ঢাকার নায়েব নাজিমদের আমলে ঈদ ও মহররম মিছিলের চিত্রকলা

নাজমা খান মজলিস

১৮-১৯ শতকে ঢাকায় মহররমের মিছিলের চিত্র ছবি: হিস্টরিক্যাল পেইন্টিংস, নাজমা খান মজলিস, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, ২০১৮

ঈদ মহররম মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ দুটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান। ১৮-১৯ শতকে বর্তমান বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় (আগে জাহাঙ্গীরনগর নামে পরিচিত ছিল) ঈদ মহররম উপলক্ষে যে শোভাযাত্রা হতো তার ৩৯টি জলরঙে আঁকা চিত্র (১৮×১৪ ইঞ্চি) বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে, যা তৎকালীন সময়ে হাতে তৈরি কাগজের ওপর চিত্রিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। সেগুলো জনাব আবুল হাসনাতের ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল। তিনি চিত্রকর্মগুলো ঢাকা জাদুঘরে (বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর) প্রদান করেন। মোগল সম্রাটরা মূলত সুন্নি সম্প্রদায়ের অন্তর্গত হলেও ঢাকায় শিয়া সম্প্রদায়ের আগমন ঘটেছিল সম্রাট শাহজাহানের আমলে। তারই ধারাবাহিকতায় শিয়া সম্প্রদায়ের নায়েব নাজিমরা ঢাকায় ঈদ মহররম মিছিলের সূচনা করেন। ঢাকার ঈদ মহররমের চিত্রগুলো কার পৃষ্ঠপোষকতায় চিত্রিত হয়েছিল তার সঠিক হদিস পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হয়, চিত্রগুলো তৎকালীন ঢাকার নায়েব নাজিম নসরত জ্যাংয়ের (১৭৯৬-১৮২৩ খ্রি) ফরমায়েশে চিত্রিত হয়েছিল। নসরত জ্যাংয়ের সমসাময়িক ঢাকার কালেক্টর স্যার চালর্স ডি-অয়েলির মন্তব্য থেকে কথা প্রমাণিত হয়। চালর্স ডি-অয়েলি তার Antiquities of Dacca গ্রন্থে নসরত জ্যাং সম্বন্ধে কিছু মন্তব্য করেছেন, ‘He (Nusrat Jung) resides at Dacca in palace very splendidly ornamented in the oriental manner and his audience chamber is so crowded with English prints and paintings that not an inch of the wall can be seen’ এছাড়া ডি-অয়েলি শিল্পমনা নবাবকে ‘Interior of Dacca City’ নামক একটি ড্রয়িং উৎসর্গ করেন, যাতে লেখা ছিল ‘Inscribe with profound respect to his Highness Nusrat Jung Nabob of Dacca’ থেকেই বোঝা যায় যে নবাব নুসরাত জ্যাং একজন শিল্পরসিক শিল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।

শিল্পী

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে যে ৩৯টি ঈদ মহররমের চিত্র সংরক্ষিত রয়েছে সেসব চিত্র তৎকালীন সময়ে পুরো শোভাযাত্রাটির নিখুঁত একটি প্যানারমিক দৃশ্যপট উপস্থাপনের জন্য চার-পাঁচটি হাতে তৈরি কাগজের ওপর খণ্ডচিত্র করে একটি পূর্ণাঙ্গ দৃশ্য তৈরি করা হতো, যার কোনোটিতেই শিল্পীর স্বাক্ষর তারিখ উল্লেখ নেই। তবে একটি চিত্রের পেছনেআলম মুসাব্বির নাম উল্লেখ রয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, মুসাব্বির একটি আরবি শব্দ, যার অর্থশিল্পী সুতরাং এটা ধারণা করা যায় যে শিল্পীর নাম আলম এবং উপাধি হিসেবে মুসাব্বির ব্যবহৃত হয়েছিল। মোগল-পূর্ব মোগল আমলে সুলতান সম্রাটরা শিল্পীদের বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করতেন।মুসাব্বির তার মধ্যে একটি। আবারআলম মুসাব্বির শিল্পীর পুরো নামও হতে পারে বলে ধারণা করা যেতে পারে। কারণ শুধু নামটি ছাড়া এর পেছনের সঠিক কোনো তথ্য বা প্রমাণ নেই।

চিত্রায়ণের শৈলী

জাতীয় জাদুঘরে ৩৯টি ঈদ মহররমের চিত্রের চিত্রায়ণ কৌশলে ভিন্নতা দেখা যায়। যেমন মোগলশৈলী ছাড়াও Neo-Classical বা নব্য ইউরোপীয় শৈলী লক্ষণীয়। মোগল নব্য ইউরোপীয় শৈলীর ক্ষেত্রে মিছিলের মানুষের মুখাবয়ব, পোশাক-আশাক, দালানকোঠা রঙের বিন্যাসের মধ্যে পার্থক্য লক্ষ করা যায়। এক্ষেত্রে মোগল শৈলীর আধিক্য লক্ষণীয়। তবে নব্য ইউরোপীয় অংকনে আকাশ, ইমারত, রাস্তায় মিছিলের ছায়া, গাছের পল্লব গুচ্ছের ছায়া ইত্যাদিতে ইউরোপীয় পরিপ্রেক্ষিত (European perspective) দৃশ্যমান। সুতরাং চিত্রগুলোর অংকনশৈলী বিবেচনায় নিয়ে আমরা সিদ্ধান্তে আসতেই পারি যে চিত্রগুলো মোগল ইউরোপীয় শিল্পীদের অংশগ্রহণে পূর্ণতা পেয়েছে অথবা মোগল শিল্পীরাই পরবর্তিতে ইউরোপীয় শৈলী রপ্ত করে যুগপৎভাবে দৃশ্যপট তৈরি করেছেন।

চিত্রে ধর্মীয় সম্প্রীতির প্রতিফলন

রাজধানী ঢাকায় ঈদ মহররমের সেসব চিত্রকর্মে শোভাযাত্রার পাশাপাশি ফুটে উঠেছে তৎকালীন সমাজে সম্প্রীতির দারুণ এক প্রতিফলন, যার মধ্যে ধর্মীয় সম্প্রীতিটাই বিশেষভাবে অগ্রগণ্য। মহররম শিয়া সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠান হলেও সব সম্প্রদায়ের লোকজনই উৎসবে অংশ নিত। যদিও শিয়াদের কাছে এটি ধর্মীয় রীতি, কিন্তু অন্য সব সম্প্রদায়ের কাছে তা ছিল নেহাত আনন্দ বা জাঁকজমকতার উপলক্ষ। প্রসঙ্গেহুসেনি ব্রাহ্মণদের কথা উল্লেখ করা যায়। হুসেনি ব্রাহ্মণ এমন একটি সম্প্রদায় যা ঐতিহাসিকভাবে অর্ধেক হিন্দু অর্ধেক মুসলিম বলে বিবেচিত। তারা মূলত একত্রে দুটি সংস্কৃতি বহন করেন। কখনো কখনো সম্প্রদায়কে শিয়া ব্রাহ্মণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। হুসেনি ব্রাহ্মণরা প্রকৃতপক্ষে ইসলামে ধর্মান্তরিত হননি, কিন্তু তারা এমন ইসলামী বিশ্বাস অভ্যাস গ্রহণ করেছিলেন, যা হিন্দু বিশ্বাসের পরিপন্থী বলে মনে করা হতো। মহারাজা রণজিৎ সিংয়ের সময়ে অমৃতসর শহরে উল্লেখযোগ্য হুসেনি ব্রাহ্মণদের বসতি গড়ে উঠেছিল। ১৯৪০-এর দশকে হুসেনি ব্রাহ্মণরা অবশ্য মহররমের শোক পালনে অংশ নিত। ইতিহাসবিদ মনিকা দত্ত উল্লেখ করেছেন, পার্টিশন-পূর্ব সময়ে অমৃতসর শহরে শিয়া মুসলিম ব্রাহ্মণরা একসঙ্গেই ইমামবাড়াগুলোর তত্ত্বাবধান করতেন এবং একই সঙ্গে মহরমের তাজিয়া মিছিলে অংশ নিতেন। ১৮-১৯ শতকে ঢাকায় অনুষ্ঠিত যেসব মিছিলের চিত্র পাওয়া যায়, সেখানেও সম্প্রদায়ের উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

নাজমা খান মজলিস এমএ, পিএইচডি: অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন