চট্টগ্রাম চারুকলা ও একজন ঢালী আল মামুন

মো. বজলুর রশিদ শাওন

ঢালী আল মামুন ছবি: কলাকাল

বাংলাদেশের দৃশ্যশিল্পে আধুনিকতার চর্চা মূলত শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক। বিশেষত বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদকেন্দ্রিক, যা ১৯৪৮ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ (বর্তমান চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ঔপনিবেশিক কাঠামোর আদলে গঠিত এ প্রতিষ্ঠানের শুরুর দিককার শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ইউরোপে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান। পশ্চিমা আধুনিকতার ধারায় তাদেরই একটা অংশের নেতৃত্বে বিশেষ করে শিল্পী রশিদ চৌধুরীর হাত ধরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগের যাত্রা হয়। যেখানে পদ্ধতিগত দিক থেকে ঢাকা চারুকলার থেকে খুব বেশি ভিন্নতা শুরুতে লক্ষ করা যায়নি। ষাটের দশক থেকে আশির দশকের শুরুর সময় পর্যন্ত আধুনিকতা চর্চার একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিল অ্যাবস্ট্রাকশন বা নির্বস্তুকতা। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, শিল্পী এসএম সুলতান, শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ, নভেরা আহমেদ, শামীম শিকদারের মতো কয়েকজন ব্যতীত বেশির ভাগ শিল্পীই এ ধারায় কাজ করতেন। আশির দশকে নির্বস্তুকতা ও পশ্চিমা আধুনিকতার প্রাসঙ্গিকতাসহ স্থানিক শিল্প ভাষা অন্বেষণের মতো অসংখ্য বিষয় সামনে নিয়ে ‘সময়’ নামে একটি শিল্প সংগঠন গড়ে উঠেছিল, যেখানে প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যদের মধ্যে একমাত্র শিল্পী ঢালী আল মামুন ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং ‘সময়’ গ্রুপের অন্যতম কর্ণধার। ১৯৮৮ সালে তিনি শিক্ষক হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন।

ঢালী আল মামুন শিল্পী হিসেবে যতটা স্বকীয় ও জনপ্রিয়, শিক্ষক হিসেবে তার চেয়েও বেশি বলাটা অত্যুক্তি নয়। শিল্পশিক্ষার পাঠদানে যতটা হাতে-কলমে শেখানোর ব্যাপার থাকে বলে মনে করা হয়, তার চেয়ে বেশি থাকে চিন্তার খোরাক জোগানো। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও স্বতন্ত্রতার ধরন বুঝে তাকে অনুপ্রাণিত করা। তাদের দেখার দৃষ্টিভঙ্গি ও দৃষ্টিকোণ কেমন হতে পারে সে ব্যাপারে সাহায্য করা। এক্ষেত্রে তিনি যে সার্থক, সে দাবি করা যেতেই পারে। চট্টগ্রাম চারুকলা থেকে পড়াশোনা করে বাংলাদেশের দৃশ্যশিল্পের আঙিনায় যাদের (তাসাদ্দুক হোসেন দুলু, শায়লা শারমিন, ইয়াসমিন জাহান নূপুর, রিপন সাহা, জিহান করিম, শারদ দাস, রাজীব দত্ত প্রমুখ) স্বকীয় বিচরণ তাদের অধিকাংশই শিল্পী ঢালী আল মামুনের সরাসরি ছাত্র। ২০০৬ সালে প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও কলিগদের সঙ্গে নিয়ে ইউরোপীয় চিত্রকলার চারটি কালজয়ী পেইন্টিং অবলম্বনে চট্টগ্রাম আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে ‘চারটি শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্মের অভিযাত্রা—স্থানের সাথে কালের সংলাপ’ শিরোনামে একটি কর্মশালাভিত্তিক প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। যেখানে পল সেজান, এডোয়ার্ড মনে, ইউগিন দেলাক্রয়ে ও জর্জ সুরার চারটি পেইন্টিংকে শিক্ষার্থীরা তাদের সময় ও সমাজ বাস্তবতার পাশাপাশি ব্যক্তি অভিজ্ঞতার সঙ্গে সংযোগের চেষ্টাস্বরূপ নতুন করে দৃশ্যায়নের চেষ্টা করেন, যা শিক্ষক হিসেবে তার একটা অনন্য প্রয়াস। তার শুরুর দিকের ছাত্র (যিনি ওই কর্মশালাভিত্তিক প্রদর্শনীর একজন অংশগ্রহণকারী) শিল্পী তাসাদ্দুক হোসেন দুলুর মতে, ‘তরুণদের সঙ্গে স্যারের সম্পর্ক অসাধারণ। তিনি তরুণদের পাঠশালা। তার জনপ্রিয়তা চট্টগ্রামের শিল্পশিক্ষা জগতের শেষ আশ্রয় বলে মনে করি!’ 

নব্বই দশক-পরবর্তী বাংলাদেশের দৃশ্যশিল্পের আঙিনায় একটা বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, যা এখনো চলছে। প্রথাগত মাধ্যম ও চিন্তার সমন্বয় ভেঙে দৃশ্যশিল্পের ভাষা নির্মাণের ক্ষেত্রে নিত্যনতুন দৃষ্টিভঙ্গি যুক্ত হয়। অবস্থান ও ঐতিহ্যের কারণে এ নতুন ভাষারীতির চর্চার (মাধ্যম হিসেবে ইনস্টলেশন, ভিডিও, পারফরম্যান্স, সাইট স্পেসিফিক আর্ট ইত্যাদি) ক্ষেত্রে ঢাকাভিত্তিক শিক্ষার্থীরা এগিয়ে থাকলেও চট্টগ্রাম চারুকলা পিছিয়ে পড়েনি একটুও এবং সেটা যাদের কারণে সম্ভব হয়েছে, শিল্পী ঢালী আল মামুন তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। ২০২১ সালে চট্টগ্রাম চারুকলার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ঢাকার কলাকেন্দ্র গ্যালারিতে ‘চর্চা, চর্যা, উদযাপন’ নামক একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন, যেখানে চট্টগ্রাম চারুকলার স্বাতন্ত্র্য সবচেয়ে ভালোভাবে পরিলক্ষিত হয়েছিল। এছাড়া ২০২২ সালে চট্টগ্রাম চারুকলার প্রতিষ্ঠাকালীন শিল্পী রশিদ চৌধুরী, দেবদাস চক্রবর্তী ও শিল্পী মুর্তজা বশীরের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকর্ম ও চট্টগ্রাম চারুকলাকেন্দ্রিক তাদের চিন্তার কিছু তথ্য-উপাত্তসহ বেঙ্গল শিল্পালয়ে ‘তিন পথিকৃৎ ও তাদের আধুনিকতা’ শীর্ষক আরেকটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন। এ রকম অসংখ্য কাজ তিনি করেছেন, যেগুলো তার কর্মক্ষেত্র, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রতি তার ভালোবাসা, দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রামাণিক নিদর্শন।  

সবশেষে তার ছাত্র শিল্পী রিপন সাহার একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করে শেষ করি। তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম চারুকলায় ভর্তি হয়ে আমি যদি কিছু পেয়ে থাকি, তবে সেটা মামুন স্যার।’ 


লেখক: ভিজুয়াল প্রফেশনাল

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন