অতীতের দর্পণে বিম্বিত ভবিষ্যৎ

আহমেদ দীন রুমি

দ্য রুরাল পোস্টম্যান, ১৮৯৯ ছবি: আর্ট নেট

ট্রয়ের যুবরাজ হেক্টরের মৃত্যুর খবর সবাই জানে। এ গল্প তারই বোন কাসান্দ্রাকে নিয়ে। এ মানবী এতটাই সুদর্শনা ছিলেন যে দেবতা অ্যাপোলো তার প্রেমপ্রার্থী হন। তাকে প্রীতি উপহার হিসেবে দেন ভবিষ্যৎ দেখার ক্ষমতা। কাসান্দ্রা যদিও আশ্বাস দিয়েছিলেন প্রেম গ্রহণ করার; কিন্তু উপহার গ্রহণের পর অস্বীকার করে বসেন। দেবতা হলেই কি আর দেয়া উপহার ফেরত নেয়া যায়? অ্যাপোলো তাই কাসান্দ্রাকে অভিশাপই দেন; দেবতার উপহারে কাসান্দ্রা ভবিষ্যৎ দেখতে পারবে সত্য, কিন্তু তাকে কেউ বিশ্বাস করবে না। কাসান্দ্রা কিন্তু সত্যিই ভবিষ্যৎ দেখেছিলেন। আগেই দেখেছিলেন তার ভাই প্যারিসের ভুল ও তার কারণে ট্রয়ের ধ্বংস হয়ে যাওয়াকে। কিন্তু আসলেই তাকে কেউ বিশ্বাস করেনি। দেবতা অ্যাপোলো সেদিন শিল্পীদের উদ্দেশ্য কোনো বর দিয়েছেন কিনা, তা হোমার কিংবা ভার্জিল বলেননি। প্রতিটি শিল্পীকেই কম-বেশি কাসান্দ্রা হতে হয়। কেউ তাদের বিশ্বাস করুক আর না করুক, তাদের বলে যেতে হয় ভবিষ্যতের গল্প।

ভবিষ্যৎকে দেখার কৌতূহল মানুষ জন্মসূত্রে পায়, আর শিল্পীরা তো দেখেই থামেন না। নিজেরা যা দেখেন তা দেখাতে চান। স্বাভাবিকভাবেই তারা আঁকেন ভবিষ্যৎকে। মাইকেলেঞ্জেলো ও আলব্রেশট ড্যুরারের মতো বিখ্যাত চিত্রশিল্পীরাও ভবিষ্যৎকে চিত্রিত করেছেন। কিন্তু তাদের সে চিত্রায়ণ ছিল বাইবেলকেন্দ্রিক। বাইবেলের বুক অব রিভেলেশন তাদের হাতে আঁকার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এসেছে খ্রিস্টীয় বয়ানে কেয়ামত ও আখেরি জমানার চিত্র। কিন্তু সবাই এ কাতারে শামিল ছিলেন না। কারো মননে ছিল এমন একটা সভ্যতার কথা, যাদের হাসি-কান্না প্রাপ্তি ও বিভ্রান্তির মনোযোগ কাড়ে। উনিশ শতকে সাম্রাজ্যবাদ সংকুচিত হয়ে আসছিল। এগিয়ে যাচ্ছিল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। এ সময়ে কোনো কোনো চিত্রশিল্পী একটা ভবিষ্যতের ইশারা দিয়ে গেছেন তাদের কাজে-কর্মে। ১৬৬১ সালে ‘‌দ্য ভ্যানিটি অব ডগম্যাটাইজিং’ বইয়ে জোসেফ গ্ল্যানভিল চন্দ্রাভিযানের কথা বলেছেন। বিদ্যুৎ আবিষ্কারেরও প্রায় ২০০ বছর আগে ম্যাগনেটিক ওয়েভের মাধ্যমে যোগাযোগ হবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। সেখানেই থেমে যাননি। জুল ভার্নের ‘‌ফাইভ উইকস ইন আ বেলুন’ ও মেরি শেলির ‘‌ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ এবং এইচ জি ওয়েলসের ‘‌অ্যান্টিসিপেশনস’ প্রযুক্তিগত আধুনিকায়নের ভবিষ্যৎকেই তুলে এনেছেন সাহিত্যে। চিত্রকররা এ প্রবণতা থেকে মোটেই দূরে ছিলেন না। ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুভাবেই আঁকলেন। আগে আর্ট ছিল বাস্তবতাকে, ধর্মকে, পুরাণকে ও অধিবিদ্যাকে দৃশ্যমান করার শিল্প। এবার তা তুলে ধরল প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও সম্ভাব্য উল্লম্ফনকে।

মানুষ বাতাসকে জয় করতে চেয়েছে অনেক আগে থেকেই। ইকারাসের পুরাণ থেকে লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির ‘‌এরিয়াল স্ক্রু’ পর্যন্ত নানাভাবে ঘুরেছে বাতাসে ভাসার কল্পনা। ১৭৮৩ সালে মন্টগোলফিয়ার ভ্রাতৃদ্বয় বেলুনে বাতাস পুরে ওড়ার নজির স্থাপন করেন। ঘটনাটি সমকালীন যত চিত্রশিল্পীকে প্রভাবিত করে, তাদের একজন ছিলেন আলবার্ট রোবিদা। তিনি ভবিষ্যতের আকাশ ও সম্ভাব্য উড়োজাহাজ এঁকেছেন কল্পনার সবটুকু দিয়ে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্যায়ন। বাতাসের মধ্যেই অপেরা, গণপরিবহন ও অভিজাত সরাইখানা। ফ্লাইটের পাশাপাশি তিনি পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন বিশেষ ধরনের যন্ত্র টেলিফোনোস্কোপ, যা এখনকার দুনিয়ার মানুষের প্রাত্যহিক ব্যবহার্যে পরিণত হয়েছে।

১৮৯৯ থেকে ১৯২১ সালের মধ্যে লেখা ১৩টি নোটবুক পাওয়া যায়, যার মধ্যে ২ হাজার ৫০০ চিত্রকর্ম ছিল। সেখানে তিনি উড়োজাহাজ ও উড্ডয়ন নিয়ে আঁকাবুঁকি করেছেন। এটি ১৯৬৯ সালের দিকে তা প্রকাশিত হয়। বলে রাখা ভালো, সে বছরই মানুষ চাঁদে অবতরণ করে। হ্যারি গ্র্যান্ট ডার্ট ১৯০৮ সালে প্রকাশিত তার ‘‌দ্য এক্সপ্লোরিগেটর’ কমিক বুকে নিজের মতো করে ওড়ার চিন্তা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি কার্টুনিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন ‘‌লাইফ অ্যান্ড জাজ’ ম্যাগাজিনে। 

১৮২৪ সালে রবার্ট ওয়েন ‘‌দ্য মার্চ অব দ্য ইন্টেলেক্ট’ নামে একটা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান। তিনি একটা সামাজিক পরিবর্তনের ইশারা দিয়েছেন। আর তার ধারণাকে সমালোচনা আকারে হাজির করে উইলিয়াম হিথের চিত্রকর্ম। তিনি লন্ডন থেকে বাংলা পর্যন্ত টানেল আঁকেন। এঁকে দেখান উড়ন্ত মেল। উঠে আসে বৈশ্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থা। কতকটা ব্যঙ্গাত্মক হলেও মন্দ না। উনিশ শতকের জার্নালগুলোয়ও বিভিন্ন আবিষ্কার ও সম্ভাবনা নিয়ে আঁকা হতে থাকে চিত্রকর্ম। ১৮৮৮ সালে আমেরিকার সাংবাদিক ডেভিড গুডম্যান ক্রোলি বিশ্বজুড়ে নারী স্বাধীনতার ভবিষ্যৎ নিয়ে সম্ভাবনা প্রকাশ করেন। এ ধারণাকেও চিত্রে তুলে আনেন হ্যারি গ্র্যান্ট ডার্ট। আঁকেন তার ‘‌হোয়াই নট গো টু দ্য লিমিট?’ অনেকটা সমালোচনার আকারে। ১৯২০ সালের দিকে ফরাসি কারখানার বেজমেন্টে ১০০ পোস্টকার্ড পাওয়া যায়। দেখিয়েছেন উড়ন্ত যন্ত্রপাতি, টেলিস্কোপ, গ্রহ, রোবট ও সমুদ্রের নিচের ফার্ম। তার পেছনে রয়েছেন চিত্রকর জ্যাঁ মার্ক কোতে। তিনি মূলত প্রভাবিত হয়েছিলেন জুল ভার্নের সাহিত্যকর্মে। সে সূত্রেই তৈরি করেছেন বেশকিছু চিত্রকর্ম। কোতেকে দেখা যায় উড়োজাহাজ ও নানা রকমের আকাশযানের চিত্র আঁকতে। এমনকি এ ধরনের যান কীভাবে যুদ্ধকে প্রভাবিত করতে পারে, তাও দেখিয়েছেন তিনি। সে সময়ে কিছু খেলনাও ছিল এসব নিয়ে, খুব সম্ভবত সেসব তাকে প্রভাবিত করেছে। তিনি হেলিকপ্টারের মতো যান কল্পনা করেছেন, যা যুদ্ধের সময় ব্যবহার করা যেতে পারে। তার দেখা ভবিষ্যতের বড় একটা অংশ এখন বাস্তব। জ্যাঁ মার্ক কোতের সে আঁকাগুলো ২০২১ সালে প্যারিসে বিক্রির জন্য ওঠে।  প্রতিটি ছবিই যেন একটি মিনিয়েচার ছোটগল্প। কার্ডগুলো তৈরি করা হয়েছিল মূলত একটি কোম্পানির জন্য। কিন্তু ১৮৯৯ সালে কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা মারা গেলে তা বন্ধ হয়ে যায়। এই আঁকাআঁকিগুলো পরবর্তী সময়ে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর লেখক আইজ্যাক আসিমভের লেখালেখিতে অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করে। 

১৮৯৮ সালে আণবিক শক্তির সক্ষমতা সম্পর্কে আলোচনা জনপ্রিয়তা পায়। আর এ জনপ্রিয়তা পায় অল্প সময় আগে রাসায়নিক মৌল রেডিয়াম আবিষ্কৃত হওয়ার পর। সে সময় রেডিয়েশনের নেতিবাচক দিক সম্পর্কে ধারণা ছিল না। সেভাবেই তারা হাজির করেছেন ভবিষ্যৎকে। সে আমলের সব চিত্রকর যে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী ছিলেন, তা না। কেউ কেউ ছিলেন বিস্তর হতাশাবাদী। কিন্তু তারা আজকের দিনকে এঁকেছেন কল্পনার মিশেল দিয়ে। তাদের অনেক কথাই হয়তো বাস্তব হয়নি পরবর্তী সময়ে, তবে কিছু কথা বাস্তব হয়েছিল। প্রযুক্তিগত আবিষ্কার দিয়েই তো আর ভবিষ্যৎ"হয় না। শিল্পীমাত্রই ভবিষ্যদ্বাদী। উদাহরণ হিসেবে মাইকেলেঞ্জেলো কারাভাজ্জিওর কথাই ধরা যাক। ১৫৯৭-৯৯ সালের মধ্যে তিনি এঁকেছেন তার বিখ্যাত ‘‌নার্সিসাস’ চিত্রকর্ম। নার্সিসাস গ্রিক পুরাণের চরিত্র। দেবীর অভিশাপে যে নিজের প্রতি মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মৃত্যুবরণ করে। প্রথম দেখাতেই যে কারো কাছে বর্তমান সময়ের সেলফি সংস্কৃতির কথা মনে হবে। আধুনিক সময়ে সবাই যেন ডুবে আছে নিজের প্রতি মুগ্ধতা নিয়ে। এটাও কি এক ধরনের ভবিষ্যৎ দেখা নয়?

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন