নতুন পাঠ্যপুস্তক বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী

আওয়ামী লীগ ছাড়া কেউ শিক্ষায় তেমন উদ্যোগ নেয়নি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন ছবি: পিএমও

আওয়ামী লীগ সরকার ছাড়া অন্য কেউ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, পঁচাত্তরের পর যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা দেশের মানুষকে নিরক্ষরতামুক্ত করার মতো তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এটা জাতির জন্য দুঃখজনক। ৯৬ সালে আমরা আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করি। তখন আমরা উদ্যোগ নিই, আমরা আবার নতুন করে শিক্ষা কমিশন গঠন করি। সাক্ষরতার হার বাড়ানোর জন্য একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করি। বয়স্কদের শিক্ষার ব্যবস্থাও সেখানে সংযুক্ত ছিল। তবে আওয়ামী লীগ সরকার ছাড়া কেউ শিক্ষার জন্য তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি এটাই বাস্তবতা।

গতকাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দেশের প্রাথমিক মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক বিতরণ কার্যক্রমের উদ্বোধনকালে তিনি এসব কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনগণকে যদি দারিদ্র্যমুক্ত করতে হয় তাহলে শিক্ষা হচ্ছে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। কাজেই সমগ্র জাতিকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার পদক্ষেপের অংশ হিসেবে আমরা নতুন শিক্ষা কমিশন গঠন করি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আমরা সেটা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। কারণ আমাদের পাঁচ বছরের সময়সীমা শেষ হয়ে গিয়েছিল। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসার পর তারা দেশকে আবার অন্ধকারের দিকেই ঠেলে দেয়।

তিনি বলেন, ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত আরেকটা অন্ধকার যুগ আমাদের জীবনে চলে আসে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে নৌকা মার্কায় মানুষ ভোট দেয়। আমরা আবার সরকার গঠন করি। তখন থেকে আমাদের আবার লক্ষ্য হয়, কীভাবে আমরা দেশের মানুষকে নিরক্ষরতামুক্ত করব। এর ধারাবাহিকতায় ২০১০ সাল থেকে আমরা বিনামূল্যে বই বিতরণ শুরু করি।

করোনাকালে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা অব্যাহত রাখতে সরকারের নানা উদ্যোগের কথা তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, করোনার সময় থেকে পর্যন্ত আমার ঘরে আমার স্কুল, অর্থাৎ এখন ডিজিটাল বাংলাদেশে ঘরে বসে পড়াশোনা। কেউ যাতে পড়াশোনায় ফাঁকি দিতে না পারে সেই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সংসদ টিভির মাধ্যমে সারা দেশে শিক্ষা কার্যক্রম চালানো হয়েছে। আবার বিটিভির মাধ্যমেও চালানো হয়েছে। আমি মনে করি, সংসদ টিভি শিক্ষা মন্ত্রণালয় সব সময় ব্যবহার করতে পারে।

বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, কভিড মহামারীর পরপরই এল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এর জের ধরে এখন সব জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী মানুষের কষ্ট বেড়েছে। এর মধ্যেও সরকার শিশুদের কথা ভোলেনি জানিয়ে তিনি বলেন, অন্যদিকে সাশ্রয় করে হলেও বই ছাপানোর দিকে আমরা বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছি। পাশাপাশি কম্পিউটার শিক্ষা অর্থাৎ প্রযুক্তি শিক্ষার দিকেও নজর দেয়া হয়েছে। বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েরা যেন পিছিয়ে না পড়ে সেদিকে লক্ষ্য রাখা হচ্ছে।

শিক্ষা সম্প্রসারণে আওয়ামী লীগ সরকারের নানা পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সাল থেকে পর্যন্ত ২৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৫৪টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, কৃষি, ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস, বিজ্ঞান প্রযুক্তি, চিকিৎসা, ডিজিটাল, ইসলামী-আরবি, টেক্সটাইল, মেরিটাইম, এভিয়েশন অ্যারোস্পেস, বেসরকারি ফ্যাশন প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আওয়ামী লীগ সরকার করে দিয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেছি। তাছাড়া হাই-টেক সিটি, হাই-টেক পার্ক এবং সফটওয়্যার প্রযুক্তি পার্ক স্থাপন করেছি। তাছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষাকেও আওয়ামী লীগ সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে, এরই মধ্যে দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স ডিগ্রি সমমর্যাদা দেয়া হয়েছে।

সরকারপ্রধান আরো জানান, সাধারণ শিক্ষা ধারার ৬৪০টি প্রতিষ্ঠানে ২০২০ শিক্ষাবর্ষ থেকে ভোকেশনাল কোর্স চালু করা হয়েছে। বর্তমানে ৬৪টি টেকনিক্যাল স্কুল কলেজের আধুনিকায়নের পাশাপাশি ১০০টি উপজেলায় ১০০টি টেকনিক্যাল স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করছি, ৭০টিতে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। ৩২৯টি উপজেলার প্রতিটিতে টেকনিক্যাল স্কুল কলেজ, চারটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ২৩টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, চারটি মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপনের কাজ চলমান, দুটি সার্ভে ইনস্টিটিউট নির্মাণাধীন।

প্রধানমন্ত্রী জানান, কারিগরি বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন মানবসম্পদ সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার হাজার ১৩৮টি বেসরকারি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ২০ হাজার ৬৪০ জন শিক্ষক-কর্মচারীকে এমপিওভুক্ত করেছে। এছাড়া ৩০০ এলাকায় ছয়টি করে মোট হাজার ৮০০টি মাদ্রাসার ভবন নির্মাণ আসবাবপত্র কেনার কাজ চলছে। ৬৫৩টি মাদ্রাসায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হয়েছে, মাদ্রাসা শিক্ষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। হাজার ১৫৪টি বেসরকারি মাদ্রাসা এবং লাখ ৬৩ হাজার ৬২ জন শিক্ষক-কর্মচারীকে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে।

তিনি বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির অংশ হিসেবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধকল্পে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জিটুপি পদ্ধতিতে উপবৃত্তি দেয়া হচ্ছে। মায়ের নামে মায়ের মোবাইল ফোনে বৃত্তির টাকা পাঠানো হচ্ছে।

এত কাজ করার পরও কিছু লোকের মন ভরে না বলে অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের কথা তুলে তিনি বলেন, যদিও এত কাজ হচ্ছে, তার পরও কিছু লোকের মন ভরে না। তাতেও বলবে আমরা নাকি কিছুই করি নাই। এটা যারা বলে, সেই শ্রেণীটা চোখ থাকতেও দেখে না। দৃষ্টি থাকতেও তারা অন্ধ। তারা দেখবেই না।

তাদের মাথার ভেতরে নাই শব্দটা ঢুকে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা নাই-তে থাকতে চাই না। আমরা পারি। বাংলাদেশের মানুষ পারে। আমরা সেটাই প্রমাণ করতে চাই। নাই নাই শুনব না। আমরা করতে পারব, এটা করতে হবে।

স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যের কথা পুনর্ব্যক্ত করে শেখ হাসিনা বলেন, ২০৪১ সালে বাংলাদেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। আন্তরিকতার সঙ্গে আজ ছেলে-মেয়েদের যত আমরা তৈরি করতে পারব, আমাদের বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা কেউ থামাতে পারবে না।

প্রাথমিক মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বছরের বই বিতরণ কার্যক্রম অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, প্রাথমিক গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

বেশ কয়েক বছর ধরে বছরের প্রথম দিনটিতে স্কুলশিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেয়ার মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয় বই উৎসব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতি বছরই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেন। মাঝে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার কারণে দুই বছর সেই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়নি। তবে গতকাল ২০২২ সালের শেষ দিন শিক্ষার্থীদের হাতে আবারো বই তুলে দিয়ে সেই উৎসবের সূচনা করলেন প্রধানমন্ত্রী।

আজ শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় আলাদাভাবে পাঠ্যবই উৎসব উদযাপন করবে। জাতীয় শিক্ষাক্রম পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) হিসাব অনুযায়ী, এবার সারা দেশে কোটি লাখ ১৫ হাজার ৩৮১ জন শিক্ষার্থীদের ৩৩ কোটি ৯১ লাখ ১২ হাজার ৩০০ কপি পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে। যার মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক প্রাথমিক স্তরে কোটি ১৯ লাখ ৮৪ হাজার ৮২৩ জন শিক্ষার্থীকে কোটি ৬৬ লাখ হাজার ২৪৫টি বই বিতরণ করা হবে।

প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, ইবতেদায়ি এসএসসি স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য যথাযথ মান বজায় রেখে এসব পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ করেছে সরকার। প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক উৎসব কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে এবং মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক উৎসব গাজীপুরের কাপাসিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন