেন। গবেষণাকর্মের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টির মর্যাদাপূর্ণ ইব্রাহিম স্মৃতি স্বর্ণপদকে ভূষিত হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট ও ট্রাস্টি বোর্ড সদস্য। সাম্প্রতিক অর্থনীতির নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাবিদিন ইব্রাহিম

শিগগিরই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে বলা হলেও প্রায় দুই বছর হয়ে গেছে, এখনো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা মূল্যস্ফীতি আরো বাড়তে পারে, এ ব্যাপারে আপনি কী মনে করছেন?

কয়েক বছর ধরেই আমরা এ চিত্র দেখতে পাচ্ছি। তবে এখন মূল্যস্ফীতি যদি নিম্নমুখীও হয় মূল্যস্তর কিন্তু ওপরে উঠে গেছে—এ কথা আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন। নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত সবারই ক্রয়ক্ষমতার একটা অবনমন ঘটছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) উপাত্ত অনুসারে বাংলাদেশের দারিদ্র্যসীমার নিচে ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ। কিন্তু যখন খাদ্যনিরাপত্তার কথা এল তখন বিবিএসের উপাত্তে দেখা যাচ্ছে, ২২ শতাংশের বেশি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের উপাত্তে দেখা যাচ্ছে, প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ পুষ্টিনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তাহলে দারিদ্র্যসীমার সঙ্গে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, জীবনযাত্রার মানের একটা বৈপরীত্য রয়েছে যাচ্ছে।

এমনটা কেন হচ্ছে বলে মনে করেন? এ সংকট নিরসনে কী করণীয়? 

এখানে দুটি বিষয় রয়েছে। একটা হলো, বিনিয়োগ বাড়িয়ে কীভাবে আয়বর্ধক কর্মসূচি আমরা ব্যবহার করতে পারি। এখন থেকে ১৫ বছর আগে মূল্যস্তর আরো অনেক কম ছিল কিন্তু জীবনযাত্রার মান নিম্ন ছিল না। কারণ আয় ছিল ঊর্ধ্বমুখী। অর্থাৎ মূল্যস্তর বা মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আয় বাড়লে ক্রয়ক্ষমতার অবনমন হয় না। সুতরাং এটা সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত। আমাদের অর্থনীতি যে কিছুটা ঝুঁকির মুখে পড়ে গেছে সেটা স্পষ্ট। আমাদের অর্থনীতির যে উচ্চ প্রবৃদ্ধি এবং নিম্ন মূল্যস্ফীতির ব্যাপারটা ছিল তা এখন আর আমাদের মধ্যে নেই। মূল্যস্ফীতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, নতুন ভারসাম্য আনতে হবে। এজন্য প্রবৃদ্ধি কিছুটা নিচের স্তরে হলেও তা আমাদের মেনে নিতে হবে। এখানে সংকোচনমূলক যে মনিটারি পলিসি নেয়া হয়েছে সেটা আমার কাছে ঠিক মনে হয়েছে। সুদহার বাড়ানো হয়েছে, স্মার্ট রেট চালু করা হয়েছে, রিভার্স রেপো চেঞ্জ করা হয়েছে, পলিসি রেটকে বাড়ানো হয়েছে যেন বাজারে মানি সাপ্লাই কমানো যায়। খেয়াল রাখতে হবে যে এখানে শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে হবে না, রাজস্বনীতির ব্যাপার আছে। শুল্ক কমানো হলে ভোক্তারা সাশ্রয়ী মূল্যে কিনতে পারে। সেখানে আমি যদি শুল্ক কমাই এবং ভোক্তারা যেন সে সুফলটা পেতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। সাপ্লাই চেইনের যে অ্যাক্টররা (প্রভাবক) আছে তাদের ওপর তদারক করতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের যে বৈদেশিক বিনিময় হার তা যদি স্থিতিশীল করতে পারি তবে তা আমদানীকৃত মূল্যস্ফীতির ওপর একটা ইতিবাচক প্রভাব রাখবে। সুতরাং অনেকগুলো ফ্যাক্টর আমাদের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার উৎকর্ষ, আমাদের অর্থনীতিতে একটি নতুন ভারসাম্য নিয়ে আসার ওপর নির্ভর করবে যে আমরা মূল্যস্ফীতি কমাতে পারব কিনা। কিন্তু আমাদের বিনিয়োগ বাড়ানো, কস্ট অব ডুইং বিজনেস কমানো, উদ্যোক্তারা যাতে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে পারে ইত্যাদি বিষয়ের দিকেও নজর দিতে হবে। কারণ মূল্যস্ফীতির কারণে মূল্যস্তর অনেক বেড়ে গেছে। এখন যদি মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমেও স্তরটা ওপরের দিকেই থেকে যাবে। সুতরাং সেখানে আয়বর্ধক বিভিন্ন কর্মসূচি নিতে হবে। গড় আয় যেটা বছরে বাড়ে, মূল্যস্ফীতি তার দ্বিগুণ, যেমন তৈরি পোশাক খাতের একজন কর্মীর কথা যদি চিন্তা করি তাহলে দেখব, তার বেসিক স্যালারি ৫ শতাংশ করে বাড়ছে কিন্তু তার খাদ্যের মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি। ফলে আয় কিছুটা বাড়লেও তার ক্রয়ক্ষমতার কিন্তু অবনমন ঘটছে। অর্থাৎ আমাদের এসব ক্ষেত্রে যে আনুষঙ্গিক উদ্যোগগুলো রয়েছে—দক্ষতা বাড়ানো, প্রডাক্টিভিটি বাড়ানো ইত্যাদির দিকে নজর দিতে হবে।

গত আট বছরে আমাদের বৈদেশিক ঋণ দ্বিগুণ বেড়েছে মাথাপিছু প্রায় ৬৩ হাজার টাকা। এটা আমাদের অর্থনীতির জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ?

আমার মনে হয় যে বৈদেশিক ঋণের পরিষেবা নিয়ে আমাদের গুরুত্বসহকারে চিন্তা করা দরকার। কেননা এটা আরো বাড়বে। বিগত কয়েক বছরে যেসব ঋণ আমরা নিয়েছি সেগুলোর ম্যাচিউরিটি পিরিয়ড চলে এসেছে। গ্রেস পিরিয়ড, যখন আমাদের কোনো ঋণ পরিষেবার দরকার হবে না, সে পিরিয়ড শেষ হয়ে গেছে। এখন আমরা যে ঋণগুলো নিচ্ছি সেগুলোর অনেকগুলোরই গ্রেস পিরিয়ড কম, ম্যাচুরিটি পিরিয়ড কম সুতরাং দায়ভারটা বেশি। আমরা মিনিস্ট্রি অব ফাইন্যান্সের যেসব প্রাক্কলন পাচ্ছি তাতে দেখা যাচ্ছে, ১০ বছর আগে আমাদের যদি ২ বিলিয়ন ডলারের মতো পরিষেবা হতো (সুদাসলে) বৈদেশিক ঋণের, যা এখন ৪-৫ বিলিয়ন ডলারের দিকে চলে যাচ্ছে। এমন একটা সময়ে যাচ্ছে যখন আমাদের রিজার্ভ কমের দিকে। যখন রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ছিল তখন ২ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিষেবা থাকলে এক কথা, কিন্তু এখন রিজার্ভ ২১ বিলিয়ন ডলার এবং ঋণ পরিষেবা করতে হচ্ছে ৪-৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন!

ভিন্নতর এ পরিস্থিতির মুখে বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কী? 

এখন নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হবে কিছুটা রাশ টেনে ধরা। পুরনো বিনিয়োগ যেগুলো পাইপলাইনে আছে সেগুলো বাস্তবায়ন করা। এছাড়া ঋণ আলোচনাগুলো এমনভাবে করা যাতে করে আমরা যে শর্তে ঋণ নিচ্ছি তা যেন আমাদের অনুকূলে হয়। ২০১৫ সালে আমাদের যখন মধ্যম আয়ের দেশে গ্র্যাজুয়েশন হলো তখন কিন্তু কনসেশনাল লোন অনেক কমে গেল। আমাদের নন-কনসেশনাল লোনই এখন বেশি। আমাদের ঋণের দায়ভার আগের তুলনায় আগামীতে বাড়বে। আমাদের বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। যাতে করে আমাদের পরিষেবায় কোনো সমস্যা না হয়। জিডিপির সঙ্গে তুলনা করলে বৈদেশিক ঋণ অত বেশি নয়, তুলনামূলকভাবে অনেক কম (আমাদের জিডিপির ১৮ বা ১৯ শতাংশ)। তবে খেয়াল রাখতে হবে আমাদের রেভিনিউ (রাজস্ব) কত হলো। কারণ এই রেভিনিউ দিয়েই ঋণ পরিষেবা করতে হবে। অথচ আমাদের রেভিনিউ-জিডিপি হার এখন ৯ শতাংশেরও কম! এর একটা বড় অংশ তো ঋণ পরিষেবাতেই তাহলে চলে যাবে। তখন যেন ঋণ এনে ঋণ পরিশোধ করা না লাগে—এমন অবস্থা এড়াতে আমাদের রেভিনিউ বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। আমাদের বিনিময় হারকে স্থিতিশীল করা। যেহেতু অনেকগুলো প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে যার রিটার্ন আসবে টাকায় কিন্তু ফেরত দিতে হবে ডলারে। একসময় আমরা ৮৬ টাকায় ১ ডলার হিসাব করলেও এখন ১১০ টাকায় ১ ডলার হিসাব করা হচ্ছে। অর্থাৎ সেখানে একটা দায়ভার তুলনামূলকভাবে বেড়েই চলেছে। অর্থাৎ প্রকল্পগুলো যেন সাশ্রয়ীভাবে, সময়মতো ও সুশাসনের সঙ্গে বাস্তবায়ন হয়—এর প্রয়োজনীয়তা এখন তুলনামূলকভাবে অন্য অনেক কিছুর চেয়ে বেশি। এখন এটি যদি বাস্তবায়ন করতে পারি তবে আমরা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব। তবে যদি তা করতে ব্যর্থ হই তাহলে আমাদের চাপ ক্রমান্বয়ে বাড়বে। কেননা আমাদের রিজার্ভ অনেকটাই কমে এসেছে।

সাম্প্রতিক বাজেট প্রস্তাবে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে, চলতি অর্থবছরে ৮৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ঘাটতি হতে পারে। এ ঘাটতি সামষ্টিক অর্থনীতিতে কীভাবে প্রভাব ফেলবে?

আমাদের প্রথম ছয় মাসের যে তথ্য-উপাত্ত আছে, আমরা যদি এভাবেই অগ্রসর হই এবং গত বছর আমরা রাজস্বে যে প্রকৃত আয় করেছি সেসব বিবেচনায় রেখে এবারের যে রিভাইসড টার্গেট আছে সেটায় কী পার্থক্য হতে পারে—আমরা সেটা প্রাক্কলন করেছি। এ অ্যামাউন্ট থেকে কিছুটা কম হলে অবশ্যই ভালো, কিন্তু এটা নিঃসন্দেহে একটি বড় অ্যামাউন্ট হবে। 

এক্ষেত্রে আমাদের দুটো পথ আছে— অর্থবছরের বাকি সময়টাতে আমরা যদি ব্যয় কমাই তবুও ঘাটতির পার্থক্য অতটা হবে না। যতটা প্রাক্কলন করেছি সেটাই থাকবে। কিন্তু আমার আয় যদি ৭০-৮০ হাজার কোটি টাকা কমে যায় আর ব্যয় যদি আগের মতোই থাকে তাহলে কিন্তু ঘাটতি দেখা দেবে। আর এ ঘাটতি পূরণ করতে হবে বিভিন্ন ঋণ নিয়ে। হয় অভ্যন্তরীণ ঋণ নিয়ে (ব্যাংক খাত, নন-ব্যাংক খাত, সঞ্চয়পত্র ইত্যাদি বিক্রি করে) অথবা বৈদেশিক ঋণ নিয়ে (যে বৈদেশিক ঋণের পরিষেবা মূল্য তো বেড়ে যাচ্ছে যেমনটা আমি বললাম)। তবে এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়াকালীন কোনো ঋণ ফাঁদে যেন না পড়ে যায়।

বিদ্যমান সংকট নিরসনে এখন জরুরি ভিত্তিতে আমাদের কী করণীয়?

আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার হতে পারে আমাদের রাজস্ব, জিডিপি রেশিও যা আমরা বাড়াতে পারি। এটা করা যাবে প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর মাধ্যমে। বাংলাদেশে আমরা কিন্তু দেখছি যে, আয়বৈষম্য বা সম্পদবৈষম্য বাড়ছে যেটা ইতিবাচক নয়। বাংলাদেশে আমরা একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ চাই, কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়! বিবিএসের হিসাব বলছে, আয় কেন্দ্রীভূতকরণের যে সুযোগ তা ১৯৯০ সাল থেকে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে এবং তা শহরে ও গ্রামে বেড়ে চলেছে (৫ শতাংশ বেড়েছে)। এটা আমাদের দুশ্চিন্তার কারণ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। আমরা কিন্তু ইন্টারজেনারেশনাল গ্যাপ বা আন্তঃপ্রজন্মের মধ্যকার পার্থক্য কমিয়ে আনতে পেরেছিলাম। আমাদের পাঁচ দশক ধরে আর্থসামাজিক সূচকে যে উন্নয়ন হয়েছে (গত দুই দশকে আরো দ্রুত হারে হয়েছে), এ ইতিবাচক প্রবণতাও কিন্তু একটা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। এক্ষেত্রে আমরা অবশ্যই চেষ্টা করব কীভাবে রাজস্ব, জিডিপি প্রত্যক্ষ কর আহরণের মাধ্যমে বাড়াতে পারি। অনেকেই দুর্নীতি করে, ঋণ খেলাপি করে দেশের টাকা বাইরে পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে। আগে এ পাচারকৃত টাকা দেশে বিনিয়োগ করা হলেও এখন তা দেশের মধ্যে থাকছে না। এ টাকা তারা বাইরের দেশে বিনিয়োগ করছে, ফলে দেশের অর্থনৈতিক সিস্টেমের মধ্যেই টাকাটা আর আসছে না। এ নেতিবাচক প্রবণতাগুলো আমাদের প্রশাসনকে শক্তিশালী করে মোকাবেলা করতে হবে। এখন বাংলাদেশের অর্থনীতি ৪৬০ বিলিয়ন ডলারের, পারচেজিং পাওয়ার হিসাব করলে ১ ট্রিলিয়ন ডলারের একটা অর্থনীতি।  এগুলো ম্যানেজ করা অত্যন্ত কঠিন একটা কাজ। এক্ষেত্রে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সুশাসন, জবাবদিহিতা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, সরকারি পরিষেবা যেসব প্রতিষ্ঠান করে তাদের জবাবদিহিতা ও সক্ষমতা বাড়িয়ে আমাদের বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হবে। এটা করতে পারলে আমাদের রাজস্ব আয় বাড়বে এবং বাস্তবতার সঙ্গে প্রাক্কলনের যে ব্যবধান দেখা যাচ্ছে সেটাও কমাতে পারব।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন