মকবুল ফিদা হুসেন, সালমান তুর ও অন্যরা

নিজাম আশ শামস

‘‌বুলস’। শিল্পী: মকবুল ফিদা হুসেন ছবি: সথবিজ

গত ২০ মার্চ একটি নিলামের আয়োজন করেছিল বিখ্যাত নিলাম প্রতিষ্ঠান সথবিজ। সেদিন নিউইয়র্কে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়ে দক্ষিণ এশিয়ার আধুনিক যুগের ও সমসাময়িক চিত্রশিল্পীদের চিত্রকর্ম নিলামে তোলা হয়েছিল। ‘বুলস’ শিরোনামের একটি চিত্রকর্ম ছিল নিলামের প্রধান আকর্ষণ। চিত্রকর্মটি ২৭ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ ডলারে বিক্রি হয়েছিল। বাংলাদেশী মুদ্রায় তা প্রায় ৩০ কোটি ৬০ লাখ ৭৫ হাজার টাকা (১ ডলার সমান ১১০ টাকা হিসাবে)। সে নিলামে সথবিজের মোট আয়ের ৪০ শতাংশ এসেছিল চিত্রকর্মটি থেকে। অথচ সথবিজ চিত্রকর্মটির আনুমানিক দাম নির্ধারণ করেছিল ১০-১৫ লাখ ডলার। তেলরঙে আঁকা চিত্রকর্মটির ওপরে ডান পাশে দেবনাগরী হরফে দেয়া আছে শিল্পীর স্বাক্ষর—‘হুসেন’। তা দেখে চিত্রকলা সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞানের অধিকারী কারোরই বুঝতে সমস্যা হয় না যে চিত্রকর্মটির কারিগর মকবুল ফিদা হুসেন। বিভিন্ন সময়ে নিলামে উঠেছে মকবুল ফিদা হুসেনের চিত্রকর্ম। ১৯৯৮ সাল থেকে হিসাব করলে ‘বুলস’ হলো এ পর্যন্ত তার সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হওয়া চিত্রকর্ম।

১৯১৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ভারতের মহারাষ্ট্রের এক সুলাইমানি বোহরা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মকবুল ফিদা হুসেন। তিনি দক্ষিণ এশিয়ার আধুনিক চিত্রকলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচিত। আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি পাওয়া ২০ শতকের ভারতীয় চিত্রশিল্পীদের মধ্যে তিনি অগ্রগণ্য। আন্তর্জাতিক মহলে তিনি ‘পিকাসো অব ইন্ডিয়া’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি পোস্ট-ইম্প্রেশনিজম, কিউবিজম ও এক্সপ্রেশনিজম শিল্প আন্দোলন দিয়ে প্রভাবিত ছিলেন। তার চিত্রকর্মগুলোয় এসব ঘরানার সমন্বিত রূপ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।

মকবুল ফিদা হুসেনের চিত্রকর্মে ভারতীয় পুরাণ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতীক থিম হিসেবে এসেছে। বিশেষ করে তার শিল্পসম্ভারের একটি শক্তিশালী মোটিফ হলো ঘোড়া। ভারতীয় চিত্রকলার ইতিহাসে ঘোড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। তাছাড়া ভারতীয় পুরাণে সূর্য জ্ঞান ও উর্বরতার প্রতীক। মকবুল ফিদা হুসেন এগুলোকেই বারবার তার চিত্রকর্মের বিষয় হিসেবে নির্বাচন করেছেন। তার ক্যানভাসে উপস্থাপিত প্রাণীগুলো শক্তিশালী, স্বাধীনচেতা ও সাহসী। ‘বুলস’ চিত্রকর্মের ষাঁড়টিতেও এসব বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। বিভিন্ন দেব-দেবীকেও নিজের মতো করে ক্যানভাসে উপস্থাপন করেছেন মকবুল ফিদা হুসেন। তার চিত্রকর্মে ইউরোপীয় আধুনিকতার প্রভাব থাকলেও আজীবন তিনি দক্ষিণ এশীয় শেকড়ের প্রতি দায়বদ্ধ ছিলেন। তিনি বলতেন, ‘আমি একজন ভারতীয় চিত্রশিল্পী। শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত আমি তা-ই থাকব।’ ২০১১ সালের ৯ জুন দক্ষিণ এশীয় আধুনিক চিত্রকলার এ পুরোধা ব্যক্তিত্বের জীবনাবসান ঘটে।

আধুনিককালে ভারতীয় চিত্রকলার আরেক উল্লেখযোগ্য চিত্রশিল্পী নাসরিন মোহামেদি। তার একটি বিখ্যাত চিত্রকর্মের নাম ‘আনটাইটেলড’। ২০২০ সালে সথবিজ নিউইয়র্ক আয়োজিত এক নিলামে চিত্রকর্মটি ৪ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ ডলারে বিক্রি হয়েছিল। বাংলাদেশী মুদ্রায় তা প্রায় ৪ কোটি ৮১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। ২০০৬ সাল থেকে পাওয়া হিসাব অনুযায়ী এটিই এখন পর্যন্ত তার সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হওয়া চিত্রকর্ম। ‘আনটাইটেলড’ তেলরঙে আঁকা বিমূর্ত চিত্রকর্ম।

নাসরিন মোহামেদি ১৯৩৭ সালে করাচিতে সম্ভ্রান্ত তায়েবজি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাকে ভারতে ‘মিনিমালিস্ট অ্যাবস্ট্রাক্ট’ ঘরানার চিত্রশিল্পের অগ্রদূত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ শতকের বিখ্যাত ভারতীয় চিত্রশিল্পী বাসুদেও গায়টোন্ডের কাজ এক্ষেত্রে তাকে প্রভাবিত করেছিল। গায়টোন্ডে তখন বিমূর্ত চিত্রকলার এক বিশেষ রূপ তৈরিতে মনোযোগী ছিলেন। এর নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘নন অবজেক্টিভ’। নাসরিন মোহামেদির ‘আনটাইটেলড’ শিরোনামের চিত্রকর্মটি এ ঘরানার একটি চমৎকার উদাহরণ। ভারতীয় চিত্রশিল্পীদের মধ্যে এ পর্যন্ত বাসুদেও গায়টোন্ডের চিত্রকর্ম সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হয়েছে। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মুম্বাইয়ের পুন্ডোলস অকশন হাউজ আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক নিলামে তার একটি চিত্রকর্ম ৪২ কোটি রুপিতে বিক্রি হয়েছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় তা প্রায় ৫৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকা (১ রুপি সমান ১ দশমিক ৩২ টাকা হিসাবে)। শিরোনামহীন বিমূর্ত চিত্রকর্মটি গায়টোন্ডে এঁকেছিলেন ১৯৬৯ সালে। বাসুদেও গায়টোন্ডের জন্ম ১৯২৪ সালের ২ নভেম্বর ভারতের নাগপুরে। ২০০১ সালের ১০ আগস্ট দিল্লিতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। গায়টোন্ডের মতো নাসরিন মোহামেদিও জেন ভাবাদর্শ, অধ্যাত্মবাদ ও নন-প্ল্যাটোনিক চিন্তায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন। যদিও গায়টোন্ডের সঙ্গে তার কাজের উল্লেখযোগ্য পার্থক্যও আছে। গায়টোন্ডের কাছে রঙ ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর নাসরিন মোহামেদি রেখাকে অধিক গুরুত্ব দিতেন।

নাসরিন মোহামেদির বিমূর্ত চিত্রকর্মে পশ্চিমা মিনিমালিজম ও ইসলামী শিল্পবোধের সমন্বয় ঘটেছে। ব্যক্তিগত উপলব্ধি, শূন্যতাবোধ, অসারতার অনুভূতিসহ যাবতীয় অন্তর্গত জিজ্ঞাসার উপস্থাপন ঘটেছে তার ক্যানভাসে। ১৯৯০ সালে ভারতের মহারাষ্ট্রের কিহিম নামের একটি গ্রামে নাসরিন মোহামেদি মৃত্যুবরণ করেন।

ওপরে বর্ণিত তিন চিত্রশিল্পী দক্ষিণ এশীয় চিত্রকলার আধুনিককালের প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের আলোচনায় হাজির হয়েছেন। তারা তিনজনই প্রয়াত। এবার এ অঞ্চলের সমসাময়িক জীবিত চিত্রশিল্পীদের কাজের দিকে একটু নজর দেয়া যাক। এক্ষেত্রে প্রথমেই রানা বেগমের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। লন্ডনের অধিবাসী এ চিত্রশিল্পী ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশের সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ‘মিনিমালিস্ট অ্যাবস্ট্রাক্ট’ ঘরানার চিত্রশিল্পী। তার চিত্রকর্মে নাগরিক প্রকৃতি, ইসলামী চিত্রকলা ও স্থাপত্যের জ্যামিতিক নকশা ফুটে উঠেছে। গত ২৮-২৯ জুন নিলাম প্রতিষ্ঠান স্যাফ্রনআর্ট মুম্বাই আয়োজিত এক নিলামে তার একটি চিত্রকর্ম ৪৪ হাজার ১৭২ ডলারে বিক্রি হয়েছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় তা প্রায় ৪৮ লাখ ৫৮ হাজার ৯২০ টাকা। বিমূর্ত এ চিত্রকর্মের শিরোনাম ‘নম্বর ৪৯৪’। 

বর্তমান সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার আলোচিত চিত্রশিল্পী আলী কাজিমের জন্ম ১৯৭৯ সালে, পাকিস্তানে। ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবর সথবিজের লন্ডন কার্যালয়ে আয়োজিত এক নিলামে আলী কাজিমের একটি চিত্রকর্ম ২৮ হাজার ৯০৬ ডলারে বিক্রি হয়েছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় তা প্রায় ৩১ লাখ ৭৯ হাজার ৬৬০ টাকা। এখন পর্যন্ত তার সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হওয়া এ চিত্রকর্মের শিরোনাম ‘স্লিপ থ্রি’। আলী কাজিমের চিত্রকর্মে পরিত্যক্ত জনপদের দৃশ্য ও নিঃসঙ্গ মানুষের প্রতিকৃতি ফুটে উঠেছে। তিনি প্রতিটি বিষয়ের অন্তর্গত সৌন্দর্যকে তুলে ধরার চেষ্টা করেন।

সালমান তুরের জন্মও পাকিস্তানে, ১৯৮৩ সালে। বাস করেন নিউইয়র্কে। তার চিত্রকর্মগুলোয় সমসাময়িক নাগরিক জীবনের নানা অনুষঙ্গ ধরা পড়েছে। তার একটি বিখ্যাত চিত্রকর্মের নাম ‘ফোর ফ্রেন্ডস’। ২০১৯ সালে আঁকা চিত্রকর্মটি ২০২২ সালের ১৭ নভেম্বর নিলামে তুলেছিল সথবিজ নিউইয়র্ক। নিলামে চিত্রকর্মটি ১৫ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ ডলারে বিক্রি হয়েছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় তা প্রায় ১৭ কোটি ১৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। এটিই এখন পর্যন্ত তার সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হওয়া চিত্রকর্ম।

দক্ষিণ এশিয়ার সমসাময়িক চিত্রশিল্পীদের মধ্যে আজিজ হাজারা, আলিয়ানা জাইদি, মরিয়ম লামেই, সুলেমান আকিল খিলজি ও সোফিয়া বালাগামওয়ালার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আজিজ হাজারার জন্ম ১৯৯২ সালে, আফগানিস্তানের ওয়ারদাক প্রদেশে। তিনি হাজারা আদিবাসী গোষ্ঠীর সদস্য। হাজারাদের ওপর চালানো গণহত্যা তার চিত্রকর্মকে প্রভাবিত করেছে। চিত্রকর্মে যুদ্ধ ও শান্তি, বাস্তবতা ও কল্পনাসহ নানা ডিকোটমি হাজির করেছেন তিনি। লন্ডনে বাস করা ভারতীয় চিত্রশিল্পী আলিয়ানা জাইদির চিত্রকর্মে সংস্কৃতি, স্মৃতি ও কল্পনার সুষম সংমিশ্রণ ঘটেছে। মরিয়ম লামেইর চিত্রকর্মের উল্লেখযোগ্য মোটিফ হলো ‘গুল ও মুর্গ’ তথা ফুল ও পাখি। লাহোরে বাস করা চিত্রশিল্পী সুলেমান আকিল খিলজির চিত্রকর্মে প্রকাশ পেয়েছে বিচ্ছেদ ও অনিত্যতার ধারণা। আর করাচির অধিবাসী চিত্রশিল্পী সোফিয়া বালাগামওয়ালা ইতিহাস ও কল্পনার মিশেলে তৈরি করেছেন তার চিত্রকর্ম।

দক্ষিণ এশীয় চিত্রকলার ইতিহাস বেশ প্রাচীন। তারই ধারাবাহিকতায় এ ভৌগোলিক অঞ্চলের আধুনিককালের ও সমসাময়িক চিত্রশিল্পীরাও নিজেদের কাজ দিয়ে চিত্রকলার দর্শক, সমালোচক ও বোদ্ধাদের কাছে প্রশংসিত হয়েছেন। পেয়েছেন দুনিয়াজোড়া খ্যাতি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন