শিল্পের অন্তর্লীন আলাপ

ওয়াহিদ সুজন

এপিক জার্নি অব আ মাইগ্রেটরি বার্ড অব কৈলাস, রিদম অব নেচার-১

সোমেশ্বর অলির একটা কবিতা আছে ‘কিছুটা ওপর থেকে নিজেকে দেখতে / কীরকম লাগে / জানব না’। সৈয়দ গোলাম দস্তগীরের ‘এপিক জার্নি অব আ মাইগ্রেটরি বার্ড অব কৈলাস’ সিরিজের তিনটি পেইন্টিংয়ের দিকে তাকিয়ে সেই লাইন ক’টা মাথায় এল। কিছুটা ওপর ও পরিযায়ী পাখি। মানুষও এ দুনিয়ায় পরিযায়ী। তার দেখা দৃশ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। দেখা যথার্থ ইলুশনও বটে। কাগজের ওপর জলরঙে ফুটিয়ে তোলা পর্বত ও মেঘের বিন্যাস শুধু দৃশ্যই নয়; মেঘে ছড়ানো বর্ণিল আলোকচ্ছটা বা হঠাৎ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা দেবতাদের পর্বত স্রেফ পর্বত নয়—এ সবকিছু সমগ্রতার ভেতর সত্য হয়ে ওঠে যখন মানুষ তার ভেতরকার শক্তিটুকু খুঁজে পায়। বিশালতাকে ধারণ করার শক্তি। চিত্রকর্ম স্রেফ অনুলিপি তো নয়। মানসিক অবস্থা ও শরীরের জটিল সংশ্লেষণ।

আরেক বর্ষীয়ান শিল্পী রতন মজুমদারের তিনটি চিত্রকর্মের কথাই ধরা যাক। মিশ্রমাধ্যমে করা ‘স্যাম্বার আফটার আ ফাইট’ সিরিজ থেকে নেয়া। বৃহৎ ঘুড়ির ভেতর শুয়ে আছে ছোট ছোট ঘুড়ি। ত্রিমাত্রিক কোনো ইফেক্ট ছাড়াও আমাদের চোখ তাদের অবস্থান দ্রুতই আলাদা করে। সূক্ষ্ম ও মাপা মাপা জ্যামিতিক বিন্যাস ও বিন্দু মিলেছে। খালি চোখে বিন্দুর দৈর্ঘ্য-প্রস্থের মাপজোক নেই বটে। কিন্তু কীভাবেই না সব অস্তিত্ব বিন্দুতে ভাঙা যায়! এ চিত্রকর্মগুলো বলছে, দীর্ঘ লড়াই শেষে ঘুমের প্রস্তুতি। ঘুড়ি কোথায় ঘুমায়? অলির গানটাও মনে পড়ছিল, ‘ঘুড়ি তুমি কার আকাশে ওড়ো তার আকাশ কি আমার চেয়ে বড়!’ গ্যালারিসংশ্লিষ্ট একজনের কথা প্রসঙ্গে রতন মজুমদারের ব্যক্তিগত জীবন প্রসঙ্গে জানা গেল। ১৯৯৬ সালে আঁকা সিরিজটি হয়তো তারই প্রতিনিধি। কিন্তু একজন শিল্পী কোথায় ঘুমায় বা বিশ্রাম করে। ঠিক যেমন ঘুড়ি, তারও বিশ্রাম হয়তো অনন্ত আকাশে, তাকে কখনই মাটিতে মানায় না। ‘স্যাম্বার আফটার আ ফাইট’-এ প্রচুর রঙ আছে, তাকে ধারণ করেছে অজস্র বিন্দু। সবই জীবনের রঙ। আর আমরা যা পাই বা না পাই; তা-ই মিলে জীবন। হে প্রভু, শিল্পীর মনের খবর কে জানে। তিনিই আবার আমাদের জীবন আর আমাদের আত্মাকে বুঝতে সাহায্য করেন। আত্মগত অভিজ্ঞতা বিলীন হয় বিষয়গত উপলব্ধিতে।

জ্যেষ্ঠ শিল্পী সৈয়দ আবুল বারক আলভীর তিনটি এচিং, যার শিরোনাম কম্পোজিশন। নাটকীয়তা নেই। বাহুল্য নেই। হয়তো কম্পোজিশন নামে হাজার হাজার ছবি আছে। কিন্তু প্রতিটিই তো আলাদা। নির্বিশেষ নামের ভেতর বিশেষ বিশেষ ঘটনার বিবরণ। কালার টোন ও ডিজাইনের মধ্যে নিবিড় গাম্ভীর্য। খুব একটা ওভারল্যাপ না করে নানা ধরনের নকশা বা কাঠামোর উপস্থিতি আছে। আরামদায়কভাবে দেখার বিন্যাসকে ভেঙে দেন। আমাদের বোঝাপড়ার স্তরে বিস্ময় ও বর্ণিল যে জগৎ তার বাইরে ইন্দ্রিয়াতীত সরলতাকে তুলে ধরে। হয়তোবা। একই তলে নানা ধরনের আকৃতি ও ফিগার যূথতার ইঙ্গিত। একজন মানুষ যেমন শুধু একধরনের অনুভূতির নিবিড়তায় বসবাস করে না। একটা সমাজও তেমন নয়। এটা কি শিল্পীর অভিজ্ঞতার সঙ্গে অভিযোজন?

না, এভাবে হয়তো ধরে ধরে বলা সম্ভব নয়। এবং একজন লেখক তার অনুভূতিকে বিচ্ছিন্নভাবে ব্যাখ্যার ক্লান্তিকর যাত্রায় নাও নিতে পারেন। আমি যখন গ্যালারি কায়ার ‘বিহাইন্ড দ্য নাম্বার্স’ প্রদর্শনী দেখছিলাম, তখন নানাভাবে দেখা চিত্রগুলোকে পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে দেয়ার চেষ্টা করছিলাম। পরস্পরবিরোধী নানা ভাবনায় জর্জরিতই হচ্ছিল বোঝাপড়া। শিল্পী কতটাই বা দখল করে নেন দর্শকের মন। বোঝাপড়ার অন্তহীন ভ্রমণের ক্লান্তি থেকে মুক্তি মেলে না। এই যে দৃশ্য; যতটা আমরা দেখি, তার বেশির ভাগই তো দেখি না। ভাবনার যতটা ভাষা পায়, তার বেশি হয়তো অব্যক্ত থাকে এবং আমাদের ভাষাগত, ভাবগত অভ্যাস, সংস্কারের ভেতর তারা গতানুগতিক, সনাতনী ও ম্যাড়মেড়ে রূপ নিয়ে হাজির হয় বা অনূদিত হয়। এ ভাষাতেই বলছি এখন। অথবা আশরাফুল হাসানের ‘রিদম অব নেচার’ সিরিজের ‍তিনটি ইন্টাগ্লিও। প্রকৃতিতে মানুষ আর চারপাশের জগৎ যেভাবে একসঙ্গে মিশে গেছে, তাতে মূক হয়ে থাকাই প্রকৃত ভাষা! 

যখন একাধিক শিল্পী ও তাদের শিল্পকর্ম নিয়ে ভাবি, এভাবেও ভাবা সহজ, একই সময়ে বসবাস করলেও একেকজন মানুষের কাছে জীবনকে দেখা-বোঝা একেক রকম। আর প্রজন্ম ধরলে তার ধরন আরো বিস্তৃত হয়। প্রতিটি মানুষের দেখার এ স্বতন্ত্র রূপ; তবে এর সঙ্গে এমন এক দুনিয়া হাজির থাকে; যাকে মোটামুটি আমরা সবাই একইভাবে দেখি বলেই মনে হয়। এর ফারাক ও মিলের তুল্যমূল্য সহসা হয়ে ওঠে না। মিলের চেয়ে ফারাকটুকু বোঝা শিল্পের ক্ষেত্রে বেশি লাভজনক হয়তো, যা আমাদের যাপনকে সহজ করে। দেখার একহারা ভঙ্গি ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনায়াসলব্ধ চরমপন্থাকে ভেঙে দেয়। 

বিহাইন্ড দ্য নাম্বার্সে আছে ভিন্ন প্রজন্মের ২৭তম দৃশ্যশিল্পীর শিল্পকর্ম। বয়সের হিসাবে সবচেয়ে অগ্রগণ্য হামিদুজ্জামান খান, তার জন্ম ১৯৪৯ সালে। মাস দুয়েক আগে গ্যালারি কায়ায় হামিদুজ্জামানের ঢাকার চার নদীকেন্দ্রিক জলরঙের প্রদর্শনী হয়েছিল। এবার যৌথ প্রদর্শনীতে আছে ব্রোঞ্জে তৈরি চারটি ভাস্কর্য। এ প্রদর্শনী যেহেতু প্রজন্মের মেলবন্ধন, স্বভাবতই মাধ্যম ও চিত্রভাষ্যের বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। অনেকের প্রদর্শনীর ঠিকুজি কয়েক দশকের, আর কারো কারো ক্ষেত্রে কয়েক বছরের। মোট ৯৪টি শিল্পকর্ম জায়গা করে নিয়েছে কায়ার চারটি কক্ষে। যতটা সম্ভব বৈচিত্র্য ফুটে উঠেছে প্রদর্শনীতে। বাংলাদেশী চিত্রকর্মের একখণ্ড নমুনাও বলা যায়। আছে ব্রোঞ্জ, পিতল ও অ্যালুমিনিয়ামের ভাস্কর্য। সিরামিকের পাত্র, লিথোগ্রাফ, এচিং, ইন্টাগ্লিও, কাঠ খোদাইসহ বিভিন্ন মাধ্যমের ছাপচিত্র। কালি-কলমের রেখাচিত্র, জলরঙ, মিশ্রমাধ্যম ও অ্যাক্রিলিকের চিত্রকলা।

ওপরে কয়েকজন শিল্পীর নাম নিয়েছি। আরো কয়েকজনের নাম নিই। চন্দ্র শেখর দে, মনোজ দত্ত, রণজিৎ দাশ, আইভি জামান, অজিত শীল, পঙ্কজ পানওয়ার, গৌতম চক্রবর্তী, অখিল চন্দ্র দাশ, অতীন বসাক ও স্বরূপ বসাক। সময়ের নিরিখে একদম কম বয়সী—হাসুরা আক্তার রুমকির জন্ম ১৯৯৪ সালে ও ঋতুশ্রী দাসের ১৯৯৬ সালে। গ্যালারি কায়ার এ আয়োজনে দর্শকের চোখই শুধু শিল্পবস্তুর সঙ্গে কথা বলছে না; খোদ শিল্পই নিজের সঙ্গে নিজে সংলাপে বসেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন