শাড়ির জমিনে জীবনের গান

তোফাজ্জল হোসেন

ছবি: লেখক

২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটনের গেটওয়ে আর্ট সেন্টারে হয় ‘হার ওয়ার্ডস: স্টোরিটেলিং উইথ শাড়িজ’ প্রদর্শনী। শাড়ির মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রসঙ্গ। অভিনব এ প্রতিবাদের জন্য প্রশংসায় ভাসলেন পেছনের মানুষ মনিকা জাহান বোস। তার শেকড় বাংলাদেশের কাটাখালী। সেখানকারই ১২ জন নারীকে সঙ্গে নিয়ে ২৪টি শাড়ি তৈরি করেছিলেন তিনি। পাশাপাশি তৈরি করেছিলেন তথ্যচিত্র। মূলত এ প্রকল্পের জন্য সমধিক পরিচিত হলেও কর্মক্ষেত্র ছড়িয়ে আছে চিত্রকলা, প্রিন্টমেকিং, পারফরম্যান্স ও চলচ্চিত্রের মতো বিভিন্ন প্রকল্পে। কাজের মধ্যে বিম্বিত হয় লিঙ্গবৈষম্য, নারীর সমতা ও জলবায়ু পরিবর্তন। তার অভিব্যক্তিতে শাড়ি হয়ে ওঠে ক্যানভাস আর পরিবেশের নানা অনুষঙ্গ হয় প্রতীক। এমন অভিনব উদ্যোগ সম্পর্কে বলতে গিয়ে মনিকা বলেন, ‘আমি ১০ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছি জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে। আমার সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন ১২ জন কৃষাণী। অনেক আগে থেকেই মাথায় চিন্তা ছিল, কীভাবে করা যায় কাজটা। পরে ভাবলাম শাড়িটাকে ক্যানভাস হিসেবে ব্যবহার করলে ভালো হয়। আমাদের দেশের মেয়েরা আসলে শাড়ির ওপরই শিল্পকর্ম করে। তাছাড়া শাড়িটা এমন একটা জিনিস, যা আমরা কোনোদিন ফেলি না।’ 

মনিকা চারুকলায় পড়াশোনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে করেছেন ডক্টরেট। এক বছরের ডিপ্লোমা করেছেন শান্তিনিকেতনে। ২০০৬ সালে তিনি ছিলেন ফ্রান্সের প্যারিসে। মূলত এ সময়টাতেই তার আঁকা ও স্থাপনা শিল্পে ব্যাপকভাবে উঠে আসতে শুরু করে শাড়ি। তার কাজের স্বীকৃতিও পেয়েছেন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। তার কাজ প্রকাশিত হয়েছে মিয়ামি হেরাল্ড, ওয়াশিংটন পোস্ট, আর্ট এশিয়া-প্যাসিফিক, মিলওয়াউকি সেন্টিনেল, দ্য হনুলুলু স্টার অ্যাডভার্টাইজার, দ্য জাপান টাইমস ও বাংলাদেশের প্রধান সব পত্রিকায়। তিনি বলেন, ‘আমি থাকি আমেরিকায়। আমেরিকানদেরও আমি শাড়ির ওপর আমার সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করতে আমন্ত্রণ দিই। শাড়িগুলো নানাভাবে ব্যবহার করি। মাঝে মাঝে পরি। পারফরম্যান্স করি। অভিনয় শিল্প, চিত্রকলা ও ইনস্টলেশন করি।’ 

তবে জলবায়ু নিয়ে তার সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি। যেহেতু জলবায়ু সংকট নিরসন হয়নি, তাই তিনিও এ প্রকল্প অগ্রগামী রাখতে বদ্ধপরিকর। তিনি তার সৃজনশীলতার মধ্য দিয়েই তুলে ধরতে চান, গ্রামের মেয়েরা খুবই সমস্যায় পড়েছে। তাদের ফসল ঠিকমতো হচ্ছে না। অসময়ে বৃষ্টি হচ্ছে। নতুন কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণেও তৈরি হচ্ছে সমস্যা। তার দাবি, ২০২১ সালে পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র খোলার পর থেকে বেশকিছু নেতিবাচক প্রভাব প্রত্যক্ষ করছে আশপাশের মানুষজন। সেখানকার নারকেল গাছেও এখন আগের মতো ফলন হচ্ছে না। গ্রামের মেয়েরা অনেক চিন্তিত। তাদের শিশুদের এখন সর্দি-কাশি বেড়েছে আগের চেয়ে। তিনি বলেন, ‘আমার উদ্দেশ্য হলো সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করা। মানুষ হিসেবে আমরা কী সমাধান করতে পারি তার বের করা। তার জন্য আমরা সরকারের কাছেও চাইতে পারি, নিজেরাও করতে পারি।’ 

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো। আর এজন্য পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের নাম রয়েছে আশঙ্কাজনক দেশের তালিকায়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বাংলাদেশের তিন কোটি মানুষ ভূমিহীন হয়ে যেতে পারে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের জেরে। সেদিকে ইঙ্গিত দিয়ে মনিকার ভাষ্য, ‘আমি আসলে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ নিয়ে প্রতি বছরই নতুন ব্লক বানাই। কিছু মেসেজ আছে। যেমন একটা শাড়ির মধ্যে দেখা যায় গোলাপি ঢেউ, যেখানে তুলে আনা হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানির উচ্চতা ও উষ্ণতা বৃদ্ধির কথা। অনেকগুলো ব্লক বানিয়েছি সৌরবিদ্যুৎ নিয়ে। কারণ সৌরবিদ্যুৎ খুবই উপকারি উপায়। তাছাড়া বায়ুবিদ্যুতের ব্লকও বানিয়েছি কয়েকটা। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে আছে গাছ।’ 

মনিকার নানাবাড়ি কাটাখালী। যেখানে প্রায়ই আঘাত হানে সিডর, আইলা ও মহাসেনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রকৃতির সেই ভয়ানক পরিবর্তনকেই যেন বিশ্বমঞ্চে হাজির করার তপস্যায় মগ্ন মনিকা। নেমেছেন সবার দৃষ্টি এদিকেই তাক করতে, সে পথে তার সফলতা গৌণ নয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন