ফিলিস্তিনের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী মাইসারা বারোদ

‘আমাদের অভিধানে শুধু ধ্বংস ও বাস্তুচ্যুতি’

মাইসারা বারোদ

ফিলিস্তিনের চিত্রশিল্পী মাইসারা বারোদ। জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইতালি, রাশিয়া, কাতার, মিসর, কানাডা, তিউনিসিয়া, আবুধাবিসহ বিভিন্ন দেশে তার প্রদর্শনীর সংখ্যা পঞ্চাশের বেশি। সাদা ও কালো রঙ নিয়ে ক্যানভাসে তিনি মেলে ধরেন ফিলিস্তিনি জীবনের অভিজ্ঞতা। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা থেকে তিনি তার শিল্পকর্ম ও জীবনের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন বণিক বার্তার কাছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আহমেদ দীন রুমি

দুনিয়ার তাবৎ চোখ গাজার পরিস্থিতিতে। প্রথমেই জিজ্ঞাসা করি, আপনি আপনার পরিবার কেমন আছেন?

বর্তমান পরিস্থিতি গাজাকে যেন মাইক্রোস্কোপের নিচে ফেলে দিয়েছে। আশা করেছিলাম পরিস্থিতির অগ্রগতি হবে। প্রশান্ত স্থির হবে। সত্যি বলতে আমার অবস্থা গাজার আট-দশটা মানুষের চেয়ে ব্যতিক্রম নয়। রাতারাতি তারা গৃহহীন হয়ে পড়েছে। যতটা সম্ভব আমরা কেবল বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি। নিরাপদে থাকার চেষ্টা করছি। এখন ঘর হারিয়েছে, আছি দাইর আল বালা শহরে। কিছুদিন আগে যখন রাফায় হামলা হলো, তখনই শহরটি ছেড়ে আসি। দখলদার বাহিনী জানিয়েছিল জায়গাটা নিরাপদ। ফলে এখানেই উঠেছি। কিন্তু তাদের কথা সত্য নয়। মাঝে মাঝেই বোমা মিসাইলের শব্দ আতঙ্কিত করে তুলছে আমাদের। শহরে ঘোরাঘুরি করছে ট্যাংক। ফলে এখানে থাকাটা আর নিরাপদ নয়। এখন আমি গৃহহারা হয়ে দাইর আল বালায় অবস্থান করছি। গৃহহারার সংখ্যা বেড়েছে দশ গুণ। খুব অপ্রশস্ত একটা জায়গায় বসবাস করছি আমি আমার ২৫ সদস্য। এখানে না পানি আছে, না বিদ্যুৎ, না রান্না করার মতো জ্বালানি।

আপনার চিত্রকর্ম ধ্বংস, মৃত্যু বাস্তুহীনতার গল্প বলে। গল্পগুলোকে উপায়ে বলতে গিয়ে আপনি কেমন অনুভব করেন?

দুঃখজনকভাবে এখন আমাদের অভিধানে কেবল মৃত্যু, বাস্তুহীনতা আর ধ্বংসের গল্পই রয়েছে। বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন যার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে, তা বলার চেষ্টা করছি আমি। চেষ্টা করছি নিজের অভিজ্ঞতা বলার। এটা অফিশিয়াল সংস্করণ থেকে আলাদা। চেষ্টা করছি আমার চিত্রকর্মের মধ্যে মানুষের সেই পরিস্থিতিকে তুলে ধরতে, যা সাধারণত উপেক্ষা করা হচ্ছে। কিন্তু সেই গল্পের ভেতরে তো আর কয়েদির মতো আটকে থাকা সহজ নয়। আমি আশা করি, কয়েদজীবন শেষ হবে যুদ্ধের সমাপ্তির মধ্য দিয়ে। সরে যাবে হত্যা ধ্বংস করার মারণযন্ত্র।

আপনার চিত্রকর্মের অনুপ্রেরণা কী? কখন এটি শুরু হলো?

অনুপ্রেরণার উৎস হলো বাস্তবতা। ব্যক্তিগত জনপরিসরে আমাকে যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে, সেটাই অনুপ্রেরণা। আমার আগ্রহ কাজের জায়গা মোটাদাগে বলতে গেলে মানবতা। আরব বিশ্বে চলমান ঘটনাগুলোয় যারা চোখ রাখেন, তারা এর পরিস্থিতি নিয়ে সচেতন। যুদ্ধ, আটক, হত্যা, ধ্বংস বাস্তুচ্যুতি এখানে একটি সাধারণ ঘটনা। কিন্তু ফিলিস্তিনের জন্য একটা বিষয় ব্যতিক্রম। দখলদার বাহিনীর সামনে নির্যাতিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এখানে তালিকায় যুক্ত হয়েছে বৈষম্যমূলক প্রাচীর, জেরুজালেমের ইহুদীকরণ নীতি ফিলিস্তিনি পরিচয়কে মুছে ফেলার প্রচেষ্টা।

আমি বিশ্বাস করি, একজন শিল্পীকে তার চারপাশের ব্যাপারে ভালো পর্যবেক্ষক হতে হয়। সচেতনভাবে লক্ষ করলে খুব সহজেই আঁকার বিষয়বস্তু নির্বাচন করা যায়। দুঃখজনকভাবে আমার চারপাশটা এমন। প্রায় ৩০ বছর আগে থেকে আমি আঁকাআঁকি করে আসছি। সব কাজই মানবিক রাজনৈতিক বিষয়বস্তুকে ঘিরে। সিরিজ হিসেবে আঁকা হয়েছে হাজারো স্কেচ, যার প্রত্যেকটিই আলাদা থিমকে ধারণ করে। ছয়টি একক প্রদর্শনী হয়েছে। অংশগ্রহণ ছিল পঞ্চাশের বেশি প্রদর্শনীতে। প্রদর্শনীগুলো হয়েছে ফিলিস্তিন, ফ্রান্স, আমেরিকা, জাপান, ইতালি, রাশিয়া, কাতার, কায়রো, আলজেরিয়া, দুবাই, আবুধাবি, লেবানন, জর্ডান, তিউনিসিয়া, কুয়েত কানাডায়।

যুদ্ধবিধ্বস্ত স্থান থেকে জন্মভূমির মুখপাত্র হয়ে ওঠার সফরটা কেমন ছিল?

ইসরায়েলি হামলার দ্বিতীয় দিনেই আল রিমালে অবস্থিত আল ওয়াতান টাওয়ারে আমার অফিস বিধ্বস্ত হয়। হারিয়ে যায় আমার আমার বন্ধুদের চিত্রকর্ম। তৃতীয় দিনে বিধ্বস্ত হয়েছে আমার বাড়ি। সঙ্গে হারায় আমার ব্যক্তিগত স্টুডিওটাও। স্টুডিওটা ছিল আমার জন্য গত ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা কাজকর্মের সংগ্রহশালা। কেবল অনেক চিত্রকর্মই না, হারিয়ে ফেলেছি ছবি আঁকার বহু সরঞ্জাম, স্কেচ আর তিন হাজারের বেশি বইসমেত লাইব্রেরিটাও। আমার ছোট্ট দুনিয়া এবং তার সঙ্গে জড়িত সবকিছুই হারিয়ে ফেলেছি আমি। তবে সেটা আমাকে থামিয়ে দেয়নি। নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আপাতত দুঃখটাকে মুলতবি রাখতে। যা কিছু হারিয়েছে, তা হয়তো তুলনায় তেমন কিছু ছিল না। বরং এই যে আমার পরিবার, আমার স্ত্রী সন্তানেরা বেঁচে আছে; এটাই অনেক।

আমার একটা লক্ষ্যমাত্রা আছে। একটা বক্তব্য আছে, যা যেকোনোভাবে চিত্রকর্মের মাধ্যমে বলে যাবে। আমি আঘাত থেকে দ্রুত উঠে এসেছি। যুদ্ধের প্রথম দিনই শুরু করেছি আঁকতে। প্রথমে কিছু কাগজ পেনসিল দিয়ে শুরু করেছিলাম, পরে কলম পেয়েছি। কাগজের ওপর আমি নিজের বাস্তবতাকে তুলে ধরি। প্রতিবাদ জানাই দখলদারত্ব, অবরোধ, মারণযন্ত্র প্রতিবন্ধকতার। কাগজের মধ্যে মেলে ধরি নিজের আমার মতো অন্যদের কণ্ঠস্বর। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়া এবং ইন্টারনেট দুর্লভ হয়ে যাওয়ার কারণে বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে আমার তেমন কোনো যোগাযোগ নেই। ফলে এখন আমার যোগাযোগের মাধ্যম হলো ছবি আঁকা সম্ভব হলে প্রকাশ করা। এভাবেই আমি সবার কাছে খবর পৌঁছে দিতে চাই যেআমি এখনো জীবিত

আঁকার জন্য সাদা কালোকেই কেন নির্বাচন করলেন, তার কোনো ব্যাখ্যা আছে?

পর্যন্ত যত আঁকাআঁকি করেছি, তার প্রায় সবই সাদা কালো। আমি আসলে জানি না ঠিক কোন কারণে দুটি রঙকে অন্য সব রঙের চেয়ে আপন করে নিয়েছি। সম্ভবত আমি রঙের ব্যবহারকারী হিসেবে নিজের কাছে ব্যর্থ। সম্ভবত এটা দুটি রঙের বৈপরীত্যের কারণে। বৈপরীত্যকে আমি গোড়া থেকে এখন পর্যন্ত টেনে এনেছি। এই বৈপরীত্য হলো ভালো মন্দের মধ্যে, যুদ্ধ শান্তির মধ্যে। জয় পরাজয়ের মধ্যে। জীবন মৃত্যুর মধ্যে। কয়েদখানা স্বাধীনতার মধ্যে। অন্য সব বৈপরীত্যপূর্ণ শব্দকেও এর সঙ্গে যুক্ত করা যায়, যাদের আমি আমার আঁকাআঁকিতে তুলে ধরি।

আপনার চিত্রকর্ম ফিলিস্তিনি সাহিত্যকর্মের মতো। এক্ষেত্রে মাহমুদ দারউইশ, গাসসান কানাফানি কিংবা সামিহ আল কাসিমের সাহিত্যের প্রভাব আছে কি? নিজের চিত্রকর্ম নিয়ে আপনার বিশ্লেষণ কী?

আঁকাআঁকিতে আসার আগে আমি টুকিটাকি লিখতাম। পড়াশোনার অভ্যাসও ছিল যথেষ্ট ভালো। কোনো সন্দেহ নেই যে আমার পাটাতন গড়ে দেয়ার পেছনে দারউইশ, কানাফানি কাসিমের মতো লেখকদের ভূমিকা আছে। তারা তাদের মতো করে তাদের সময়ে কাজ করে গেছেন। ২০০৪ সালে ভেনিসে হওয়া আমার প্রথম প্রদর্শনীই ছিল তাদের ওপর ভিত্তি করেই। আমি তাদের সাহিত্যকর্মকে দৃশ্যচিত্রে রূপান্তর করেছি। সত্যি বলতে, ফিলিস্তিনি সাহিত্য ফিলিস্তিনি চিত্রকলা পাশাপাশি হাত ধরে এগিয়েছে প্রতিরোধের পথে। শুরু থেকেই তারা প্রতিরোধের গল্প বলাকে সততা নিষ্ঠার সঙ্গে নিয়েছিল।

গাজার শিল্পীদের অবস্থা কী? বর্তমান পরিস্থিতিকে কীভাবে মোকাবেলা করছেন?

গাজার চিত্রশিল্পীরা তো আসলে ফিলিস্তিনি সমাজের অংশ। গাজার সাধারণ মানুষ যা কিছুর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেখানকার চিত্রশিল্পীদের ভাগ্য এর চেয়ে আলাদা নয়। তাদের দুঃখ-দর্দশাও একই। আমি ভাগ্যবান যে যুদ্ধের প্রথম দিকেই বিপর্যস্ত হয়ে গেছি। আক্ষরিক অর্থেই সবকিছু হারিয়ে ফেলেছি তখন। এখানে যা আছে তার বাইরে আসলে আমার আর কিছু নেই। তবে দ্রুত সময়ের মধ্যে আঘাত কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছি। আঁকাআঁকি এক্ষেত্রে সাহায্য করেছে ধাক্কাটা সামলে উঠতে। যারাই কিছুটা কাটিয়ে উঠতে যাচ্ছে, তাদের নিজেদের মতো পরিকল্পনা আছে। নিজস্ব আইডিয়া বার্তা আছে, যা তার চোখে বাস্তবতাকে ধারণ করে। এখনকার পরিকল্পনাগুলো যুদ্ধ শেষে আলোর মুখ দেখুক আর না দেখুক, তারা সবাই কাজ নিয়ে আছে। আছে নিজেদের বাস্তবতা নিয়ে।

গাজা ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎকে কীভাবে আঁকছেন, কীভাবে তুলে ধরছেন আপনার পরবর্তী প্রজন্মের কথা?

আমাদের চারপাশে যে মারণযন্ত্র, তা ফিলিস্তিনের স্বপ্ন ভবিষ্যৎ দেখার সুযোগই দেয় না। যা করা যায়, তা হলো বাস্তবতার মধ্যে ঝাঁপ দেয়া। সোজা কথায় বলতে গেলে, মারণযন্ত্র কাউকে স্বপ্ন বোঝারই সুযোগ দেয় না। তার পরও আমরা একটা স্বাধীন ফিলিস্তিনের স্বপ্ন দেখি। এমন একটা দিনের স্বপ্ন দেখি, যখন এই হত্যা, নির্যাতন বাস্তুহীনতার সমাপ্তি ঘটবে। যুদ্ধ যখন শেষ হবে, তখন আমি কাঁদব। তাদের জন্য কাঁদব; যাদের হারিয়েছি, যা কিছু হারিয়েছি। যখন যুদ্ধ শেষ হবে, তখন হয়তো অপমানের বিনিময়ে আমাদের সান্ত্বনা দেয়া হবে। আমরা জীবন কাটাব, যেভাবে আগে অভ্যস্ত ছিলাম। আমি স্বপ্ন দেখব। খুঁজব একটা জীবন। খুঁজব আমার সন্তানদের জন্য নিরুপদ্রব ভবিষ্যৎ। যেখানে যুদ্ধ নেই, গ্লানি নেই, নেই দুর্ভোগ। চেষ্টা করব জীবনের ট্র্যাজিক অধ্যায় ভুলে যেতে। চেষ্টা করব সুন্দর কিছু স্মৃতি ধরে রাখতে- কিছু জায়গা, বন্ধু আত্মীয়-স্বজনের স্মৃতি। মানুষের স্মৃতি, যাদের অনেকেই হয়তো মারণযন্ত্রের আঘাতে হারিয়ে গেছেন। হারিয়ে গেছেন হত্যাকারীদের বহন করা ইস্পাতের পাখিগুলোর কাছে।

আপনার পক্ষ থেকে কোনো বার্তা আছে?

প্রতিটি যুদ্ধেরই সমাপ্তি আছে। যুদ্ধ তো সাময়িক অবস্থা, যা কোনো না কোনো দিন শেষ হবেই। আমরা জীবনকে ভালোবাসি। জীবনকে পেতে চেষ্টা করি মর্যাদার সঙ্গে। হতে পারে আমাদের বেদনার্ত ইতিহাস বিষাদগ্রস্ত বর্তমান। আমরা আবার তৈরি করব আমাদের। আমাদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকবে শেষ পর্যন্ত, তারা দায়িত্বটা পালন করবে। আমি বিশ্বাস করি, যুদ্ধ শেষ হবে দ্রুতই। আমরা ফিরে পাব হারিয়ে যাওয়া অধিকার। আমরা আমাদের শহর তার রাস্তাগুলো ফের নির্মাণ করব। সমুদ্র ফিরে পাবে তার নীল রঙ। পাখিরা ফিরে পাবে এমন জায়গা, যেখানে নিশ্চিন্তে বাসা তৈরি করা যায়। বিরামহীন মৃত্যুর ঘটনাপঞ্জি থেকে তা দূরে, অনেক দূরে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন