দুনিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত বাঁহাতি ব্যক্তি

জোহরা ঝুমু

দ্য লেডি অব দ্য ডিসেভলড হেয়ার—ছবি: লিওনার্দোদা-ভিঞ্চি.ওআরজি

শিল্প কিংবা বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় প্রাতঃস্মরণীয় এক নাম—লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি । ইতালিয়ান রেনেসাঁ যুগের অন্যতম  এ প্রবাদ পুরুষ চিত্রশিল্পী বা ভাস্কর হিসেবেই অধিকন্তু পরিচিতি লাভ করেন। বাস্তবে তিনি ছিলেন একাধারে বিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ, সংগীতজ্ঞ ও আবিষ্কারক। মিথিক্যাল এ মানুষের জীবন কিংবা জীবনবোধ কোনোটাই সহজ ছিল না।  তার জীবন ও কাজ ঘিরে গল্প আছে অনেক। সে সব বেশকিছু তথ্য বা ফ্যাক্ট আজকের আলোচ্যে— 

আইকিউ লেভেল 

ভিঞ্চিকে মনে করা হয় অন্যতম মেধাবী মানুষ। কাজ, ডায়েরি, লেখাজোকা, আবিষ্কার সবকিছুর ওপর নির্ভর করেই তার আইকিউ ধরা হয় ১৮০-২২০-এর মধ্যে। বিস্ময়কর এ মেধা! তবে, কিছু গবেষক দ্বিমত পোষণ করে। তাদের মতে, লিওনার্দোর আইকিউ লেভেল বেশ উচ্চ, কিন্তু ২২০ ঠিক যুক্তিযুক্ত মান নয়। তবে যে মতবাদেই হোক না কেন, দুই দলের হিসাবেই লিওনার্দোর আইকিউ ১৬০-এর ওপরে; যেখানে ১৩০ বা এর ঊর্ধ্বে থাকা মানেই সেই ব্যক্তি অনন্য বুদ্ধিমত্তার অধিকারী।   

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা

আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, লিওনার্দোর সে অর্থে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা ছিল না। ছোটবেলায় প্রাথমিক শিক্ষার যেটুক ভাগ্যে জুটেছিল তা-ই তার পুঁজি। কোনো রকম পড়তে-লিখতে পারা আর প্রারম্ভিক গণিত ছিল তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অংশ। এর বাইরে তার জন্য গোটা জগৎটাই ছিল উন্মুক্ত! প্রচণ্ড রকমের কৌতূহল থেকে প্রকৃতির প্রতিটি বিষয় নিজেই খুঁটিয়ে দেখতেন আর তা বোঝার চেষ্টা করতেন। প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নেয়ার এ মনোবৃত্তির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব লিওনার্দোর জ্ঞানার্জনে কোনো রকম অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি। 

বাঁহাতি

গবেষকদের ধারণা, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ছিলেন ‘সব্যসাচী’। তবে এ ধারণার স্পষ্ট ও সত্যতা পুরোপুরি না মিললেও তিনি যে মূলত বাঁহাতি ছিলেন তা স্বীকৃত। ভাবছেন, বাঁহাতি। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করার কী আছে? আছে লিওনার্দো কেবল বাঁ হাতেই লিখতেন না, বরং ডান দিক থেকে শুরু করে বাঁ দিকে উল্টো হরফেও লিখতেন! এ লেখাকে আয়নায় ধরলে তবেই ঠিকঠাক পড়তে পারা সম্ভব। তাই এ লেখার ধরনকে বর্তমানে ‘মিরর রাইটিং’ বলা হয়। 

ধারণা করা হয়, লিওনার্দো অনেক ক্ষেত্রেই ইচ্ছাকৃতভাবেই এ ‘মিরর রাইটিং’-এ লিখতেন। এ বিশেষ পদ্ধতির লেখার মূল কারণ ছিল অন্যদের কাছ থেকে নিজের নতুন আবিষ্কার, জ্ঞান গোপন করা। কেউ চাইলেই সহজে যাতে লিওনার্দোর আবিষ্কার নকল বা চুরি করতে না পারে, তাই নিজেই এ কৌশল ব্যবহার করতেন। এত কিছুর পরও বেশ লুকিয়ে যত্নে সংরক্ষণ করতেন তার সমস্ত আবিষ্কারের লেখাপত্র। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি: আ মেমোরি অব হিজ চাইল্ডহুড বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১০ সালে। ভিঞ্চিকে নিয়ে ফ্রয়েডের আগ্রহ ছিল অনেক দিন ধরেই। ১৮৯৮ সালের ৯ অক্টোবর তিনি ফ্লিয়েসকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘সম্ভবত দুনিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত বাঁ হাতি ব্যক্তি হলেন লিওনার্দো, তার কোনো প্রেমের সম্পর্ক ছিল এমনটা জানা যায় না।’ 

     লিওনার্দোর আঁকা হাতের ছবি—  ছবি: লিওনার্দোদা-ভিঞ্চি.ওআরজি 

লিওনার্দোর ডায়েরি ‘কোডেক্স লিস্টার’

নিজ জীবদ্দশায় নানা কৌশলে নিজের সমস্ত কিছুকে গোপন রাখতে চেয়েছেন লিওনার্দো। তিনি বুঝেছিলেন, তার এসব ডায়েরি শুধু লেখা নয়; একেকটি ডায়েরি একেকটা গুপ্তধনের খনিতুল্য। তাই তো লিওনার্দোর মৃত্যুর বহু বছর পর প্রাথমিকভাবে ডায়েরিগুলো জাদুঘরের সম্পদ হিসেবেই ছিল। 

যুদ্ধে লিওনার্দোর লেখা, কাগজ ও ডায়েরি নষ্ট হয়। ধারণা করা হয়, তার জীবদ্দশায় ৩০টিরই বেশি ডায়েরি লিখেছিলেন। এ ডায়েরিগুলো সমৃদ্ধ ছিল বিজ্ঞান, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, শল্য চিকিৎসা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে নতুন সব আবিষ্কার ও প্রাপ্ত ফলাফল নিয়ে। এসব ডায়েরির মধ্যে ‘কোডেক্স লিস্টার’ (Codex Leicester)-কে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি জার্নাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ১৯৯৪ সালে ডায়েরিটি কিনে নেন বিল গেটস। প্রায় ৩ কোটি ৮ লাখ ডলার দিয়ে নিজের ব্যক্তিগত সংগ্রহের জন্য লিওনার্দোর ডায়েরিটা কিনে নেন বিল গেটস। এ নিলামের মাধ্যমেই বিশ্বের অন্যতম দামি একটি বইয়ে পরিণত হয় ‘কোডেক্স লিস্টার’! 

অ্যানাটমি ও অস্ত্রোপচার    

লিওনার্দো ছিলেন প্রকৃতির শিষ্য।তাই সবকিছুকেই তিনি শিখতে ও বুঝতে চেয়েছিলেন হাতে-কলমে। পাশাপাশি মানুষ ও প্রাণীর শরীর নিয়ে কৌতূহল ছিল তার তীব্র। চামড়ার নিচের শরীরের সমস্ত কিছুই তিনি দেখতে চেয়েছিলেন একদম গভীর থেকেই। এ কৌতূহল ও আগ্রহ থেকে সিদ্ধান্ত নেন নিজেই শবদেহগুলোর ব্যবচ্ছেদ করবেন। ধারণা করা হয়, লিওনার্দো তার জীবদ্দশায় ৩০টির মতো শবদেহের ব্যবচ্ছেদ করেছিলেন নিখুঁতভাবে। এ ব্যবচ্ছেদগুলোর মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত তিনি লিখে রাখার পাশাপাশি অ্যানাটমির নিখুঁত বর্ণনাও এঁকে গিয়েছিলেন নিরলসভাবে। এ অ্যানাটমি ও তথ্য-উপাত্ত চিকিৎসা বিজ্ঞানের জগতে এক বিশাল পরিবর্তন নিয়ে আসে। তাই শুধু শিল্পের জন্যই নয়, বরং চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসেও গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে আজও সর্বজন সমাদৃত এ অ্যানাটমি। 

ব্যবচ্ছেদের জন্য লিওনার্দো ইতালির মিলান, রোম ও ফ্লোরেন্স শহরের হাসপাতালে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। সেখানেই শবদেহের ওপর করতেন তিনি অস্ত্রোপচার। বিশ্ব প্রথম লিওনার্দোর মাধ্যমেই জানতে পারে, মানবশরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে মস্তিষ্ক, ফুসফুস ও হৃৎপিণ্ড। এ আবিষ্কার এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হিসেবেই স্বীকৃত।   

পশুপ্রেমী 

ব্যবচ্ছেদের কথা শুনে লিওনার্দোকে নিষ্ঠুর ভাবার কারণ নেই। ব্যবচ্ছেদ তার গবেষণার অংশ। ব্যক্তিগত জীবনে লিওনার্দোর প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা ছিল একদম নিখাদ । প্রাণীর প্রতি মমত্ববোধ থেকে তিনি হয়ে গিয়েছিলেন পুরোপুরিভাবেই নিরামিষাশী। তার প্রাণীপ্রেমের বেশকিছু প্রচলিত গল্পও রয়েছে। 

তখন ইতালির বাজারে খাঁচাভর্তি পাখি পাওয়া যেত। এসব পাখি কেউ খাওয়ার জন্য আবার কেউ পোষার জন্য কিনে নিত। তাদের সঙ্গেসঙ্গে লিওনার্দোও খাঁচাভর্তি পাখি কিনে আনতেন। তারপর ছেড়ে দিতেন উন্মুক্ত আকাশে। এছাড়া লিওনার্দোর স্টুডিও সব প্রাণীর এক রকম অভয়ারণ্য হিসেবেও ছিল। তার স্টুডিওতে কুকুর, বিড়াল, নানা ধরনের পাখি, পোকামাকড় এমনকি নানা ধরণের সরীসৃপও আশ্রয় পেত অবলীলায়!     

মুষ্টিমেয় শিল্পকর্ম

সারা বিশ্বে লিওনার্দো শিল্পী হিসেবেই অধিক পরিচিত ও সমাদৃত নিঃসন্দেহে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে লিওনার্দো তার সমস্ত জীবনে খুবই অল্পসংখ্যক কিছু শিল্পকর্ম সম্পূর্ণভাবে এঁকেছেন। ক্রমাগত নতুন টেকনিক ও গবেষণার ফলে অনেক শিল্পকর্মই সময়ের সঙ্গেসঙ্গে হারিয়ে যায়। এছাড়া যুদ্ধের কারণে নষ্ট হয় তার আরো কিছু মাস্টারপিস। এখন পর্যন্ত সাকল্যে লিওনার্দোর ২০টির মতো চিত্রকর্মের সন্ধান পাওয়া যায়।     

এছাড়া বিজ্ঞানী হিসেবে সমরাস্ত্র কিংবা হেলিকপ্টারের প্রাথমিক ধারণা ও নকশা আঁকা সব ক্ষেত্রেই লিওনার্দোর বিচরণ ছিল চোখে পড়ার মতো। লিওনার্দো একাই একটি ইতিহাস। তাই এত জানার পরও লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি যেন রয়ে যান অজানাই। তার মৃত্যুর এত বছর পেরিয়েও লিওনার্দো আজও প্রয়োজনীয় সমানভাবে, যেমনটা থাকবেন তিনি ভবিষ্যতের পৃথিবীতেও।  

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন