আলপনায় বাংলার কৃষি ও শিল্পের যৌথ পরম্পরা

আহমেদ দীন রুমি

ছবি: ফাইল/ নিজস্ব আলোকচিত্রী

‘উত্তম সাইলের চাউল জলেতে ভিজাইয়া। 

ধুইয়া মুছিয়া কন্যা লইল বাটিয়া॥ 

পিটালি করিয়া কন্যা পরথমে আঁকিল। 

বাপ আর মায়ের চরণ মনে গাঁথা ছিল॥ 

জোরা টাইল আঁকে কন্যা আর ধানছড়া। 

মাঝে মাঝে আঁকে কন্যা গিরলক্ষ্মীর পাড়া

. . . . . 

সূইচ রাজার ছবি আঁকে পাত্রমিত্র লইয়া। 

নিজেরে না আঁকে কন্যা রাখে ভাড়াইয়া॥ 

আলিপনা আঁইক্যা কন্যা জ্বালে ঘির্‌তের বাতি। 

ভূমিতে লুটাইয়া কন্যা করিল পন্নতি॥

কাজলরেখায় এভাবেই বিবৃত হয়েছে নায়িকার আলপনা আঁকার আখ্যান। বাংলার লোকজ ঐতিহ্যের স্মারক মৈমনসিংহ গীতিকা আর তাতে একমাত্র রূপকথা কাজলরেখা। সাধু ধনেশ্বর অর্থনৈতিক দুর্ভাগ্যের কারণে কন্যা কাজলরেখাকে নির্জন বনের ভাঙা মন্দিরে রেখে আসে। সেখানে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে স্বামীর রাজ্যে দাসী হয়ে বাস করতে থাকে কাজলরেখা। দাসী অবস্থায় সে আলপনা আঁকে মনের মাধুরী মিশিয়ে। বলতে গেলে সবকিছুই আঁকা হয়। কেবল নিজেকে আঁকল না কাজলরেখা। আঁকা শেষ হলে সে ঘিয়ের বাতি জ্বেলে মাটিতে প্রণাম জানায়। সবাই তার অবিশ্বাস্য মনোরম আলপনা দেখতে আসে। দেখে নিশ্চিত হয় এ কোনো ভদ্রবংশের কন্যা।

আলপনা আবহমানকাল ধরেই বাংলায় চর্চিত শিল্পমাধ্যমগুলোর একটি। এ অঞ্চলের বিভিন্ন উৎসবে নারীরা আলপনা আঁকে আড়ম্বরের সঙ্গে। ঘরের মেঝে কিংবা উঠান হয়ে ওঠে তাদের স্বপ্নের ক্যানভাস। কাপড়ের টুকরো পরিণত হয় তুলিতে, তাতে বিম্বিত হয় প্রাকৃতিক নানা অনুষঙ্গ। চালের গুঁড়া পানিতে ভিজিয়ে ব্যবহার করা হয় প্রাকৃতিক রঙ হিসেবে। ঐতিহাসিকভাবেই সাদা এখানকার আলপনা ঐতিহ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রঙ।

মানবজাতির ভাষাতাত্ত্বিক যোগাযোগের আদিম অনুষঙ্গ চিত্রকলা। চিত্রকলাই সময়ের ব্যবধানে রূপ নিয়েছে বর্ণমালায়। ভাষার ইতিহাস এমনটাই হাজির করে সামনে। তবে প্রায়ই চিত্রকলা নিজেই প্রকাশিত হয়ে পড়ে আলপনা আকারে। তখন চিত্রের ভেতর দিয়েই মূর্ত হয় মানুষের চিন্তার গতিবিধি। সেক্ষেত্রে পেছনে প্রধান অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে লোকজ ধর্মবিশ্বাস ও জীবনাচার। তার সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মধ্যে চর্চিত আলপনার বিষয়বস্তু। সেদিক থেকে দেখলে আলপনায় বঙ্গীয় অঞ্চলের অস্ট্রিক ও দ্রাবিড়ীয় শেকড় খুঁজে পাওয়া যায়। প্রাচীন আমল থেকেই মানুষের বিশ্বাসকে প্রকাশ করার ভঙ্গি ছিল চিত্রকর্ম। তারপর সমাজ পরিবর্তনের নানা বাঁকে শিল্পকাঠামোয় পরিবর্তন এসেছে। কাছ থেকে দেখলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে এ পরিবর্তন সহজেই চোখে পড়ে। আলপনার ইতিহাস পাঠের মধ্য দিয়ে তাই সামাজিক বিবর্তনকেও পাঠ করা সম্ভব।

আলপনা শব্দটি সম্ভবত এসেছে আলিপোনা থেকে। আলিপোনা মানে আইল অথবা বাঁধ দেয়া। কাজলরেখাতেও আলিপনা হিসেবেই উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাচীন কোনো শিল্পবিষয়ক গ্রন্থে আলপনার উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে কোথাও কোথাও রঙ্গবলীর উল্লেখ পাওয়া যায়। রঙ্গবলী হলো রঙ দিয়ে করা লতানো নকশা, যা একধরনের আলপনাই। আলপনার সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা পাওয়া যায় পরবর্তীকালে লিখিত কাজলরেখা ও অন্যান্য গ্রন্থে। লোকজ ঐতিহ্য হওয়ার কারণে আর প্রাচীন নির্ভরযোগ্য দলিলের অভাবে আলপনার ইতিহাস ও কাল নিরূপণ করা যথেষ্ট কঠিন। অনেক পণ্ডিতই আলপনার মধ্যে আর্যপূর্ব ঐতিহ্যের ঘ্রাণ খুঁজে পান। আলপনার উত্তরাধিকার অস্ট্রিক ও দ্রাবিড়ীয় জাতিগোষ্ঠীর কাছ থেকে আসা। অস্ট্রিকরা আর্য প্রভাবের অনেক আগে থেকেই এ অঞ্চলে বসবাস করে আসছে। ধর্মীয় আচারসংবলিত ও ঐতিহ্যগত লোকশিল্পগুলো প্রকৃতপক্ষে কৃষি যুগে শস্যের প্রচুর উৎপাদন ও অপদেবতা বিতাড়নের নিমিত্তে উদ্ভূত। কৃষি সভ্যতায় উৎপাদনকে ঘিরে নানা রকম বিশ্বাস, আচার ও শিল্পকর্ম পৃথিবীর অন্য প্রান্তেও দেখা যায়। আলপনার সর্পিল রেখাগুলো প্রায়ই যেন আদিম জীবনের ইঙ্গিতবাহী। তখনকার জাদু বিশ্বাসকেন্দ্রিক জীবনাচার, প্রকৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, কৃষি ও পশু পালন বিম্বিত হয়েছে তুলিতে। এক সময়ের সর্পিল রেখা আকার নিয়েছে লতার। শিকার সভ্যতা ও পশু পালননির্ভর সমাজের সময় থেকেই পায়ের ছাপ মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের নানা অনুষঙ্গ বদলালেও পায়ের ছাপ বদলায়নি। তা আলপনা আকারে প্রবেশ করেছে চিত্রকলার মধ্যে। আলপনায় ঘরমুখী পায়ের ছাপকে মনে করা হয়েছে শুভ লক্ষণ। বিভিন্ন প্রাণীর অনুষঙ্গ প্রবেশকে আদিম টোটেমভিত্তিক কৌম চেতনার উপস্থিতির ইঙ্গিতকে ধরে নেয়ার দাবিকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না। এর বাইরে আলপনায় নারী ও শিশুর উপস্থিতিকে কৃষিভিত্তিক সমাজের উর্বরতার প্রতীক হিসেবে দেখা যায়। সাধারণত কৃষিপ্রধান সমাজে নারীকে উর্বরতার রূপকার্থে দেখা হয়। এদিকে কখনো পৌরুষ আর কখনো নতুন ভোরের প্রতীক হিসেবে হাজির হতে দেখা যায় সূর্যকেও। আলপনায় ব্যবহৃত মোটিফ হিসেবে থাকে সূর্য, ধান গাছ, পেঁচা, মই, লাঙল, মাছ, পান, পদ্ম, শঙ্খলতা, সিঁদুর কৌটা ইত্যাদি। রূপক আকারে থাকে জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত নানা অনুষঙ্গ।  

আলপনা উৎসবের সাজ। সাধারণত মেঝে কিংবা আঙিনায় আলপনা হয়। সিলিং বা দেয়ালে আলপনার নজির খুব কম। আলপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো অলংকরণ। সম্ভবত এর বৈচিত্র্যের সূত্র ধরেই বিষয়বস্তু কালক্রমে পরিবর্তিত হয়েছে নানাভাবে। ঐতিহ্যপ্রবণতার পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে আধুনিক বিমূর্ত ধারণা। দীর্ঘ এ ক্রমবিবর্তনের পথে একটা বিশেষ প্যাটার্ন বিদ্যমান। স্থায়ী এ প্যাটার্নের কারণেই বিশেষ অবস্থান তৈরি করেছে স্থানীয় জনপদের মধ্যে। বিভিন্ন উৎসবের জন্য নির্দেশক আলপনাও থাকে। এভাবে চিত্রের মধ্য দিয়ে বিবৃত হয় কোনো গল্প। এ কারণেই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও এস রায় আলপনাকে হায়ারোগ্লিফিক ঘরানার অঙ্কন হিসেবে দাবি করেন। কারণ আলপনায় সংরক্ষিত হয়ে আসছে পুরনো দিনের কথা। তবে পুরনো দিনকে অতিক্রম করে আধুনিক চিত্রকলায়ও আলপনার প্রভাব ছড়িয়েছে। যামিনী রায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দেবীপ্রসাদ ও সত্যজিৎ রায়ের চিত্রাঙ্কনে আলপনার প্রভাব দেখা যায়।

আলপনায় বিষয়বস্তুতে কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। এটা এমন একধরনের লোকশিল্প, যা অনেকটাই মানুষের সহজাত অভিব্যক্তি আকারে প্রকাশিত হয়। একদিকে যেমন সমাজের অতীত অভিজ্ঞতা প্রকাশ পায়, অন্যদিকে ফুটে ওঠে বর্তমান। উপমহাদেশের নারীরা লোকশিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছে নতুন আঙ্গিক ও বর্ণের সংযোজনের মাধ্যমে। তাদের সৃজনশীলতায় আঙিনায় মূর্ত হয়ে ওঠ ঋতু বৈচিত্র্য। হিন্দু নারীদের ব্রত পালনে কাদামাটির প্রতিকৃতি ও আলপনা একটি জরুরি অনুষঙ্গ। নানা নকশায় তারা অলংকৃত করে তোলে তাদের ঘর ও ঘরের মেঝে। প্রচলিত রীতির সঙ্গে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে সৃষ্টি করে আপন ভুবন। নকশার মূল উপাদান হয়ে থাকে চালের গুঁড়া, পানিতে গোলানো চালের মণ্ড, শুকনো পাতা গুঁড়িয়ে তৈরি রঙের গুঁড়া, কাঠকয়লা ও পোড়ামাটি। বিষয়বস্তুর প্রয়োজনে রঙের ব্যবহারে বৈচিত্র্য মেনে নেয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন প্রজন্মের চিত্রকরদের সুবিধার্থে আলপনার উপস্থাপনা ব্যাপকভাবে যুগের প্রচলিত রীতিতে মূর্ত হয়ে ওঠে। সম্ভবত এজন্যই নির্মাণশৈলীর দিক থেকে একধরনের গতানুগতিকতাও পরিলক্ষিত হয়। তার পরও প্রচলিত রীতির মধ্যে থেকেই আলপনা তার ঐতিহ্যগত বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করতে সক্ষম। আলপনার এমন স্বাতন্ত্র্য ও সক্ষমতাই তাকে দিয়েছে সূক্ষ্ম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। 

বর্তমান যুগে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আলপনা অঙ্কন করা হয়। একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও মিনারসংলগ্ন সড়কগুলোয় আলপনা করা হয়। বিভিন্ন স্থানে আলপনা করা হয় নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষেও। বাংলার বাইরে দক্ষিণ ভারতের তামিল জনগোষ্ঠীর মধ্যে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের কৃষিভিত্তিক সমাজের মধ্যে আলপনার ঐতিহ্য দেখা যায়। দক্ষিণ আমেরিকায়ও দেখা যায় পানি, ব্যাংক, ইঁদুর ও পেঁচার আলপনা। তবে আধুনিক বাংলাদেশে আলপনা ধর্মীয় বলয়ের বাইরে নতুন চরিত্র গ্রহণ করেছে। আলপনা সব সময়ই সমকালীন জীবন ও প্রকৃতিমুখী। সেই বৈশিষ্ট্য যতদিন জারি থাকবে ততদিন প্রাসঙ্গিকতা হারাবে না। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন