সিস্টিন চ্যাপেল সিলিং ও মাইকেলেঞ্জেলো

আহমেদ দীন রুমি

সিস্টিন চ্যাপেলের সিলিংয়ে মাইকেলেঞ্জেলোর দ্য লাস্ট জাজমেন্ট ও ডেলফি

পোপ চতুর্থ সিক্সটাসের সময়েই শেষ হয়েছিল সিস্টিন চ্যাপেলের কাজ। সেখানে ফ্রেস্কো সিরিজ তৈরি করেন রেনেসাঁ যুগের একদল চিত্রশিল্পী। সান্দ্রো বত্তিচেলি (১৪৪৫-১৫১০), পিয়েত্রো পেরুগিনি (১৪৫০-১৫২৩), পিনতুরিচ্চিও (১৪৫৪-১৫১৩), ডমিনিকো (১৪৪৮-১৪৯৪) এবং কজিমো রোসেলির (১৪৩৯-১৫০৭) মতো পুরোধা পুরুষরা। কিন্তু সেখানে মাইকেলেঞ্জেলোর স্পর্শ বাকি সবাইকে ছাপিয়ে গেল। পশ্চিমা চিত্রকলার ইতিহাসে তৈরি হলো নতুন গুরুত্বপূর্ণ বাঁক।

ফ্রেস্কো হলো এক ধরনের ম্যুরাল পেইন্টিং, যা ভেজা লাইম প্লাস্টারের ওপর অঙ্কন করা হয়। সিস্টিন চ্যাপেলের সিলিংয়ে ফ্রেস্কো কর্ম নিয়ে বৈপ্লবিক কিছু একটা করতে চাচ্ছিলেন ৷পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস (১৫০৩-১৫১৩)। ততদিনে মাইকেলেঞ্জেলো পরিচিত মুখ। ১৫০৪ সালে ডেভিড ভাস্কর্যের মাধ্যমে বাইবেলীয় বোঝাপড়ার প্রমাণ দিয়েছেন। তার এ বোঝাপড়া ও তাকে চিত্রিত করতে পারার ক্ষমতাকে কাজে লাগাতে চাইলেন দ্বিতীয় জুলিয়াস। কিন্তু মাইকেলেঞ্জেলো রাজি হলেন না। খুব সম্ভবত তার কারণ, আগের বার ‘দ্য ট্রাজেডি অব দ্য টম্ব’ করার সময়ে পোপের সঙ্গে তার অভিজ্ঞতা ভালো ছিল না। তবে পোপও সহজে হাল ছাড়ার পাত্র না। অবশেষে ঘটনা কূটনৈতিক দিকে গড়ালে মাইকেলেঞ্জেলো কাজ করতে সম্মত হন।৷ ১৫০৮ সালের মে মাসে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। টানা চার বছর সিস্টিন চ্যাপেলে কাজ করেছেন মাইকেলেঞ্জেলো, যা শেষ হয় ১৫১২ সালে।

চার বছরের মধ্যেই মানব ইতিহাসের রুহানি অভিযাত্রাকে নিপুণ হাতে ফুটিয়ে তুলেছেন মাইকেলেঞ্জেলো। ইতিহাস শুরু হয়েছে ‘ক্রিয়েশন অব অ্যাডাম’ থেকে এবং শেষ হয়েছে ‘দ্য লাস্ট জাজমেন্ট’ দিয়ে। পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে খ্রিস্টীয় বিশ্বাসে ব্যবহৃত রূপক। আঁকা হয়েছে ওল্ড টেস্টামেন্টের সাতজন নবী এবং পাঁচজন ভবিষ্যদ্বক্তাকে। খ্রিস্টিয় বিশ্বাস অনুসারে, তারা সবাই যিশুর আগমনের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। সাতজন নবী হলেন জোনাহ, দানিয়েল, ইসায়াহ, জাকারিয়া, জোয়েল জেরেমিয়াহ ও ইজিকিয়েল। আর পাঁচ ভবিষ্যদ্বক্তা হলেন ডেলফি, কুমি, লিবিয়া, পারসিয়া ও ইরিথ্রিয়া থেকে। 

জেনেসিসে বর্ণিত মানুষের সৃষ্টির মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে যাত্রা। ‘ক্রিয়েশন অব অ্যাডাম’-এ ঈশ্বরকে দেখানো হয়েছে বয়স্ক দাড়িওয়ালা পুরুষ হিসেবে। নিচে বাম দিকে আদমকে অঙ্কিত করা হয়েছে। ঈশ্বর ডান বাহু প্রসারিত করে নিজ আঙুল দিয়ে অ্যাডামকে জীবন দিচ্ছেন। আদম তার বাম হাত প্রসারিত করে ঈশ্বরের দেয়া জীবন নিচ্ছে। ১৫১১-১২-এর মধ্যে শেষ হওয়া এ শিল্পকর্ম এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বিখ্যাত ফ্রেস্কোচিত্র বলে ধরা হয়। সিস্টিন চ্যাপেলের চিত্রকর্মগুলো সিরিজ আকারে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশ করে। চ্যাপেলে কেউ প্রবেশ করলে প্রথম দফাতেই সামনে পড়বে মহাপ্লাবন, কুরবানি, আদম ও ইভের নিষিদ্ধ ফল খাওয়া এবং স্বর্গ থেকে পতন, ইভের সৃষ্টি, আদমের সৃষ্টি, সাগর থেকে ভূখণ্ডের পৃথক হওয়া, সূর্য, চন্দ্র ও গাছপালার সৃষ্টি এবং অন্ধকার থেকে আলোর আলাদা হওয়া। প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিপুণতার পরিচয় দিয়েছেন মাইকেলেঞ্জেলো। ফ্রেস্কো আঁকার সময় শিল্পীদের সতর্ক থাকতে হয়। কাজগুলোকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে নিতে হয়। এক্ষেত্রে সামান্য ভুল হওয়ার অর্থ নতুন করে কাজ শুরু করা ফ্রেস্কো কর্মে নুহ ও আদমের সম্পর্কের ওপর বিশেষভাবে জোরারোপ করা হয়েছে। দেখানো হয়েছে আশ্চর্যজনক মিল। দুজনের পরবর্তী প্রজন্মই যাত্রা শুরু করেছে প্রায় শূন্য থেকে।

চিত্রকর্মটি নিয়ে যে সমালোচনা হয়নি, তা নয়। সমালোচনার মূল জায়গাটা ছিল মূলত নগ্নতা নিয়ে। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে তার শিল্পীসত্তা। সিস্টিন চ্যাপেলকে চিত্রকলার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলকে পরিণত করেছে। আর মাইকেলেঞ্জেলোকে আসীন করেছে অনন্য উচ্চতায়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন