অভিমত

বৈশ্বিক ফ্যাশন বাজারে বাংলাদেশের সম্ভাবনা

মো. মহিউদ্দিন রুবেল

[গতকালে পর]

শিশুদের পোশাক: বাংলাদেশ ক্যাটাগরিতে রফতানি করেছে দশমিক ৫৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যেখানে বিশ্বের বাণিজ্য ছিল ১০ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সুতরাং বিশ্বব্যাপী পণ্যের বাজারে আমাদের শেয়ার ছিল ১৪ দশমিক ৯০ শতাংশ ছিল, যার অর্থ আমাদের এখনো ক্যাটাগরিতে আরো প্রবৃদ্ধি অর্জনের সুযোগ রয়েছে। আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় মানুষ এখন তাদের শিশুদের বিষয়ে অনেক বেশি সতর্ক। মানসিকতার কারণে এবং পুরুষ/মহিলা/মেয়ে ছেলেদের পোশাক তৈরিতে তুলনামূলক দক্ষতা বেশি থাকার কারণে বিশেষ করে কভিডের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে অনেক কারখানা এখন আর শিশুদের পণ্য তৈরি করছে না। মোট ১০ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন মূল্যের বৈশ্বিক রফতানি বিশ্বের মোট পোশাক ব্যবহারের দশমিক ৩৭ শতাংশ। ক্যাটাগরিটি আমাদের জন্য ছোট চ্যালেঞ্জ কারণ, পণ্যগুলো বেশির ভাগই তুলাভিত্তিক। আমরা তুলা উৎপাদনকারী দেশ না, তাই তুলা উৎপাদনকারী দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে হবে। শিশুদের আইটেমগুলো তুলনামূলক পুরুষ/মহিলা/মেয়ে/ছেলেদের আইটেমগুলোর চেয়ে বেশি লাভজনক। যেহেতু বেশির ভাগ কারখানাই পুরুষ/মহিলা/মেয়ে ছেলেদের পোশাক উৎপাদনে নিয়োজিত, তাই শিশুদের পোশাকের মতো জটিল আইটেমগুলোয় বিনিয়োগ কম হয়েছে, কারখানার সংখ্যাও কম।

মহিলাদের শার্ট এবং ব্লাউজ: পোশাক শিল্প ক্যাটাগরিতে বিশেষ করে অপর্যাপ্ত ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ এবং দক্ষতায় পিছিয়ে থাকার কারণে খুবই নগণ্য অগ্রগতি অর্জন করতে পেরেছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশ থেকে মাত্র দশমিক শূন্য বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের লেডিস শার্ট এবং ব্লাউজ রফতানি হয়েছিল, যেখানে বৈশ্বিক বাণিজ্য ছিল ১৫ দশমিক শূন্য বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার অর্থ বিশ্ববাজারে আমাদের দশমিক ৮৯ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। তাই এখনো ক্যাটাগরিতে আরো রফতানি বাড়ানোর সুযোগ আমাদের রয়েছে। ক্যাটাগরিতে বিশ্ব রফতানির পরিমাণ ১৫ দশমিক শূন্য বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিশ্ববাজারে মোট পোশাকের মাত্র দশমিক ৪৩ শতাংশ। ক্যাটাগরিতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান বাধা, আমরা সাধারণত যে ধরনের মৌলিক (বেসিক) আইটেমগুলো করি, সেগুলোর তুলনায় জটিল উৎপাদন প্রক্রিয়া। যেহেতু আমরা উচ্চতর মূল্যসংযোজনের কৌশল অনুসরণ করছি, তাই আমাদের এক্ষেত্রে বেশি বিনিয়োগ করা উচিত। কারণ, ধরনের ক্যাটাগরিতে প্রবৃদ্ধি অর্জনের বিশাল সুযোগ রয়েছে। লেডিস শার্ট এবং ব্লাউজগুলো আমাদের মোট পোশাক রফতানির মাত্র দশমিক ৩২ শতাংশ, যা অন্য আইটেমগুলোর তুলনায় খুবই কম।

কোট এবং ওভারকোট: হাতে গোনা কিছু কারখানা আছে যারা কোট এবং ওভারকোট তৈরি করতে পারে এবং বেশির ভাগই সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগভিত্তিক। আমাদের সরকার এখন সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগকে (এফডিআই) অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, স্বাগত জানাচ্ছে, তাই আমাদের অবশ্যই যে দেশগুলো প্রযুক্তিতে এগিয়ে আছে, কারিগরি কৌশলে পারঙ্গম, তাদের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে হবে। বাংলাদেশ ক্যাটাগরিতে শূন্য দশমিক ৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রফতানি করেছে, যেখানে ক্যাটাগরিতে বিশ্বের মোট রফতানি ছিল ১৮ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, অর্থাৎ বিশ্ববাজারে আমাদের দশমিক শূন্য শতাংশ শেয়ার রয়েছে। বিশ্ববাজারে মোট ১৮ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের কোট ওভারকোট রফতানি, বিশ্বব্যাপী মোট পোশাক রফতানির দশমিক ২১ শতাংশ। যেহেতু আইটেমটি উচ্চমূল্য সংযোজিত আইটেম, তাই পণ্যের এফওবি মূল্যও বেশি এবং আমরা যদি বিভাগে আরো অগ্রগতি অর্জন  করতে পারি, তবে রফতানি আয় বাড়বে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বাড়বে। বাংলাদেশে বিভাগে প্রযুক্তিগত জ্ঞান ছাড়াও অপর্যাপ্ত পশ্চাত্পদ সংযোগ এবং কাঁচামাল প্রাপ্যতা সংকট প্রধান চ্যালেঞ্জ, তাই আমাদের বেশির ভাগই আমদানি করা উপকরণের ওপর নির্ভর করতে হবে। বাংলাদেশের মোট পোশাক রফতানিতে কোট এবং ওভারকোটের অবদান প্রায় দশমিক ৭০ শতাংশ, যা খাতে ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা নির্দেশ করে।

স্যুট এবং ট্র্যাকস্যুট: আইটেমটি আমাদের মোট পোশাক রফতানির মাত্র দশমিক শূন্য শতাংশ, যা বিশ্ববাজারের তুলনায় খুবই নগণ্য। আমাদের দেশে স্যুট তৈরির কয়েকটি কারখানা রয়েছে। ক্যাটাগরিতে বিনিয়োগের প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে প্রযুক্তিগত জ্ঞানের ঘাটতি। আমরা দেখতে পাই, খাতে রফতানি বৃদ্ধির জন্য যৌথ বিনিয়োগ উৎসাহিত করে এফডিআই এবং কারিগরি দক্ষতা আনার বিশাল সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ শূন্য দশমিক ৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের স্যুট এবং ট্র্যাকস্যুট রফতানি করেছিল, যেখানে ক্যাটাগরিতে বিশ্বের মোট রফতানি ছিল ১৪ দশমিক ৫১ বিলিয়ন মার্কিন, অর্থাৎ আমাদের দশমিক ১৯ শতাংশ শেয়ার ছিল। মোট ১৪ দশমিক ৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের স্যুট এবং ট্র্যাকস্যুট রফতানি, বিশ্বের মোট পোশাক ব্যবহারের দশমিক ৩১ শতাংশ। পশ্চাত্পদ সংযোগ শিল্প এবং কাঁচামালের ঘাটতি উপখাতের বিকাশের ক্ষেত্রে অন্তরায়।

জ্যাকেট এবং ব্লেজার: কোট, ওভারকোট এবং স্যুট এবং ট্র্যাকসুটের মতো জ্যাকেট ব্লেজারগুলোরও প্রায় একই ধরনের চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ শূন্য দশমিক ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের জ্যাকেট এবং ব্লেজার রফতানি করেছিল, যেখানে ক্যাটাগরিতে বিশ্বের মোট রফতানি ছিল ১৩ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, অর্থাৎ আমাদের বিশ্বব্যাপী দশমিক ২৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। এর মানে আমাদের খাতে প্রবৃদ্ধির সুযোগ আছে। আমরা ক্যাটাগরিতে আমাদের মোট পোশাক রফতানির মাত্র শতাংশ রফতানি করছি। তার মানে আমাদের এখানেও অনেক করণীয় হয়েছে। জ্যাকেট এবং ব্লেজার ক্যাটাগরিতে মোট ১৩ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার রফতানি, বিশ্বের মোট পোশাক ব্যবহারের দশমিক শূন্য শতাংশ।

অন্যান্য: অন্যান্য ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশের পোশাক  রফতানি দশমিক ৬৪  বিলিয়ন ডলার মূল্যের, যেখানে বিশ্বের মোট ব্যবসা ছিল ১০০ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ আমাদের দশমিক ৬৪ শতাংশ শেয়ার ছিল। এর অর্থ অন্যান্য ক্যাটাগরিতেও আমাদের আরো প্রবৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। মোট ১০০ দশমিক ১০ বিলিয়ন হলো বিশ্বের মোট পোশাক ব্যবহারের ২২ দশমিক ৮৭ শতাংশ।

বাংলাদেশ থেকে ২০২১ সালে (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) মোট পোশাক রফতানি হয়েছিল ৪৪ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যেখানে বিশ্বে মোট ৪৩৭ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পোশাক ব্যবহার হয়েছে এবং বিশ্বের পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের অংশ ছিল ১০ দশমিক ১৪ শতাংশ। 

ডাটাগুলো আমাদের দেখায় কোন কোন ক্ষেত্রে আরো প্রবৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। আমরা যদি পশ্চাত্পদ শিল্পের বিকাশ করতে পারি, প্রযুক্তিতে আরো বেশি বিনিয়োগ করতে পারি এবং নতুন বাজারে আরো বেশি মনোনিবেশ করতে পারি এবং পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে পারি, যদি আমরা শিল্প চালানোর জন্য পর্যাপ্ত গ্যাস বিদ্যুৎ পাই এবং ব্যবসার সহজীকরণ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারি, তাহলে শিল্পটি জাতীয় অর্থনীতিতে আরো বেশি অবদান রাখতে পারে। (শেষ)

 

মো. মহিউদ্দিন রুবেল: পরিচালক, বিজিএমইএ এবং পরিচালক, ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন