দেশে সিসার দূষণ

হৃদরোগ ও রক্তনালির অসুস্থতায় বছরে কেটেছে মানুষের ৪৩ কোটি দিন

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

ছবি : বণিক বার্তা

দেশে অসংক্রামক রোগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ বা হৃদরোগ ও রক্তনালির রোগে। আর এসব রোগের অনেক কারণের একটি সিসার দূষণ বা বিষক্রিয়া। এ দূষণে বিশ্বের যেসব দেশের জনস্বাস্থ্য হুমকিতে পড়েছে তার মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে বাংলাদেশ। দেশের প্রায় সব বয়সী মানুষের দেহেই মিলেছে ক্ষতিকর মাত্রায় সিসার উপস্থিতি, যা তৈরি করেছে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি। বছরে সমন্বিতভাবে দেশের মানুষের অন্তত ৪৩ কোটি দিন কেটেছে হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালির অসুস্থতায়। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।  

‘বিল্ডিং ব্লক এ গ্রিনারি বাংলাদেশ: কান্ট্রি এনভায়রনমেন্টাল অ্যানালাইসিস’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন গত মাসে প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক। মূলত সেখানেই পরিবেশ দূষণ, স্বাস্থ্যঝুঁকি, অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয়টি তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি সিসার কারণে স্বাস্থ্যগত কী কী জটিলতা তৈরি হচ্ছে এবং তার অর্থনৈতিক মূল্যমানও তুলে আনা হয়েছে প্রতিবেদনে।  

বাংলাদেশে সিসার দূষণ একটি প্রধান পরিবেশগত স্বাস্থ্যঝুঁকি উল্লেখ করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ঝুঁকি শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক সবার ক্ষেত্রেই। বিষাক্ত এ ভারী ধাতু বেশ সহজলভ্য এবং হাজার বছর ধরে বিভিন্নভাবে ব্যবহারের ফলে তা পরিবেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন উপায়ে মানুষ এর সংস্পর্শে আসছে। এর মধ্যে সিসামিশ্রিত রঙ, সিসা পুনঃচক্রায়ন (রিসাইক্লিং), মাটি ও ধাতুর তৈজসপত্র, খাদ্য, শস্য, মসলা, ব্যাটারি অন্যতম। যদিও সিসার দূষণ উৎসগুলো এখনো সঠিকভাবে উন্মোচন করা যায়নি।

ভারী এ ধাতুটির বিষক্রিয়ার সবচেয়ে সাধারণ সূচক হলো রক্তে সিসার মাত্রা (বিএলএল)। বিশ্বব্যাংক বলছে, সিসার বিষক্রিয়ার ফলে দেশের প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশুরা নানা স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে। শুধু হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালির রোগেই ভুগছে বহু মানুষ। ২০১৯ সালে সিসার বিষক্রিয়ার কারণে দেশের মানুষের ৪০-৪৩ কোটিরও বেশি দিন অতিবাহিত হয়েছে কার্ডিওভাসকুলার অসুস্থতায়। মৃত্যুও হয়েছে অনেকের। কার্ডিওভাসকুলার ছাড়াও কিডনি রোগেও এ দূষণে ভুগছে বহু মানুষ। 

বিশ্বব্যাংকের জ্যেষ্ঠ পরিবেশ বিশেষজ্ঞ এবং প্রতিবেদনটির সহ-লেখক অ্যানা লুইসা গোমেজ লিমা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সিসার বিষক্রিয়ার কারণে গত দুই দশকে হৃদরোগ ও স্ট্রোক বেড়েছে বলে অনেক প্রমাণ পেয়েছে আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন। ফলে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের কারণে মানুষ অসুস্থ এবং শারীরিক অক্ষমতার সঙ্গে দিন অতিবাহিত করছে। বাংলাদেশের জন্য বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক কান্ট্রি এনভায়রনমেন্ট অ্যানালাইসিস অনুমান করেছে, সিসার বিষক্রিয়ায় সৃষ্ট হৃদরোগ ও স্ট্রোকের কারণে দেশটির মানুষ অসুস্থতা ও অক্ষমতা নিয়ে প্রতি বছর ৪০ কোটি ৩০ লাখ থেকে ৪৩ কোটি ১০ লাখ দিন অতিবাহিত করে। প্রতি বছর কমপক্ষে ৬০ হাজার মানুষ এ কারণে মারা যায়।’

দিনের এ হিসাব মূলত অক্ষমতা-সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবন বছর (ডালি) মান দিয়ে করা হয় বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ডালি হলো সামগ্রিক রোগের সংখ্যা ও অসুস্থতা বা বার্ডেন অব ডিজিজের একটি পরিমাপক। এর মাধ্যমে অসুস্থতা, সুস্থতা, শারীরিক অক্ষমতা এবং প্রাথমিক মৃত্যুর কারণে হারানো বছরের হিসাব করা হয়। অর্থাৎ যারা রোগে আক্রান্ত হয়েছে তারা গড় আয়ুর চেয়ে কত দিন আগে মারা গেছে, এর আগে কত দিন ধরে অসুস্থ ছিল এবং যারা অসুস্থ রয়েছেন তাদের অসুস্থতার দিনগুলোকে গণনা করা হয়। 

এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, ডালি পূর্ণ স্বাস্থ্যের এক বছরের সমতুল্য ক্ষতির প্রতিনিধিত্ব করে। একটি রোগ বা স্বাস্থ্যের অবস্থার জন্য ডালি হলো অকালমৃত্যুর কারণে হারিয়ে যাওয়া জীবনের বছর। আর জনসংখ্যার রোগ বা স্বাস্থ্যের অবস্থার প্রচলিত ঘটনাগুলোর কারণে একটি অক্ষমতাসহ জীবনযাপনের যোগফল।

জানতে চাইলে চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সিসার বিষক্রিয়া আমাদের রক্তনালিতে যায়, যা সারা দেহেই রয়েছে। ভারী এ ধাতু রক্তনালির অভ্যন্তরীণ আবরণকে ধ্বংস করে দেয়। আর রক্তনালি ক্ষতিগ্রস্ত হলে শুধু কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজই না বরং অনেক রোগ হতে পারে। নিঃশ্বাসের মাধ্যমে সিসা কণা শ্বাস-প্রশ্বাসে যেতে পারে, খাদ্যের মাধ্যমেও শরীরে যেতে পারে। যেভাবেই শরীরে প্রবেশ করুক না কেন রক্তে গিয়ে তা ক্ষতির কারণ হয়। বিশ্বব্যাংক অক্ষমতা-সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবন বছর দিয়ে ক্ষতির এ মাত্রাটি বুঝিয়েছে। যারা এ রোগে আক্রান্ত তারা স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকছে না কিংবা মৃত্যু হচ্ছে। অর্থাৎ জীবনমান বা কোয়ালিটি অব লাইফ ভালো থাকে না। তাদের দিনের যোগ ফলে ওই সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, দেশে সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব ধীরে ধীরে কমলেও বাড়ছে অসংক্রামক ব্যাধি। প্রতি বছর দেশে বিভিন্ন রোগে মারা যাওয়া রোগীদের মধ্যে অসংক্রামকের হার ৬৭ শতাংশ। সংখ্যায় তা পৌনে ছয় লাখ। তাদের মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যকই হৃদপিণ্ড ও রক্তনালির সমস্যাজনিত রোগী, ৩০ শতাংশ। এছাড়া ১২ শতাংশ ক্যান্সার, ১০ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদি শ্বসনতন্ত্রের রোগ, ৩ শতাংশ ডায়াবেটিস ও ১২ শতাংশ অন্যান্য অসংক্রামক রোগে মৃত্যু হয়। বাকিরা মারা যান সংক্রামক রোগ বা আহত হয়ে।

হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালির রোগে মৃত্যু ও স্বাস্থ্যঝুঁকির জন্য সিসার বিষক্রিয়া একটি নীরব ঘাতক, যা রক্তে পরিমাপ করা হয়। এ বিষয়ে ডব্লিউএইচও বলছে, সিসার বিষক্রিয়ায় শরীরে একাধিক জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে শিশু এবং শিশু জন্মদানের বয়সী নারী বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। ভারী এ ধাতু মস্তিষ্ক, লিভার, কিডনি ও হাড়গুলোয় ক্ষতি করে থাকে। গর্ভাবস্থায় হাড়ের মধ্যে ক্ষতিকর সিসা রক্তে নির্গত হয় ও বিকাশমান ভ্রূণের সংস্পর্শে আসে।  

রক্তনালির রোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারা দেহেই রয়েছে রক্তনালি। তবে মোটাদাগে হাতে, পায়ে ও ঘাড়ের রক্তনালিকে পেরিফেরাল ধমনি (আর্টারি) বলা হয়। দুর্ঘটনা বা অন্য কোনো আঘাতে এগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার চিকিৎসা ভাসকুলার সার্জনরা করে থাকেন। মস্তিষ্কের রক্তনালিকে বলা হয় সেরিব্রাল ধমনী। এর চিকিৎসা করেন নিউরো সার্জন ও ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজিস্ট। এছাড়া করোনারি ধমনী হচ্ছে হৃৎপিণ্ডের রক্তনালি। এসব ক্ষতিগ্রস্ত হলে কার্ডিয়াক সার্জান অস্ত্রোপচার করেন। এর বাইরে রেনালসহ বিভিন্ন ধমনি রয়েছে সারা দেহে। 

দেশে পরিবেশ দূষণের কারণে কার্ডিওভাসকুলার রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কার্ডিওভাসকুলার অ্যান্ড থোরাসিক অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের (বিএসিএটিএ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. এটিএম খলিলুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘উন্নত দেশগুলোয় দেখা যায় ষাটোর্ধ্বদের বেশি হৃদরোগ বা স্ট্রোক হয়। তবে বাংলাদেশে ৩০-৪০ বছরের রোগী এখন প্রচুর দেখা যায়। তাতে বোঝা যায় পরিবেশ দূষণ ও অস্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাসের কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এতে জীবনাচারও জড়িত।’

উচ্চ রক্তচাপের কারণে রক্তনালি ও হৃদরোগ হয়ে থাকে জানিয়ে ডা. এটিএম খলিলুর রহমান বলেন, ‘উচ্চ রক্তচাপ আগে অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে ছিল। তবে এখন শ্রমজীবী ও কৃষকের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে। তাতে বোঝা যায়, পরিবেশের দূষণ এসব রোগকে বাড়িয়ে তুলেছে। এখন হাসপাতালে আসা রোগীদের বেশির ভাগই শ্বাস-প্রশ্বাসের জটিলতা ও হৃদরোগ নিয়ে আসছে। আসলে আমাদের ঢাকা পৃথিবীর দূষিত নগরীর মধ্যে প্রথম সারিতে। ফলে কেউ চাইলেও দূষণের বাইরে থাকতে পারছেন না।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন