ডেথ সেনটেন্স ও কিছু প্রশ্ন

মো. বজলুর রশিদ শাওন

শিল্পী: আনিসুজ্জামান সোহেল

আমেরিকান নিও কনসেপচুয়ালিস্ট চিত্রশিল্পী মার্ক লম্বোর্ডি / লম্বোর্দি (১৯৫১-২০০০ সাল) তার বিখ্যাত George W. Bush, Harken Energy, and Jackson Stephens, ca 1979–90 নামক ডায়াগ্রামধর্মী শিল্পকর্মের (ড্রয়িং) মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন জর্জ ডব্লিউ বুশ (তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট) এবং ওসামা বিন লাদেনের পরিবার দুটি ভিন্ন ধাপে অবস্থান করা সত্ত্বেও কীভাবে জেমস বাথের মাধ্যমে তারা দুজনের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন এবং টেক্সাস থেকে বিশ্বব্যাপী তাদের ব্যবসা পরিচালনা করতেন, যে অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে আগে থেকেই ছিল। ২০০৩ সালের আমেরিকার টুইন টাওয়ারের হামলা যেটাকে ‘নাইন ইলেভেন’ বা ‘সেপ্টেম্বর ১১ অ্যাটাক’ নামে অভিহিত করা হয়। যে ঘটনার পর তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে আমেরিকা ও তার মিত্ররা এবং আফগানিস্তানে হামলা করে। বলা হয় ৭০ হাজার বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে এ যুদ্ধে। মার্ক লম্বোর্ডি ২০০০ সালের ২২ মার্চ আত্মহত্যা করেন। দিনটি ছিল তার জন্মদিনের ঠিক আগের দিন। আত্মহত্যার আগের দিন তিনি তার কাজ নিজ বাড়ি থেকে অন্যত্র সরিয়ে ফেলেছিলেন। যা তার মৃত্যুর পর বিখ্যাত আমেরিকান ইতিহাসবিদ ও কিউরেটর রবার্ট হবসের (Robert Hobbs) কিউরেশনে আয়োজিত Mark Lombardi: Global Networks নামক প্রদর্শনীর মাধ্যম দর্শকের সামনে আসে। সেই প্রদর্শনী থেকে লম্বোর্ডির আরো অসংখ্য ডায়াগ্রামভিত্তিক শিল্পকর্ম দেখার সুযোগ পায় দর্শক, যেখানে তিনি দেখিয়েছিলেন ক্ষমতার অপব্যবহার করে ক্ষমতাসীনরা কীভাবে জালিয়াতি করে যুদ্ধাবস্থার অবতারণা করতেন। যুদ্ধকে ঘিরে কীভাবে ব্যবসা সংগঠিত হয়। কারা কীভাবে কোন যুদ্ধে জড়িত ছিলেন এ রকম অসংখ্য ড্রয়িং। প্রশ্ন হলো লম্বোর্ডিকে কেন আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছিল? কোন আর্থসামাজিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ক্ষমতা কাঠামোর জৌলুসপূর্ণতার হেজিমনির অধীনে একজন শিল্পীকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছিল? এটা কি নিছকই আত্মহত্যা? নাকি হত্যা ছিল? 

আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বেশির ভাগ দেশেই আত্মহত্যাকে আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে দেখা হয়। সেই মোতাবেক আইন আছে। এমনকি কাউকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা করা কিংবা কেউ আত্মহত্যা করবেন এটা আরেকজন জানা সত্ত্বেও সেটা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে না জানানোটাও তার অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। তো এ ধরনের আইন দ্বারা বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থার অধীনে প্রত্যেকটি জীবনকে যেভাবে মূল্যায়ন করা হয় তা কি এতটাই সরল? সরল না বলেই একমাত্র বৈধভাবে খুনের স্বীকৃতি আছে রাষ্ট্রীয় কিছু প্রতিষ্ঠানের তার নিজস্ব সীমানার মধ্যে। আর সার্বভৌমত্বের নামে রাষ্ট্রীয় সীমানার বাইরেও বিশ্বব্যাপী কিছু আইনকানুন তৈরি হয়েছে যুদ্ধের আইন নামে। কিন্তু এর কোনোটাই নিষ্কণ্টক তো নয়ই, বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তার স্ববিরোধী ও আগ্রাসী রূপে প্রতিভাত হয়। 

‘ডেথ সেনটেন্স’ শিরোনামে বেঙ্গল শিল্পালয়ে চলা একটি প্রদর্শনী এ রকম অসংখ্য প্রশ্ন নিয়ে হাজির হয়েছে আমাদের সামনে। কিউরেটর জুয়েল এ রবের তত্ত্বাবধানে পাঁচজন (আনিসুজ্জামান সোহেল, ইমরান সোহেল, প্রমথেশ দাস পুলক, নাজমুন্নাহার কেয়া ও শিমুল দত্ত) সমসাময়িক দৃশ্যশিল্পীর বিভিন্ন মাধ্যমের কাজ নিয়ে চলমান এ প্রদর্শনী আমাদের দৃশ্য শিল্পের পরিমণ্ডলে যুদ্ধ, সহিংসতা, অস্ত্র কিংবা এর ইতিহাস, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সম্পর্কের প্রপঞ্চগুলোকে পুনরায় মূল্যায়ন করতে সাহায্য করবে। কিউরেটর ‘ডেথ সেনটেন্স’কে শিরোনাম ধরে এগোলেও শুধু প্রাতিষ্ঠানিক মৃত্যুদণ্ড প্রক্রিয়ার আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার সীমারেখায় আটকে রাখেননি তার চিন্তা। বরং ইতিহাসের ধারায় মৃত্যুদণ্ড, সহিংসতা এবং সহিংসতায় ব্যবহৃত অস্ত্রের বিবর্তন ও বিকাশ এমনকি এর ধরন ও রাজনীতি, অর্থনীতি সর্বোপরি ক্ষমতাবলয়ে এর ধারণা ও প্রয়োগ সবকিছুকেই একত্র করেছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অস্ত্রের নকশা বা সজ্জা, তার ইতিহাস, ধরন ও বিবর্তন এবং এর সঙ্গে শিল্পীদের সংযুক্তি। অর্থাৎ জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো প্রাণঘাতী অস্ত্র শিল্পে শিল্পীরা তাদের নান্দনিক চিন্তার যে ছাপ রেখেছেন সে প্রাসঙ্গিকতাও হাজির হয়েছে। ফলত যে বিশাল চিন্তার ব্যাপ্তি এ প্রদর্শনীর ধারণাপত্রে যুক্ত রয়েছে তার পুরোটা হয়তো আমরা এই একটা প্রদর্শনীতে পাব না, এমনকি সেটা আশা করাও অনেক ক্ষেত্রে অবান্তর। পাঁচজন শিল্পীরই বিভিন্ন মাধ্যমের একাধিক কাজ রয়েছে এ প্রদর্শনীতে।

শিল্পী আনিসুজ্জামান সোহেলের কাজে ইতিহাসে যুদ্ধের ফলে ঘটে যাওয়া ধ্বংসাবশেষ, মানবসৃষ্ট বীভৎসতা ও তার রাজনীতি এবং এর ফলাফল। ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোকে শিল্পী ত্রিমাত্রিক বিভিন্ন মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন, যার মধ্যে মানুষের মাথার খুলির ওপরে কলোসিয়ামের যে প্রতীকায়ন দর্শককে সভ্যতার বীভৎসতাকে হেরিটেজের নামে ভুলতে দেয় না তেমনি কালো চাদরের ওপর গাজা উপত্যকার ম্যাপে ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলের আগ্রাসনকেও বারবার সামনে আনতে থাকে। এমনকি ঔপনিবেশিক শাসনের রূঢ় চিহ্নও আছে তার কাজে। বিশেষ করে ক্ষুদিরামের ফাঁসির মঞ্চ সেদিকেই ইঙ্গিত দেয়। এমনকি দ্বিমাত্রিক পটেও তা দেখা যায়। শিল্পী ইমরান সোহেলের কাজে রয়েছে ভবিতব্যের স্বপ্নময়তা। একটা কাল্পনিক ডিকশনারি তৈরি করেছেন তিনি, যেখানে নেই কোনো ধ্বংসাত্মক শব্দ এবং অস্ত্র কেটে কফিনে রেখেছেন। আবার এর বিপরীতে তার দ্বিমাত্রিক চিত্রপটে রয়েছে বীভৎসতার প্রকাশ। ফলত একধরনের স্ববিরোধিতাও দেখা যায় তার কাজে। শিল্পী প্রমথেশ দাস পুলকের কাজেও একধরনের রোমান্টিক বা স্বাপ্নিকতার ছাপ আছে। আগ্নেয়াস্ত্রকে শোলার ফুলে মুড়িয়ে দেয়া, পুরনো হাতিয়ারের নকশাকে প্রণিধান করে তোলা কিংবা সামরিক বাহিনীর যুদ্ধের বাঁশি থেকে গ্রামোফোনের ডিস্কের বদলে বুলেটের ছোঁয়ায় মৃদু আওয়াজের শান্তির ডাক সেদিকেই ইঙ্গিত করে। শিল্পী নাজমুন্নাহার কেয়ার কাজে যুদ্ধের ঐতিহাসিক ছবির দলিল থেকে অস্ত্রকে বিশেষত্ব দেয়া কিংবা বীভৎসতাকে পুনর্বার দর্শকের সামনে নিয়ে এসেছেন। এমনকি কাপড়ের মাধ্যমে হাম্বুরাবির আইন কিংবা বিভিন্ন সময়ে মৃত্যদণ্ডে ব্যবহৃত কৌশলের (হেমলক, নাইট্রোজেন গ্যাস ইত্যাদি) সরাসরি নামের উপস্থাপনা রাষ্ট্র বা ক্ষমতা কাঠামো কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থাকে উপস্থাপন করে। শিল্পী শিমুল দত্তের কাজেও এর ব্যতিক্রম দেখা যায়নি। বিভিন্ন সময়ের অস্ত্র এবং অস্ত্রের নকশাকে জাদুঘরে উপস্থাপনের আদলে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন তা মূলত সহিংসতা ও সভ্যতার বিকাশে যুদ্ধের ধারণাকেই সামনে নিয়ে আসে।

যুদ্ধ ও সহিংসতা, বীভৎসতাকে সবসময়ই কি একপক্ষীয় বা নেতিবাচকভাবে দেখার সুযোগ থাকে? এতটা সরলভাবে দেখার সুযোগ আছে কি আদৌ? তাই যদি হয় তাহলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কি নেতিবাচক? আর ভাবালুতা কিংবা কল্পনায় তাকে প্রতিরোধ করাটাও কি যথেষ্ট? নাকি শিল্পীরা এতটুকুই পারে? এ ব্যাপারগুলোকে আরো তলিয়ে দেখার সুযোগ রয়েছে। কেননা চলমান এ প্রদর্শনীতে বেশির ভাগ শিল্পীর কাজেই বিষয়বস্তুকে আক্ষরিক উপস্থাপনা ও রোমান্টিকভাবে দেখার প্রবণতা রয়েছে; যা তাদের উপস্থাপনার ভঙ্গি, করণকৌশল ও মাধ্যম খেয়াল করলে স্পষ্ট হওয়া যায়। কেননা ভাষার বিচারে সিগনিফায়েডকে শুধু নান্দনিকভাবে ব্যবহার করলেই সেটা মূল বিষয়ের রূপক (মেটাফোর) হিসেবে নির্মিত হয় না, বরং তা আক্ষরিকভাবেই দেখার সুযোগ তৈরি করে বেশি। তাই শিল্পীরা শিল্পের মাধ্যমকে তার বিষয়বস্তুর সঙ্গে সংগতি রেখে এমনভাবে উপস্থাপন করেন যে অনেক দূরবর্তী সিগনিফায়েডও রূপক হয়ে উঠতে পারে। শিল্পী আনিসুজ্জামান সোহেল ব্যতিক্রম এক্ষেত্রে। এ প্রদর্শনীতে শিল্পী আনিসুজ্জামান সোহেলের কাজে এ রকম বেশকিছু উদাহরণ রয়েছে যেখানে বিষয়বস্তুর রূপকায়ন ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ তার ত্রিমাত্রিক অবজেক্ট মাথার খুলির ওপর কলোসিয়াম কিংবা চার্চের বেলের আদলে তৈরি ইনস্টলেশন এমনকি আগে উল্লেখ করা ক্ষুদিরামের ফাঁসির মঞ্চও।

মূলত পশ্চিমা দৃশ্য শিল্পের ধারায় আমাদের দেশে এ ধরনের শিল্পমাধ্যম ও ধারণা এবং কিউরেটোরিয়াল চর্চা চালু হয়েছে যা আমাদের বাস্তবতায় আরো বিশদাকারে ভেবে দেখার সুযোগ রয়েছে। যে কারণেই শুরতে আমেরিকান শিল্পী লম্বোর্ডির উদাহরণটা এসেছে। কেননা নিজস্ব বাস্তবতায় লম্বোর্ডি যেভাবে এগিয়েছেন সেখানে শিল্পমাধ্যমের কোনো বিশেষত্ব না থাকলেও তা বিষয়বস্তুকে যথাযথভাবে তুলে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু ডেথ সেন্টেন্সে শিল্পমাধ্যমের যে ব্যাপকতা তা বিষয়বস্তুর সঙ্গে কতটা সংগতিপূর্ণ সে প্রশ্ন থেকেই এ আলোচনাটা প্রাসঙ্গিকতা পাচ্ছে। ফলে আমাদের বাস্তবতায় আমরা এ ধরনের বিষয়বস্তুর প্রায়োগিক রূপ কেমন হবে সেটা নিয়ে আরো বিশদ আলাপ ও চিন্তার সুযোগ থেকে যাচ্ছে। তবে এটাও সত্যি, এ ধরনের চর্চার ইতিহাস যেহেতু আমাদের দেশে খুব বেশি দিনের না সুতরাং এ রকম বাস্তবতার মধ্য দিয়েও আমাদের চিন্তার ও চর্চা বিকশিত হবে। এখানে কিউরেটরের চিন্তার ব্যাপ্তির সঙ্গে শিল্পীদেরও এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক: ভিজুয়াল প্রফেশনাল

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন