নতুন আঙ্গিকে সুকুমার রায়ের সৃষ্টিকর্ম

নিজাম আশ শামস

‘চিত্রগুলোর কোনোটিতেই পেনের একটি দাগও নেই। প্রতিটি চিত্রই আমি সম্পূর্ণ ব্রাশ দিয়ে এঁকেছি।’

গ্যালারির দরজা ঠেলে ঢুকতেই দেখা হয়ে গেল শিল্পীর সঙ্গে। জয়নুল গ্যালারির মনোরম পরিবেশে জমে উঠল উষ্ণ আলাপচারিতা। প্রদর্শনীর ছবিগুলো নিয়ে উপরের মন্তব্যটি দিয়েই আলাপ শুরু করেন তিনি। আরো বলেন, ‘সুকুমার রায়ের শততম জন্মবার্ষিকীতে আমি ১০০টি ছবি আঁকতে পারতাম। কিন্তু আমি কাজের সংখ্যার দিকে মনোযোগ দিইনি। গুণগত মানকে প্রাধান্য দিয়েছি।’

সুকুমার রায়ের শততম মৃত্যুবার্ষিকীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ‘জয়নুল গ্যালারি’তে চলছে শিল্পী অনিন্দ্য কান্তি বিশ্বাসের একক চিত্রপ্রদর্শনী। একক না বলে বোধহয় যৌথ বলাই ভালো। তাহলে আরেকজন কে? এ প্রশ্নের উত্তরেই বোঝা যাবে প্রদর্শনীটির স্বাতন্ত্র্য। আরেকজন সুকুমার রায়। প্রতিভাবান ও প্রথিতযশা মানুষটির নাম শোনেননি, এমন কোনো বাঙালি বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। শিল্পীর ভাষায় সুকুমার রায় হলেন, ‘বাংলা তথা ভারতবর্ষের তথা বর্তমান বিশ্বের বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব’। সুকুমার রায়ের ছড়া, কবিতা, গল্প, নাটক ও চিত্রকর্মকে আধেয় করে ছবিগুলো এঁকেছেন শিল্পী অনিন্দ্য কান্তি বিশ্বাস। প্রতিটি ক্যানভাসে অনিন্দ্যের আঁকা রঙিন ছবির পাশাপাশি দেখা যায় সুকুমার রায়ের আঁকা সাদাকালো ছবি। ক্যানভাসে তাই সুকুমার রায় ও অনিন্দ্য কান্তি বিশ্বাস দুজনেরই স্বাক্ষর আছে। উদাহরণ হিসেবে ‘কাঠ-বুড়ো’ ও ‘গানের গুঁতো’ চিত্রকর্ম দুটোর কথা বলা যায়। একই ক্যানভাসে ওপরে সুকুমার রায়ের ছবি, নিচে একই বিষয়ে শিল্পীর নিজস্ব অনুভূতি ও উপলব্ধির উপস্থাপন। এ প্রসঙ্গে শিল্পী বলেন, ‘সুকুমার রায় তার কোনো রঙিন ছবি দেখে যেতে পারেননি। আমি তার চিত্রকর্মগুলোকে নিজের মতো করে রাঙিয়েছি। তিনি আজ বেঁচে থাকলে বোধহয় এভাবেই ভাবতেন।’ কয়েকটি ক্যানভাসে সুকুমার রায়ের আঁকা কোনো ছবি নেই। অর্থাৎ, সে বিষয়ে তিনি কোনো ছবি আঁকেননি। সেখানে শিল্পী তার আঁকা ছবির পাশাপাশি সুকুমার রায়কে এঁকেছেন। তিনি বলেন, ‘এসব ক্যানভাসে আমি সুকুমার রায়কে এমনভাবে উপস্থাপন করেছি, মনে হবে তিনি আমার আঁকা ছবিগুলো দেখছেন।’ তেমনই একটি ক্যানভাসে সুকুমার রায়ের পাশে তুলির আঁচড়ে লেখা আছে, ‘আসিয়াছি ছাড়ি মহীতল/শতবর্ষ আগে/নবীনের তুলির টানে/অতীতের স্মৃতি জাগে’। পঙ্‌ক্তিগুলো শিল্পীর নিজেরই লেখা। প্রদর্শনীর মূলভাব বোঝার জন্য তা যথেষ্ট।

গ্যালারির দেয়ালে সারি সারি চিত্রকর্ম। ‘বিজ্ঞান শিক্ষা’, ‘বোম্বাগড়ের রাজা’, ‘কি মুস্কিল’, ‘আবোল তাবোল’, ‘একুশে আইন’, ‘গোঁফচুরি’, ‘জালা-কুজো সংবাদ’, ‘হাত গণনা’, ‘ভয় পেয়ো না’, ‘ডানপিটে’, ‘কাঠ-বুড়ো’, ‘গানের গুঁতো’, ‘হুলোর গান’, ‘সৎপাত্র’, ‘শ্রীকাক্কেশ্বর কুচকুচে’, ‘পালোয়ান’, ‘কাতুকুতু বুড়ো’, ‘রাম গরুড়ের ছানা’, ‘খাই খাই’ শিরোনামগুলোই ছবি সম্পর্কে বার্তা দিচ্ছে। শিরোনাম থেকেই পরিষ্কার সুকুমার রায়ের লেখা ছড়া, কবিতা, গল্প ও নাটকের বিভিন্ন থিমকে ধরেই ছবিগুলো এঁকেছেন শিল্পী। অনেক ছবির কোনো শিরোনাম নেই। পরিবর্তে আছে সুকুমার রায়ের ছড়ার পঙ্‌ক্তি কিংবা নাটকের উদ্ধৃতি। একটি ক্যানভাসে লেখা আছে ‘দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম! দেড়ে দেড়ে দেড়ে!’ সুকুমার রায়ের বিখ্যাত ‘দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম’ কবিতার শেষ পঙ্‌ক্তি। প্রদর্শনীতে ঠাঁই পাওয়া ‘জালা-কুজো সংবাদ’ ছবিটি প্রসঙ্গে শিল্পী অনিন্দ্য কান্তি বিশ্বাস বলেন, ‘এটি সুকুমার রায়ের “জালা-কুজো সংবাদ” কবিতার থিমের ওপর এঁকেছি। এটি নিয়ে তিনি কোনো ছবি আঁকেননি। কবিতাটি পড়ে আমার একান্ত উপলব্ধি থেকে ছবিটি এঁকেছি।’ প্রতিটি ছবিই চোখকে প্রীত করে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে দর্শকের চোখকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করবে গ্যালারির দেয়ালে ঝোলানো শিল্পীর আঁকা সুকুমার রায়ের একটি পোর্ট্রেট। এটি নিয়ে শিল্পী নিজেও প্রবল উচ্ছ্বসিত। এ পোর্ট্রেট সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি খ্যাতনামা শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজের নাম নেন। রামকিঙ্কর বেইজকে তিনি ‘গুরু’ হিসেবে সম্বোধন করেন। শিল্পী বলেন, ‘অনেকেই বলতে পারেন যে এটি সুকুমার রায়ের পোর্ট্রেট হয়নি। কিন্তু হুবহু সুকুমার রায়কে আঁকা আমার উদ্দেশ্য ছিল না। বরং আমি তাকে যেভাবে অনুভব করেছি, সেভাবেই আঁকার চেষ্টা করেছি।’ এক্ষেত্রে রামকিঙ্কর বেইজ তার অনুপ্রেরণা বলে জানান শিল্পী। তিনি বলেন, ‘রামকিঙ্কর বেইজ কখনো মডেল সামনে রেখে ছবি আঁকতেন না। প্রয়োজনে একটু দেখে নিতেন। কিন্তু পোর্ট্রেটটি আঁকতেন একেবারে নিজের মতো করে।’ রামকিঙ্কর বেইজকে নিয়ে ৩২ বছর ধরে গবেষণা করছেন বলে জানান তিনি।

সুকুমার রায়কে নিয়ে এমন ব্যতিক্রমী কাজের অনুপ্রেরণা কোথা থেকে পেলেন? এ প্রশ্নের উত্তরে শিল্পী অনিন্দ্য কান্তি বিশ্বাস তার শিক্ষক কৃষ্ণানন্দ গুপ্তের নাম বলেন। তিনিই তাকে সুকুমার রায়ের শততম মৃত্যুবার্ষিকীতে এমন একটি কাজ করার আইডিয়া দিয়েছিলেন। আইডিয়াটি মাথায় ঢুকে যায় তার। এ কাজের জন্য একেবারে ঘোরগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তার ভাষায়, ‘দুই মাস ধরে প্রতিদিন মাত্র চার ঘণ্টা করে ঘুমিয়ে ছবিগুলো এঁকেছি আমি।’ জানালেন ব্যক্তিগত অতৃপ্তির কিছু কথাও। বহু আগেই প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রির পাট চুকালেও এখন পর্যন্ত সমগ্র ভারতবর্ষে তার কোনো ফুলটাইম চাকরি জোটেনি। ছয় মাস ধরে এক পয়সাও উপার্জন নেই তার। তা নিয়ে শিল্পীর সমস্যা থাকলেও কাজের সঙ্গে কোনো আপস করেননি। এ কাজের জন্য অনেক নির্ঘুম রাত বিনিয়োগ করেছেন শিল্পী অনিন্দ্য কান্তি বিশ্বাস। অর্থাভাবে থাকলেও বিষয়টিকে নিজের শিল্পীসত্তার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে দেননি। তাই এ প্রদর্শনীকে ঘিরে রয়েছে তার অন্যরকম আবেগ। ছবিগুলো যে তিনি বেশ যত্ন ও দরদ নিয়ে এঁকেছেন, ক্যানভাসে তার ছাপ স্পষ্ট। বাংলাদেশের প্রখ্যাত ইতিহাস গবেষক হাশেম সূফীর মন্তব্যে যেন তারই প্রতিধ্বনি, ‘ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র বিখ্যাত সুকুমার রায়কে দেখিনি। শিল্পী অনিন্দ্য কান্তি বিশ্বাসের প্রদর্শনীর মাধ্যমে সুকুমার রায়কে পেলাম। প্রশংসনীয়।’ এখানেই তো শিল্পীর সার্থকতা। তার আঁকা ছবির মাধ্যমে সুকুমার রায়কে নতুন আঙ্গিকে দেখার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে। নিজের এ কাজকে তিনি তাই ‘সুকুমার রায় রিভিজিটেড’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

শিল্পী অনিন্দ্য কান্তি বিশ্বাসের কাজগুলো দেখলে বোঝা যায় সুকুমার রায়কে তিনি হৃদয়ে ধারণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘সুকুমার রায় হওয়া যায় না, সুকুমার রায় জন্মান।’ মাত্র ৩৬ বছরের জীবনে যে কীর্তি তিনি গড়েছেন, তা শিল্পীকে অভিভূত করেছে। তাই তিনি নির্দ্বিধায় বলতে পারেন, ‘সুকুমার রায় যদি ১০০ শতাংশ হন, সত্যজিৎ রায় তবে ১ শতাংশ।’ তবে এ কথা তার ধৃষ্টতা নয়। বিনয়ের সঙ্গে তিনি জানান, সত্যজিৎ রায়কে ছোট করার জন্য নয়, বরং সুকুমার রায়ের গভীরতা ও গুরুত্ব বোঝানোর জন্যই তার এমন কোনো উক্তি। তার মতে, আমাদের সুস্থতার প্রয়োজনে সুকুমার রায়কে প্রয়োজন। তিনি বলেন, ‘একবিংশ শতকে আমাদের সুকুমার রায়কে খুবই প্রয়োজন। বিশেষ করে আমাদের সুস্থ থাকবার প্রয়োজনে। ভীষণভাবে আশ্চর্যান্বিত হই যখন দেখি ক্রমশ আমরা হাসতে ভুলে যাচ্ছি। দিনের পর দিন ধরে। রসিকতা তো একপ্রকার উধাও।’

শিল্পী অনিন্দ্য কান্তি বিশ্বাসের শিল্পের সঙ্গে পরিচয় শৈশবেই। পরিবারে সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে উঠেছেন তিনি। রবীন্দ্রভারতী, শান্তিনিকেতন হয়ে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আর্টস অ্যান্ড অ্যাস্থেটিকস’ বিভাগ। সেখান থেকে বরোদা। বর্তমান আবাস  দিল্লিতে। তার শিল্পের সফর চলমান। সমানে চলছে লেখালেখিও। বাংলাদেশে এটিই তার প্রথম প্রদর্শনী। তা সাধারণ দর্শক ও শিল্পবোদ্ধাদের আনন্দ দেবে বলে আশাবাদী তিনি। ও হ্যাঁ। সুকুমার রায়ের সঙ্গে তার আরেকটি মিল আছে। দুজনেরই পূর্বপুরুষের ভিটা বাংলাদেশে। প্রথমজন কিশোরগঞ্জ, পরের জন যশোরের।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন