মাঠ পর্যায়ে আলু উৎপাদন কমেছে

শাহাদাত বিপ্লব

লাভের আশায় পরিপক্ব হওয়ার আগেই এবার আলু তুলে ফেলেন অনেক কৃষক ছবি: ফাইল/নিজস্ব আলোকচিত্রী

চলতি অর্থবছরে ১ কোটি ১৬ লাখ টন আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই)। যদিও প্রতিকূল আবহাওয়া ও কৃষকদের সময়ের আগেই আলু উত্তোলন করে বিক্রি করে দেয়ার প্রবণতায় সে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ডিএইর হিসাবে চলতি অর্থবছরে দেশে আলু উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৯ লাখ ৬৩ হাজার টনের কিছু বেশি। সে অনুযায়ী দেশে এবার সরকারি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৬ লাখ ৩৭ হাজার টন কম আলু উৎপাদন হয়েছে। 

যদিও দেশে এবার কৃষিপণ্যটির প্রকৃত উৎপাদন সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক কম হয়েছে বলে দাবি করছেন হিমাগার মালিকরা। তাদের ভাষ্যমতে, হিমাগারগুলোয় এবার আলু জমা হয়েছে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে প্রায় ২০-৩০ শতাংশ কম।

কৃষি খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবারের আলু উৎপাদন মৌসুমের (রবি) প্রায় পুরোটাজুড়েই অস্বাভাবিক আচরণ করেছে আবহাওয়া। ভরা শীতে কখনো টানা বৃষ্টি আবার কখনো ঘন কুয়াশায় রোগবালাই ছড়িয়েছে আলুর খেতে। এছাড়া বছরজুড়ে দাম বেশি থাকায় পরিণত হওয়ার আগেই আলু তুলে বিক্রি করে দিয়েছেন অনেক কৃষক, যার প্রভাব পড়েছে সার্বিক উৎপাদনে। 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে আলু উৎপাদন হয়েছে ৪ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টর জমিতে। মোট ১ কোটি ৯ লাখ ৬৩ হাজার টন উৎপাদনের সিংহভাগই উচ্চফলনশীল জাতের, যার পরিমাণ ১ কোটি ১ লাখ ৫৬ হাজার টন। আর স্থানীয় জাতের আলু উৎপাদন হয়েছে ৮ লাখ ৭ হাজার টন। 

সরকারি এ হিসাবে আলুর প্রকৃত উৎপাদন চিত্র উঠে আসেনি বলে দাবি করছেন হিমাগার ব্যবসায়ীরা। তাদের ভাষ্যমতে, প্রকৃত উৎপাদনের সঙ্গে সরকারি তথ্যের ব্যবধান নিত্যপণ্যটির বাজার অস্থিতিশীল করে তোলায় বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে।

বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কোল্ড স্টোরেজগুলোয় গত বছর (২০২৩ পঞ্জিকাবর্ষ) ২৩ লাখ টনের মতো আলু জমা হয়েছিল। এটা ধারণক্ষমতার ৭০ শতাংশ। অর্থাৎ বাকি ৩০ শতাংশই খালি ছিল। অথচ আগে হিমাগারগুলোয় আলু রাখারই জায়গা পাওয়া যেত না। আর গত বছর আলু উৎপাদন কম হওয়ায় এবার আগাম জাতের আলু অপরিণত বয়সেই বিক্রি হয়ে যায়। এ কারণে সরকারি হিসাবে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে; আমাদের ধারণা তা এত হবে না। নইলে আলুর মৌসুমেই কৃষকরা তা কেজিপ্রতি ২৫-৩৫ টাকায় বিক্রি করত না। এখন কৃষক পর্যায়েই প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা দরে। উৎপাদনের তথ্য ভুল হওয়ার কারণেই আলুর বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছিল।’ 

দেশে সবচেয়ে বেশি আলু উৎপাদন হয় রংপুর জেলায়। জেলাটিতে এবার কৃষিপণ্যটির আবাদি জমির পরিমাণ বাড়লেও উৎপাদন কমেছে। এজন্য মানসম্পন্ন বীজের অভাব, অপরিপক্ব আলু উত্তোলন ও আবহাওয়াকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। রংপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর জেলায় ৫৩ হাজার ৯৩০ হেক্টর জমিতে আলু উৎপাদন হয়েছে ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৬১২ টন। গত বছর ৫৩ হাজার ৩০৫ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছিল ১৬ লাখ ৪ হাজার ৫৫৬ টন। অর্থাৎ জেলায় এবার আবাদি জমির পরিমাণ ৬২৫ হেক্টর বাড়লেও উৎপাদন কমেছে প্রায় ৬১ হাজার ৯৪৪ টন। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রংপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে সংযুক্ত কৃষি কর্মকর্তা মো. রোকনুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেরিতে শীত আসা এবং কম সময়ে তীব্র ঠাণ্ডা অনুভূত হওয়ায় এবার আলুর টিউবারের সংখ্যা কম ও আকারে ছোট হয়েছে। আবাদের জমি বাড়লেও এবার ফলন কমার এটি অন্যতম কারণ। এছাড়া মানসম্পন্ন বীজের অভাব এবং মূল্যের ঊর্ধ্বমুখিতায় কৃষকদের অপরিপক্ব আলু উত্তোলনেরও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ফলনশীলতায়। এবার প্রতি হেক্টরে আলু উৎপাদন হয়েছে ২৮ দশমিক ৬০ টন। যেখানে গত বছর হয়েছিল ৩০ দশমিক ১০ টন।’

লক্ষ্য অর্জন হয়নি আলু উৎপাদনে আরেক বৃহৎ জেলা বগুড়ায়ও। শীত ও ঘন কুয়াশার সঙ্গে হঠাৎ বৃষ্টি ও রোগবালাইয়ে জেলায় এবার কৃষিপণ্যটির উৎপাদন কমেছে প্রায় সোয়া লাখ টন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাভাবিক অবস্থায় বিঘাপ্রতি ফলন হওয়ার কথা ১১০ থেকে ১২০ মণ। সেখানে বিঘাপ্রতি ফলন হয়েছে ১০০ মণের নিচে। এছাড়া আবাদ শুরু থেকে বাজারে বিক্রি পর্যন্ত আলু উৎপাদনে খরচও বেশি গুনতে হয়েছে বলে দাবি করছেন কৃষকরা। শিবগঞ্জ, সদর উপজেলা ও মহাস্থানগড় এলাকার কৃষকরা বলছেন, জানুয়ারিতে আলু উত্তোলনের সময় বগুড়ায় আকস্মিক বৃষ্টি হয়েছে। এ বৃষ্টিতে আলুর খেতে পচন ধরে। বিভিন্ন রোগবালাই দেখা দেয়। এছাড়া ছিল প্রচণ্ড শীত ও কুয়াশা। এসব কারণে জমিতে ফলন কম হয়েছে। 

বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ফরিদুর রহমান ফরিদ জানান, ‘এবার আলু খেতে লেট ব্লাইট বা পাতা পচা রোগ দেখা দেয়। এ নিয়ে উৎপাদন মৌসুমে জেলার ১২টি উপজেলার গ্রামে গ্রামে আলু ক্ষেতে রোগসংক্রান্ত সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ ও উঠান বৈঠক করা হয়। চলতি বছর বগুড়ায় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৩ লাখ ২০ হাজার ৪৭৫ টন। এর বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ১১ লাখ ৯৩ হাজার ৬১৫ টন। সে হিসাবে চলতি বছর আলু উৎপাদন কম হয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার টন। 

উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি নওগাঁ জেলায়ও। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌চলতি মৌসুমে জেলায় ১৯ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও ২০ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ করেছেন স্থানীয় চাষীরা। জেলায় আবাদকৃত জমি থেকে ৩ লাখ ৯৭ হাজার ২১৫ টন আলুর ফলন পাওয়া যাবে এমনটাই প্রত্যাশা ছিল কৃষি বিভাগের। তবে এ বছর আলুর বাজারদর বেশি হওয়ায় আলু পরিপক্ব হওয়ার আগেই অনেক চাষী খেত থেকে আলু তুলে বাজারে বিক্রি করেছেন। এতে উৎপাদন কমে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৮৮ হাজার ৫১০ টনে।’ 

আলু উৎপাদনে অন্যতম শীর্ষ জেলা মুন্সিগঞ্জ। এখানেও এবার আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। ৪ হাজার ৩৫৫ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছে ১০ লাখ ৩৬ হাজার ২৫০ টন। যদিও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ লাখ ৫৬ হাজার ৪৮৩ টন। এছাড়া জেলায় এবার আলুর উৎপাদনশীলতাও কমেছে। 

দেশে এবার আলুর উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্লান্ট প্যাথলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মৌসুমের শুরুতে ব্যাপক হারে কৃষকরা অপরিণত আলু তুলেছেন। কারণ বাজারে দাম বেশি ছিল। এটি সার্বিক উৎপাদন কমানোয় ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া আবহাওয়ার বিরূপ আচরণে আলুতে রোগবালাইও ছড়িয়েছে বেশি। এতে দামের ক্ষেত্রে সংকট তৈরি হতে পারে। তবে আলুর সংকট তীব্র হওয়ার শঙ্কা কম। কারণ মানুষ খাওয়া কমিয়েছে। দাম বেশি হওয়ার কারণে আগে যিনি ১০ কেজি আলু কিনতেন, তিনি এখন পাঁচ কেজি কিনছেন। সব মিলিয়ে সংকট তীব্রতা না পেলেও বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার একটা শঙ্কা থেকে যাবে।’ 

দেশে বর্তমানে আলুর বার্ষিক চাহিদা ৭৫-৮০ লাখ টন। এর মধ্যে আলুর সংগ্রহ-পরবর্তী ক্ষতি হয় প্রায় ১০-১৫ শতাংশ। সে হিসাবে বছরে আলু উৎপাদনের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৯০-৯৫ লাখ টন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে আলু উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৪ লাখ ৩৬ হাজার ৭৩৬ টন। যদিও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে শুরুতে তা ছিল ১ কোটি ১২ লাখ টন। এরপর বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় সরকারি হিসাবের চেয়ে প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ আলু উৎপাদন কম হয়েছে। এ কারণে গত বছরের শেষদিকে বাজারে অস্থিতিশীলতা শুরু হয়। এখনো তার রেশ কাটেনি। 

বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহসভাপতি ইশতিয়াক আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌আগে প্রতি একর জমিতে ১১ টন আলু পাওয়া যেত। কিন্তু এবার কৃষক পর্যায়ে আমরা যেটা শুনেছি, প্রতি একরে তারা আট-নয় টন আলু পেয়েছেন। আবার গত বছর আলুর উৎপাদন কম হওয়ায় অনেকে বীজ আলু বিক্রি করে দিয়েছিল। এ কারণে এ বছর আলুর আবাদি জমি কিছুটা কমে গিয়েছিল। তবে উৎপাদন যা হয়েছে, বলা যায় গত বছরের মতোই। গত বছর মাঠ পর্যায়ে আলুর দাম ছিল ১২-১৩ টাকা। কিন্তু এবার সেটা ছিল ২৮-৩২ টাকা। ফলে খুচরা বাজারে এর প্রভাব সারা বছরই থাকবে। প্রত্যেকেই অস্বাভাবিক মুনাফা করছে। গত বছর আলুর উৎপাদন সরকারি তথ্যের চেয়ে অনেক কম হয়েছিল। এবারো তার কাছাকাছি উৎপাদন হবে।’ 

বর্তমানে রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫৫ টাকায়। গত বছরের এপ্রিলের শেষদিকে এ দাম ছিল প্রতি কেজি ২৭-৩০ টাকা। সে অনুযায়ী, গত এক বছরে আলুর দাম বেড়ে বর্তমানের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০২৩ পঞ্জিকাবর্ষের শেষদিকে বাজারে তা ৭০ টাকায়ও উঠেছিলে। 

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক খাদ্য সচিব আব্দুল লতিফ মন্ডল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আলুই একমাত্র ফসল ছিল যেটায় আমরা এতদিন স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিলাম। আমদানি করা লাগত না। কিন্তু এখন আলুও আমদানি করতে হচ্ছে। এটা কি উৎপাদন কম হওয়ার কারণে নাকি সিন্ডিকেশনের কারণে সেটাও স্পষ্ট নয়। এখানে বাজার ব্যবস্থাপনার একটা বড় দুর্বলতা রয়েছে। আলুতে সিন্ডিকেশন ভর করেছে। সরকার যদি সিন্ডিকেশন নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে এ বছর আরো বড় সংকট দেখা দেবে। আলু গরিব মানুষ বেশি খায়। তাদের ওপর এখন বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে না থাকলে মানুষকে ভুগতে হবে।’ 

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন বণিক বার্তার রংপুর, নওগাঁ, বগুড়া ও মুন্সিগঞ্জ প্রতিনিধি)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন