প্র দ র্শ নী

রহস্য জাগিয়া রয়

ওয়াহিদ সুজন

বিকাল ৪টা থেকে খানিকটা পর। ধানমন্ডির আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা গ্যালারিতে প্রবেশ মুহূর্তে একমাত্র দর্শনার্থী বের হয়ে গেলেন। কাচের দরজা টেনে দিতে আমি একা। আর ২৫টি চিত্রকর্ম ও তিনটি ভাস্কর্য। দরজার ওপারে ক্যাফেটেরিয়ায় লোকজনের নরম আনাগোনা। আর সাদা দেয়াল-মেঝেতে মোড়া গ্যালারির ছবিতে আমাদের দেখার জগৎ গলে গলে পড়ছে। ‘অন্তহীন রহস্যের প্রতিফলন’ যার শিরোনাম। 

নবরাজ রায়ের বিমূর্ত চিত্রকর্মে ঢেকেছে দেয়াল। প্রথম প্রদর্শনী তার। শুরুতেই আছে প্রদর্শনীর প্রসঙ্গ। আঙ্গিকগত তাৎপর্যের আলাপ। খানিকটা দেখার মাঝে বিভ্রমের মতো দৌড়ে হাজির হলো একটা বাচ্চা মেয়ে। বড় একটা ছবিতে তার আঙুল ছুঁয়ে গেল। বললাম, ‘হাত দিও না’। ও বলল, ‘কী হয় হাত দিলে। রঙ তো শুকিয়ে গেছে। ‘ক্ষতি হয়ে যাবে’। আমার হাত পরিষ্কার—সাফ সাফ জবাব তার। ‘আঙুলের ডগায় থাকে অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা, যা আমরা চোখে দেখি না, তার স্পর্শে ...’ স্পষ্টত, সে খুবই বিরক্ত। আমাকে শূন্যতায় রেখে হারিয়ে গেল।

শিল্পকে খুবই ব্যক্তিক জায়গা থেকে দেখা সম্ভব বলেই ওপরে দেয়া তথ্যগুলো ঠিক বর্ণনায় থাকে না, আমার দেখাকে প্রভাবিত করে। ভাবায়। আমরা ও শিল্প বেঁচে রই এভাবে। যে সুবিধাটুকু শিল্পীর কাজের ভেতর থেকেই উৎসারিত। পরে যখন ভিড়ভাট্টার উপক্রম হলো, তার মাঝে একজনকে আবিষ্কার করলাম; নবরাজ রায়। তার আঁকার বিষয় ও রঙ বিন্যাস নিয়ে কথা বলছিলাম আমরা। কোনো নিরপেক্ষ মুহূর্ত নয়, শিল্পী তার পারিপার্শ্বিকতার ভেতর দিয়ে যেভাবে বেড়ে ওঠেন, আর প্রতিদিনের ভাবনা কাগজে-ক্যানভাসে ফোটে। তার রাগ-অনুরাগ-বিরাগ স্পর্শ করে—এসবই।

আমরা চা খেতে খেতে আমাদের নগর ও গ্রামের গল্প বলছিলাম। যেখানে আমাদের বেড়ে ওঠা। চিত্রকর্মের বিষয়াদি নিয়ে আলোচনায় নিজের বেড়ে ওঠার কথা জানিয়েছেন নবরাজ রায়। এ বিষয়ে নবরাজের জবান হুবহু তুলে ধরা যাক। তিনি সুভেনিয়রে বলেছেন, ‘আমার বেড়ে ওঠা নানা বৈচিত্র্যে। কখনো মহানগর, কখনো জেলা শহরে প্রান্তিক জনজীবন আবার কখনো বা নানা বিপরীতমুখী কাঠামোর বসত দিগন্ত আমাকে প্রতিনিয়ত মুগ্ধ করেছে। আমার এই বেড়ে ওঠার সময়ে পৃথিবীও দ্রুতগতিতে পরিবর্তিত হয়েছে। যে পরিবর্তনের প্রভাবে কোনোভাবেই নিজেকে একটি কেন্দ্রবিন্দুতে স্থির রাখা প্রায় অসম্ভব।’ আরেকটু এগিয়ে গেলে তার বলাটুকু এমনই, ‘গ্রাম ও শহরে এই বসতবাড়ি দালানকোঠার ল্যান্ডস্কেপের মধ্যে এই বিস্তর ভিন্নতা, শহুরে চতুর্ভুজ কাঠামোয় শেষমেশ দিগন্ত খুঁজতে হয় কল্পনাতেই। এসব দৃশ্য, সময়, আকৃতি ও কাঠামোগত দ্বন্দ্ব প্রতিনিয়ত আমার মনোজগতে গভীর প্রভাব ফেলে। সেই সাথে ছাপ রেখে যায় সময় ও সংস্কৃতির নানা পরিবর্তন।’ নবরাজের আঁকাআঁকি সম্পর্কে লিখেছেন দেশ-বিদেশের বিজ্ঞজনেরাও। 

স্পষ্টত বাংলাদেশ বলতে যা বোঝায় তার জন্য গ্রামের কাছে আমরা ফিরি। নবরাজ বলছিলেন, ‘চিত্রকলায় এ অঞ্চলে একদম মৌলিক রেখার কাছে ফিরতে হলে গ্রামের কাছে যেতে হবে; আমাদের চিরকালীন শিল্পের সঙ্গ পেতে হবে। যেটা আমরা আমাদের পূর্বসূরিদের কাজে দেখেছি। পূর্ববঙ্গের নিজস্বতা বহন করছে এ মাটি সংলগ্নতা।’ বিমূর্ত ধারার কাজ নিয়ে অকপট নবরাজ। অকপট প্রভাবক শিল্পধারা সম্পর্কেও। রবীন্দ্রভারতীতে পড়ার সূত্রে সেখানকার বিমূর্ত ধারার সঙ্গে বড় পরিসরে তার পরিচয়, ভালো লাগা। কিন্তু নবরাজের নিজের ধরন কোনটা। যার মাধ্যমে তাকে আমরা খুঁজে পাচ্ছি। সম্ভবত এখানে আমরা বাংলাগ্রাম ও গ্রামীণ শিল্পনিষ্ঠতা ফোকে পরিণত করার আভাসটুকু পাই। অবশ্য তার কাজে জ্যামিতিক তেমন ঝোঁক নেয়। বিমূর্তের মাঝে ভেঙে দেখার চেষ্টা আর ফোকলোরের একটা মেটা ন্যারেটিভ আছে। যেখানে অভিজ্ঞতাকে ভেঙে দেয়া যাচ্ছে, রিশার্পল করা যাচ্ছে। নগরে ফোকের উপস্থিতি নিয়ে দুটো ছবিও আছে। বলছিলাম, খানিকটা ব্যঙ্গ আছে? নবরাজের হাসি দেখে মনে হলো নেই। বললেন, ‘বিমূর্তের এ একটা মজা। আমি গল্পটা দর্শকের জন্য ছেড়ে দিচ্ছি। ঠিক, আমিও নিজের মতো করে নিলাম।’

শুরুতেই বলেছিলাম, আমাদের দেখার জগৎটা গলে গলে যাচ্ছে। আরো ভালোভাবে বলা যায়, দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা কোথাও কোথাও মিলেমিশে যাচ্ছে। স্পেস তখন শুধু পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখার ভঙ্গি হয়েই থাকল এবং ভাঙাভাঙি একটা কমন উৎসকেও হয়তো নির্দেশ করে। প্রতি মুহূর্তে বদলে যাওয়া দিগন্তরেখার পাশাপাশি অন্তরালেও যায়। আধ্যাত্মিকতা। আর সময়? নবরাজের ছবির শিরোনামে সময় আছে। পরিবর্তন আছে। বিবর্তন আছে। তবে কোথাও কোথাও সময় বা পরিবর্তনের গতিটা অনুপস্থিত ঠেকে। নাকি, ধরতে পারিনি! পরম কোনো মুহূর্তে গতি-স্থিতি একই। নাকি। 

দেখার দুনিয়ায় এই যে বৃহত্তর একটা পরিবর্তন। তার অভিজ্ঞতা শুধু নবরাজের নয়, গত শতকের শেষে দশকে যাদের জন্ম বা (সৌভাগ্যবান হলে) বেড়ে ওঠা; তাদের সবার। তারা মানুষ ও জনপরিসরের দ্রুত পরিবর্তন দেখেছে। এবং একপর্যায়ে জেনেছে এই দ্রুত পরিবর্তন ও গতি এখন তার জন্য সমূহ বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবর্তনকে একরৈখিকভাবে অগ্রযাত্রা হিসেবে দেখার কুফলও আমরা টের পাচ্ছি। সেটা সমাজ, অর্থনীতি বা রাজনীতিতে। নবরাজের ‘অরবান’, ‘সিভিলাইজেশন’ শব্দগুলোর মাঝে থেকে আমরা নিজেদের মতো করে ইশারা বাছাই করতে পারি। 

অ্যাক্রিলিক, ওয়াটার কালার, মিক্সড মিডিয়া তার মাধ্যম। ছবিতে বিক্ষিপ্ত ভাঙা অবয়ব ও তাদের টিকে থাকার সংগ্রাম; যেখানে মানুষও পশু হয়ে গেছে; হয়তো বুড়া বটগাছ আর হাজামজা পুকুর—আছে সবই। সবকিছুতেই ল্যান্ডস্কেপের গল্প। কিন্তু সেই দেখা ও বদলকে দরকার মতো কল্পনা আছে নবরাজের। তিনি রয়েসয়ে মিনিমালিস্ট ভঙ্গিতে ভাবনাটা জানাতে চান। অল্প কথায়। ঠিক যে অল্প কথা মানে অল্প নয়। অল্প কথা হলো সেই ঘা, যা জাগিয়ে দিতে পারে অনেক অনেক ব্যথা। শুনিয়ে দিতে পারে অনেক অনেক অব্যক্ত। ফলে যা মনে হয়, পৃথিবীর রহস্য মরে গেছে বলে সে সন্তাপ হালচালের মানুষের মাঝে; ততটা হয়তো নয়। রহস্য জাগিয়া আছে। আছে বলেই শিল্প আছে। তার প্রতিফলন আছে।


লেখক: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন