সুবর্ণা মোর্শেদার চতুর্থ একক চিত্র প্রদর্শনী

‘আত্মদৃষ্টি’: নীলাভ নির্জনতার ভাষা

আলম খোরশেদ

ঢাকা আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা গ্যালারিতে এ মুহূর্তে চলছে তরুণ ও উদ্যমী দৃশ্যশিল্পী সুবর্ণা মোর্শেদার চতুর্থ একক প্রদর্শনী Introspect বা আত্মদৃষ্টি। এর আগে শিল্পকলা একাডেমিতে জাতীয় কিংবা দলগত প্রদর্শনীতে বিচ্ছিন্নভাবে সুবর্ণার দু-একটা শিল্পকর্ম দেখার সুযোগ হয়েছিল। তবে তার এ চতুর্থ একক প্রদর্শনীটি মন দিয়ে খুঁটিয়ে দেখার পর তাকে আরো পরিপূর্ণভাবে চেনা ও বোঝার সুযোগ হয়। একজন সৃষ্টিশীল চিত্রশিল্পীর পাশাপাশি তার ভেতরে একটি নিখাদ কবিমন ও সংবেদনশীল ভাবুক সত্তাকেও আবিষ্কার করি আমি, যিনি বাংলা ভাষা ও শব্দের গভীর অনুরাগী, জীব ও জগতের আন্তঃসম্পর্কের জটিল রসায়ন বিষয়ে মনোযোগী ও অনুভূতিশীল, স্মৃতি ও সংরাগের সঞ্চয়ে সতত যত্নবান, সর্বোপরি শিল্পের বহুবিধ ভাষা ও ব্যাকরণ বিষয়ে যার রয়েছে একটি স্বচ্ছ ধারণা ও ব্যক্তিগত বোঝাপড়া। আর এসবই আক্ষরিক অর্থে কবিতার অর্থময় অক্ষরপুঞ্জ এবং চিত্রকলার বহুবিধ শৈলী ও প্রকরণের সঙ্গে সুচারুরূপে সম্পৃক্ত হয়ে এমন এক শৈল্পিক অনুভব ও অভিঘাতের জন্ম দেয় দর্শকদের মনে, যা আমাদের সমকালীন শিল্পাঙ্গনের এক অসামান্য অর্জন, সন্দেহ নেই।

সুবর্ণার প্রদর্শনীতে কিছুটা সময় কাটালে এ মহাপৃথিবীর এক নীল নির্জন জনপদের নক্ষত্রখচিত অসীম আকাশের তলে মানবজীবনের অপার বিষাদ ও শূন্যতা, স্মৃতি ও বিস্মৃতি, সঙ্গ ও নিঃসঙ্গতা সর্বোপরি এক গভীর আত্মবীক্ষণ তথা ধ্যানমগ্নতার বোধ আমাদের চৈতন্যে চারিয়ে যেতে থাকে। তার আঁকা বিশাখা নক্ষত্র, রাত্রির নীলাকাশজুড়ে অগণন তারাপুঞ্জ, পৃথিবীর বুকে ঝরে পড়া পত্র ‍ও পুষ্প, কাগজ ও কাপড়ের জমিনে সায়ানোটাইপের নীলাভ মায়া এ সবকিছুই এক গভীর মহাজাগতিক বিষাদ ও অব্যাখ্যেয় একাকিত্বের অনুভূতিতে দর্শকদেরও বুঝি আক্রান্ত করে। মুহূর্ত, নীল রঙের নির্মল একাকিত্ব, নক্ষত্রমঙ্গল, যখন ঝরিয়া যাব হেমন্তের ঝড়ে, ঝরা পাতারা, গাছের গান; সুবর্ণা মোর্শেদার প্রদর্শিত চিত্রগুলোর এ নামগুলোই আমাদের বলে দেয় শিল্পীর সংবেদনায় কবিতা, সংগীত, নিসর্গ ও নির্জনতার কী সুদূরপ্রসারী সম্পর্ক ও প্রভাব। 

বস্তুত তার প্রদর্শনীটি শুরুই হয় একদিকে নীল নক্ষত্রের ছবিমালা আর অন্যদিকে জীবনানন্দের এ আশ্চর্য পঙ্‌ক্তি কয়টি দিয়ে: ‘‌পৃথিবীর প্রথম মানুষ এক নীল সমুদ্রের সাথে কাটায়েছে বেলা;/প্রথম আকাশ তারে দেখিয়াছে,—হৃদয়ের কাছে তারে পেয়েছে একেলা/প্রথম ঊষার রোদ,—যখন সে এসেছিল প্রথম বিস্তৃত পথ ধরে/ আমাদের পৃথিবীর,—সহজ ফেনার মতন যখন সে প্রথম সাগরে/উথলিয়া উঠেছিল, হৃদয় সেদিন তার জেনেছিল এক অবহেলা।’ শুধু এ একটি কবিতাই নয়, শিল্পীর কাজের সঙ্গে কবিতার এমনই অচ্ছেদ্য সম্পর্ক যে তিনি প্রদর্শনীতে হুমায়ুন আজাদ ও আশিক মোস্তফার আরো দুটো কবিতাকেও চিত্রকর্মের মতো করেই ব্যবহার করেছেন। আর আল মাহমুদের সেই বিখ্যাত কবিতা ‘সোনালি কাবিন’ নামেও তার রয়েছে স্বতন্ত্র একটি শিল্পকর্ম, যার শরীরে তিনি আলতো করে জুড়ে দিয়েছেন দুটি কাঁথাফোঁড়ের কাজ, যা হয়তোবা মাহমুদের কবিতার অন্তর্লীন ঐতিহ্যপ্রীতির সঙ্গে সংগতি রেখেই বোনা। এ শিল্পকর্মের ঠিক পাশাপাশি সুবর্ণা আরো একটি ছবিকে ঠাঁই দিয়েছেন, যার নাম ‘রুপালি কাবিন’, যার চিত্রপটে আমরা দেখি পূর্ববর্তী ছবির সোনালি রঙটুকু ম্লান হয়ে ধূসর বর্ণ হয়ে এসেছে। এ বৈপরীত্যটুকু স্পষ্টতই মানব সম্পর্কের এক চিরন্তন সত্যকে প্রকাশ করে, শিল্পীর অন্তর্গত বিষাদ, বিবিক্তি ও নিঃসঙ্গতার উৎসও হয়তোবা তা-ই।

সুবর্ণা মোর্শেদা শিল্পের নানা মাধ্যমে, নানান ভাষা ও ভঙ্গিতে, নব-নব নিরীক্ষামূলক কাজ করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। কাগজে জলরঙ, ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক, খোদাইকর্ম, ছাপচিত্র, কলোগ্রাফি, উডকাট, সূচিকর্ম, পেনসিল স্কেচ, কাগজে ও কাপড়ে সায়ানোটাইপের প্রিন্ট, লিথোগ্রাফ, সিরামিকের ভাস্কর্য; কোন মাধ্যমের কাজ নেই তার এ বহুমাত্রিক প্রদর্শনীতে! এমনকি কাশ্মীরে তার এক মাসের আবাসিক অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে নির্মিত একটি অত্যন্ত মর্মস্পর্শী, স্মৃতিসংরক্ত কোলাবোরেটিভ তথা যৌথ শিল্পের বৃহৎ প্রকল্পও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তার এ প্রদর্শনীতে, যা এ আয়োজনকে এক ভিন্নতর মাত্রা ও উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এ রকমই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ, ‘মৃত্যু সম্পর্কে আমার অবস্থান খুব পরিষ্কার’, যা মূলত কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের একটি বিখ্যাত গল্পেরই শিরোনাম। শিল্পী তার এ গল্পের প্রতিপাদ্য দর্শনটিকে নিজের ব্যক্তিজীবনের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা, করোনাকালে তার মাকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে পাওয়ার অনুভূতির সঙ্গে একসূত্রে গেঁথে নির্মাণ করেছেন এ অসামান্য নীল বিষাদে সিক্ত সিরিজচিত্রটি।

এ প্রদর্শনীর আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে এর সামগ্রিক পরিকল্পনা, চিত্রবিন্যাস, স্থানসজ্জা, ক্ষেত্রব্যবহার ও সার্বিক উপস্থাপনকৌশল। প্রদর্শনীর কিউরেটর মেধাবী আলোকচিত্রী এএসএম রেজাউর রহমান শিল্পী সুবর্ণার চিত্রকর্মের অন্তর্লীন ভাষা, ব্যঞ্জনা ও বোধের সঙ্গে মিলিয়ে সম্পূর্ণ জায়গাটিকেই নীলাভ রঙে রাঙিয়ে দিয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, লাগোয়া ক্যাফেটির সঙ্গে প্রদর্শনশালার একধরনের মানসিক ব্যবধান নির্মাণকল্পে এ দুয়ের মাঝখানে একটি তথ্যদেয়াল ও প্রবেশদরজা স্থাপন করে পুরো পরিসরজুড়ে এক অদ্ভুত অন্তরঙ্গ আবহ তৈরি করতে সক্ষম হন। এছাড়া সুবর্ণার কাশ্মীরবিষয়ক যৌথ শিল্পকর্মটিকে আলাদা একটি গোলাকার কুঠুরিতে এবং প্রদর্শনীর একমাত্র সিরামিক ভাস্কর্যটিকে তার সন্নিহিত একটি চৌকো তাকের ওপর ভিন্ন আঙ্গিকে প্রদর্শনের ভাবনাটিও প্রশংসনীয়। সন্দেহ নেই আলোচ্য প্রদর্শনীটি এতটা উপভোগ্য, হৃদয়স্পর্শী ও অভিঘাতসঞ্চারী হয়ে ওঠার পেছনে কিউরেটর রেজাউর রহমানের বুদ্ধিদীপ্ত পরিকল্পনা, গ্রন্থনা ও ব্যতিক্রমী উপস্থাপনারও একটা বড় ভূমিকা রয়েছে।

নানা দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ও দৃষ্টান্তমূলক এ অনন্য দৃশ্যশিল্পের প্রদর্শনীটি চলবে ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, প্রতিদিন বিকাল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। শিল্পের নতুন ভাষা, নতুন আঙ্গিক ও নতুনতর উপস্থাপনরীতি বিষয়ে আগ্রহী শিল্পভোক্তাদের জন্য সুবর্ণা মোর্শেদার ‘আত্মদৃষ্টি’ শীর্ষক এ বহুমাত্রিক প্রদর্শনীটি সত্যিই এক সুবর্ণ সুযোগ বৈকি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন