স্মৃতির ছায়ায় অস্তিত্বের অনুসন্ধান

মো. বজলুর রশিদ শাওন

প্রদর্শনী উপভোগ করছেন এক দর্শনার্থী ছবি: কলাকেন্দ্র

জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ নিটশে তার On Truth and Lies in a Nonmoral Sense প্রবন্ধে লিখছেন, ‘মানুষ “ভ্রম” এবং স্বপ্নে নিমজ্জিত। কারণ চোখ কেবল “রূপ” শনাক্ত করে, কিন্তু সত্যের সন্ধান করে না।’ নিটশে “সত্য” প্রতিষ্ঠাকে সমাজের মধ্যে তৈরি একটি ‘শান্তি চুক্তি’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কারণ মানুষ প্রয়োজন অনুসারে এ সত্যের ধারণা তৈরি করে, যা মানুষের সীমাবদ্ধতা। অতএব, সমাজে যারা এ সীমাবদ্ধতাগুল মেনে চলে তারা ‘সত্য’ বলে, এবং যারা মেনে চলে না তারা ‘মিথ্যাবাদী’। নিটশে মনে করেন, জ্ঞানকাণ্ডের নামে শাসনের হাতিয়ার হিসেবে এই ‘শান্তি চুক্তি’-কে সমাজের অভ্যন্তরে ধ্বংস করা বা মিথ্যা প্রমাণ করা দুরূহ। কিন্তু শিল্পকলার মাধ্যমে তা কিছুটা হলেও সম্ভবপর হয়। অর্থাৎ শিল্পকলা ব্যক্তি মানুষকে সমাজের মধ্যে সেই সুযোগ দিয়েছে অথবা শিল্পীরা সেই সুযোগ তৈরি করে নিতে পারেন। তাহলে প্রশ্ন করা যেতে পারে, শিল্পকলা কি সর্বদাই সত্য নিয়ে হাজির হয়? হয়তো সবসময় হয় না বা সব শিল্পীর কাজে তা হাজির হয় না। এখানেই ব্যক্তি শিল্পী আর তার অন্বেষণের বিষয়বস্তু এবং সেটাকে কীভাবে হাজির করছেন তা মুখ্য হয়ে ওঠে। শিল্পী পলাশ ভট্টাচার্যের ‘অংশ বিশেষ’ শিরোনামে কলাকেন্দ্রে চলমান প্রদর্শনীটি ব্যক্তি শিল্পীর এ রকম অসংখ্য অনুভূতির সূচক (Index) নিয়ে হাজির হয়েছে আমাদের সামনে। যেখানে অসংখ্য প্রতীকের (Symbol) ব্যবহার করেছেন শিল্পী, কিন্তু প্রতিমা (Icon) হিসেবে সম্ভবত ব্যক্তি শিল্পীর ডিস্টোপিয়ান অনুভূতিগুলো হাজির হয়েছে নানাবিধ মাধ্যমের সমন্বয়ে। তীব্র আলোর বিপরীতে শিল্পী আছেন ছায়া আকারে, সেটা যেমন রূপক অর্থে তেমনি ব্যবহারিক বা বাহ্যত অর্থে। 

অন্ধকার কালো রঙের দেয়ালবেষ্টিত রুমে আলোকোজ্জ্বল আলোর ফটোগ্রাফ ঝুলছে। ঝুলছে নিয়ন আলোয় বাংলা, ইংরেজি লেখা, যা স্মৃতি ও স্বপ্ন বিজড়িত। পাশের রুমের আলো যেদিক থেকে আসছে সেদিকে বইয়ের পাতা উড়ছে আর তার শব্দ আসছে কানে। আবার সেটাই দেখা যাচ্ছে ভিডিওতে। হেলেদুলে মানুষের ছায়া স্ক্রিনের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাচ্ছে-আসছে। অথচ সবই অস্পষ্ট, ধূসর ও বর্ণনাতীত। দ্বিমাত্রিক পটের ড্রয়িংগুলোয় রঙের ব্যবহার থাকলেও সেখানে নির্দিষ্ট কোনো বর্ণনা নেই। অথচ সব শিল্পকর্ম যেনবা একই শূন্যতায় পর্যবসিত করতে চায় দর্শককে। শিল্পী তার প্রদর্শনীর ধারণাপত্রে লিখেছেন, ‘যা একেবারে অদেখা কিছু নয়, আবার দেখার ভিন্নতায় অদেখাকে দেখতে যাওয়ার একটা ইচ্ছার প্রকাশ এখানে করেছি। যে সময়টা কোনো স্থানের সীমার ভেতর আমাকে যেতে হয়, আমি আমার দেখার সেই জগৎটাকে অল্পই সেখানে দেখতে পাই। সেখানে হারিয়ে যাওয়া সময় বিক্ষিপ্তভাবে দেখা দেয় আবার বর্তমানটা খানিক পরে সেখানে যোগ হয়। সেই বিক্ষিপ্ত সময়গুলোর স্মৃতিতে অনেক বস্তু, অনেক ঘটনা আর অনেক তথ্যের সমন্বয় ঘটে, যেখানে তাৎক্ষণিক উল্লেখ করার মতো সুনির্দিষ্ট কোনো কিছু খুঁজে পাই না।’

চলমান সময়ের আর্থসামাজিক কিংবা রাজনৈতিক বাস্তবতার অভ্যন্তরে ব্যক্তিজীবনের অসহায়ত্ব দশাকে শিল্পী পলাশ ভট্টাচার্য তুলে নিয়ে এসেছেন অকপটে। যেখানে যাপনসংশ্লিষ্ট মিথ্যা প্রয়োজনের কাছে প্রতিনিয়ত হার মানতে থাকে জীবন। নিশ্চয়তার সন্ধানে সত্য-মিথ্যার ফারাক না জানা এক জনগোষ্ঠী, যারা উদযাপনের নেশায় মত্ত আর তার অভ্যন্তরে একজন ব্যক্তি মানুষের ওপর চেপে বসা অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু বোঝা। হয়তোবা সেগুলো তার একান্তই নিজের; যা তাকে স্মৃতি, স্থিতি ও কল্পনা হয়ে শিল্পকর্ম তৈরি করতে তাড়না দেয়। 

নিয়ন আলোয় লেখা ‘INSOMNI-LUCID Dream’ লেখাটাকে ইঙ্গিত হিসেবে দেখা যেতে পারে। যে ইঙ্গিতটা শিল্পী তার ধারণাপত্রেও দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘সমন্বিত স্মৃতি আর পার করা বর্তমানের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মিশ্র প্রতিক্রিয়ার কিছু টুকরো টুকরো ছায়া এখানে হাজির করেছি। যে স্থানে একটি পারিবারিক আবহে আমার দিন বদলায়, সেই আবহে কিছু ধারণা আমার কাছে ধরা দেয়। সেই ধারণা থেকে চেনা-জানা বস্তু আর ঘটনার সমন্বয়ে আলাদা ছায়া নিয়ে এসেছি। চেয়েছি বর্ণনার বাইরে গিয়ে ছায়াগুলোকে দেখার।’ এই যে বর্ণনার বাইরে গিয়ে ছায়াগুলোকে দেখতে চাওয়া, এটাই সম্ভবত শিল্পীর মূল আকাঙ্ক্ষা। কিউরেটর শর্মিলী রহমান লিখছেন এভাবে, ‘...Palash is seen to embody his past while engaging with his child and her toys, projecting the resurgence of the child like emotions toward an imagined future, conversely, envisioned through the lens of his lived experience and the concurrent premonitions of the unknown. Memory, dream, and nostalgia come into play in reconciling the disjointed “moment(s) of vision”, interfaced as it is with the subliminal.’ 

প্রথমত, আমরা স্মৃতির জগতে বাস করি, তারপর আসে ধারণা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধারণা বদলায় আর স্মৃতি প্রতিভাত হয় নতুন নতুন আঙ্গিকে। একই ঘটনাকে ভিন্নভাবে দেখতে শিখি, অভ্যস্ত হই কিন্তু থামতে পারি না। অনুভূতির স্তরে জমে নিত্যনতুন স্তর। তৈরি হয় হাজারো গল্প, যার বেশির ভাগই আমাদের অজানা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন