গণফটোগ্রাফির যুগে ‘গুয়ের্নিকা’

ওয়াহিদ সুজন

সব দর্শক একমত না হলেও কেউ কেউ নিশ্চয় বলছেন, মাদ্রিদের রেইনা সোফিয়া মিউজিয়াম দারুণ এক সুযোগ করে দিয়েছে। সঙ্গে পুরনো প্রশ্নটি রয়েই যায়, ক্যামেরায় মনোযোগ বা প্রতিলিপি শিল্পকর্মের প্রকৃত স্বাদ তুলে ধরতে পারে কিনা।

এ আলোচনার প্রসঙ্গ পাবলো পিকাসোর ‘গুয়ের্নিকা’। টানা তিন দশকের নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়ায় এখন দর্শনার্থীরা এ বিখ্যাত চিত্রকর্মের স্থিরচিত্র তুলতে পারছেন। 

১৯৩৭ সালে আঁকা ছবিতে স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের ভয়াবহতা ও মানবতার বার্তা তুলে ধরেছেন পিকাসো। ২৬ ফুট দৈর্ঘ্যের ‘গুয়ের্নিকা’ যেন অসহায়ত্ব মোড়ানো জীবন্ত এক সত্তা। ঘোড়া, ষাঁঢ়, চিৎকাররত নারী, মৃত শিশু ও ছিন্নভিন্ন শরীরের সৈনিক। তাদের ঘিরে আছে সর্বগ্রাসী আগুন, যা কিনা সবকিছুকে ছারখার করতে করতে এগোয়। এখন কোনো কিছুই আর ‘স্থানীয়’ না থাকার কালে, সেই আগুন আরো স্পষ্ট।

চিত্রকর্মটির মালিকানা স্পেন সরকারের। মাঝে অনেকদিন দেশে ছিল না ‘গুয়ের্নিকা’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে নিরাপত্তার জন্য নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টের জিম্মায় দেন খোদ পিকাসোই। চার দশকের বেশি সময় আটলান্টিকের ওপারে থাকার পর ফেরে ১৯৮১ সালে। ১৯৯২ সালে রেইনা সোফিয়ার কাছে হস্তান্তরের আগে পর্যন্ত ঝুলছিল প্রাডো মিউজিয়ামে। স্থায়ী ঠিকানা পাওয়ার পর জারি হয় ‘নো ফটো’ বিজ্ঞপ্তি।

জাদুঘরের এক মুখপাত্র বলেন, ১ সেপ্টেম্বর থেকে গুয়ের্নিকা রুমে ছবি তোলার বিধিনিষেধ তুলে নেয়া হয়েছে। তবে দর্শনার্থীদের মানতে হবে কিছু শর্ত। ফ্ল্যাশ ব্যবহার করা যাবে না। রাখা যাবে না ট্রাইপড বা সেলফি স্টিকের মতো বাড়তি সরঞ্জাম। অর্থাৎ ছবি তোলাটুকু হবে নির্ঝঞ্ঝাট।

নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়ার বিষয়ে কী বলছেন কর্মকর্তারা? আগে ‘গুয়ের্নিকা’ দেখার জন্য দর্শক যে সময় ব্যয় করতেন তা এখন কমবে। একটি সেলফি তুলতে কতই বা লাগে, মাত্র কয়েক সেকেন্ড। ‘গুয়ের্নিকা’ রুমে একই সময়ে ৭০ জনের বেশি দর্শকের অনুমতি নেই। নতুন নীতির কারণে আরো দর্শকের কাছে পৌঁছতে পারবে জাদুঘর। আগে মানুষ গোপনে ছবি তুলতে গিয়ে রক্ষীদের তিরস্কারের মুখে পড়ত। এখন বাধা না থাকায় দর্শকদের হবে না তিক্ত অভিজ্ঞতা।

গত জুনে রেইনা সোফিয়ার পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হন ম্যানুয়েল সেগাদে। তিনি শুরু থেকেই ক্যামেরার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। একে হাল দুনিয়ায় মানুষের প্রতিদিনকার অভ্যাসের সঙ্গে মিলিয়ে দেখছেন। সেগাদের মতে, আমরা এখন সবকিছুতে ক্যামেরার দ্বারস্থ হই। কনসার্ট বা যেকোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমাদের সঙ্গী হয় ক্যামেরা। আইকনিক চরিত্র হিসেবে গুয়ের্নিকার সঙ্গে এমনটা যে হবে না, তা আমরা মনে করি না।

তার মতে, এখনকার তরুণরা সবসময় স্ক্রিনের মাধ্যমে দেখতে অভ্যস্ত। এ বাস্তবতা থেকে সরে না গিয়ে তরুণদের আগ্রহের দিকে মনোযোগ দেয়াও গুরুত্বপূর্ণ। তুলনা টানতেও ভুল করেননি সেগাদে। দুনিয়ার সব বড় জাদুঘরে ফটোগ্রাফি অনুমোদিত। রেইনা সোফিয়ায়ও। নিষেধাজ্ঞা ছিল শুধু ‘গুয়ের্নিকা’র বেলায়।

স্প্যানিশ একটি শহরের নাম ‘গুয়ের্নিকা’। যেখানে ১৯৩৭ সালে জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর সমর্থনে জার্মানি বোমা ফেলেছিল। স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিনের জেসন ডেলি ২০১৭ সালে লিখেছিলেন, প্রথমবারের মতো একটি বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে বিমান হামলার লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল।

সাদা-কালো ‘গুয়ের্নিকা’ আঁকতে প্রায় দেড় মাস সময় নেন পাবলো পিকাসো। রেইনা সোফিয়ার ওয়েবসাইট অনুসারে এটি চিরন্তন, সর্বজনীন প্রতীক, যুদ্ধের অদম্য ও ধ্বংসাত্মক রূপকে তুলে ধরে। একই সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাতের সঙ্গে শৈল্পিক বিতর্কের সূচনা করে।

মানুষের আবির্ভাবের কাল থেকেই আঁকাআঁকির সঙ্গে তার সম্পর্ক। নতুন নতুন টেকনোলজি তাকে প্রভাবিত করলেও চিত্রকর্মের আবেদন কখনো কমেনি। মানুষের নিজস্ব বলতে যা থাকে, তার চিরন্তন একটি দিক এ শৈল্পিক অভীপ্সা। তাই কয়েক দশকে চিত্রকর্মের ছবি তোলা উত্তপ্ত বিতর্কের বিষয়। যেহেতু ক্ষতিকারক সব প্রভাবক সম্পর্কে আমাদের জানা নেই, তাই ক্যামেরা বা ডিভাইসের সামনে এসব শিল্পবস্তু সবসময়ই ঝুঁকিতে থাকে। আর অরক্ষিত থাকলেও কথাই নেই। সবচেয়ে বড় কথা প্রকৃত শিল্পকর্ম অনুভবের জন্য ফটোগ্রাফ কোনো বিকল্প হতে পারে না। 

ফ্রান্সে লুভর মিউজিয়ামে ক্যামেরা ব্যবহারের কট্টর বিরোধী শিল্প সমালোচক জোনাথন জোন্স। বিশেষ করে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ‘মোনালিসা’র ছবি তোলার জন্য দর্শকদের মরিয়া ভাব দেখে ক্ষুব্ধ। ২০০৯ সালে তিনি লেখেন, ‘মোনালিসা’র সামনে একের পর এক ক্যামেরার ফ্ল্যাশ পেইন্টিংয়ে কুৎসিত প্রতিফলনে ফেটে পড়ে। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কীভাবে লুভর এই ধ্বংসাত্মক ক্যামেরা ব্যবহারের অনুমতি দিতে পারে। এমন নয় যে আগে কেউ রেইনা সোফিয়ায় পিকাসোর মাস্টারপিসটির সঙ্গে ছবি তোলেননি। গত জুনেরই কথা। যখন মিডিয়ার শিরোনামে আসেন রোলিং স্টোনস ব্যান্ডের গায়ক মিক জ্যাগার। জাদুঘরের নিয়মিত কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও জ্যাগার ‘গুয়ের্নিকা’র সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ পান, ছবি তোলেন। স্বভাবতই তুমুল প্রতিক্রিয়া হয়। সে বিতর্ক থিতু হতে না হতেই আমজনতা পেল একই সুযোগ। কিন্তু দুনিয়ার সব জাদুঘর যতই যুক্তি দিক না কেন, সুরাহা হবে না যে শৈল্পিক দৃষ্টির সঙ্গে ক্যামেরার সম্পর্ক কতটা অপরিহার্য। খোদ ক্যামেরাই চমৎকার সব শিল্পকর্ম তৈরি করে, কিন্তু এর সঙ্গে তো ‘গুয়ের্নিকা’ বা ‘মোনালিসা’র তুলনা হবে না কখনো।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন