কাটা পড়া কেবলে সেবা ব্যাহত শুধু বাংলাদেশে

নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সেবা পেতে দেশে সাবমেরিন কেবলের সংখ্যা বাড়াতে হবে

ছবি : বণিক বার্তা

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সেবা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু দেশে সাবমেরিন কেবলের সংখ্যা পর্যাপ্ত নয়। যে কারণে কোনো একটি কেবল কাটা পড়লে কিংবা কোনো কারণে সাময়িক বন্ধ থাকলে ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত হয়। সম্প্রতি ‘সি-মি-উই ৫’ সাবমেরিন কেবল ইন্দোনেশিয়া অংশে কাটা পড়েছে। বণিক বার্তার প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশসহ ১৬টি দেশ এ কেবলে যুক্ত থাকলেও সেবা ব্যাহত হচ্ছে শুধু বাংলাদেশে। খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, এর পেছনে দায়ী অপর্যাপ্ত সাবমেরিন কেবলের ওপর নির্ভরশীলতা। একাধিক বিকল্প না থাকায় যেকোনো দুর্ঘটনায় দেশে ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত হয়। বাকি দেশগুলোয় পর্যাপ্ত বিকল্প সাবমেরিন কেবল থাকায় এ সেবা ব্যাহত হচ্ছে না।

দেশে সাবমেরিন কেবল মোটে দুটি। প্রথম সাবমেরিন কেবল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া-মধ্যপ্রাচ্য-পশ্চিম ইউরোপ ৪ ‘সি-মি-উই ৪’। বর্তমানে সমুদ্রের তলদেশের এই কেবলের মাধ্যমে প্রায় ৮০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইডথ সরবরাহ করা হয়, যা ২০০৬ সালে বাংলাদেশে সংযুক্ত হয়েছিল। আর দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবল ‘সি-মি-উই ৫’। এর সক্ষমতা ১ হাজার ৬০০ জিবিপিএস, যা দেশের প্রথম সাবমেরিন কেবলের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। ‘সি-মি-উই ৫’ কেবলটি সিঙ্গাপুর থেকে ৪৪০ কিলোমিটার পশ্চিমে ইন্দোনেশিয়া অংশে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে বন্ধ হয়ে যায় সিঙ্গাপুর অভিমুখী সব ধরনের ট্রাফিক। এ অবস্থায় দেশের ৯০ শতাংশ ডাটা ট্রাফিক সিঙ্গাপুরভিত্তিক হওয়ায় এবং অধিকাংশ কোম্পানি সিঙ্গাপুরের সার্ভার ব্যবহার করায় ইন্টারনেট সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে, বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে দেশে ইন্টারনেট সেবাপ্রাপ্তিতে। এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে কেবলের সংখ্যা বাড়ানো উচিত। কেবলের সংখ্যা বেশি হলে সেগুলো দিয়ে পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক রাখা সম্ভব। পাশাপাশি সার্ভার বেছে নেয়ার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। দেশে সার্ভার স্থাপন করা যায় কিনা তা নিয়ে কাজ করা জরুরি। আমাদের প্রায় সব ডাটা সেন্টার সিঙ্গাপুরভিত্তিক। ফলে ৯০ শতাংশ ডাটা ট্রাফিক সিঙ্গাপুরকে ঘিরে হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ায় কেবল কাটা পড়ায় সিঙ্গাপুরের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত ডাটা ভারত হয়ে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে। 

টেলিযোগাযোগ খাতের বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান টেলিজিওগ্রাফির তথ্য অনুযায়ী, ‘সি-মি-উই ৫’-এর সঙ্গে ১৬টি দেশ ১৮টি ল্যান্ডিং স্টেশনের মাধ্যমে যুক্ত। ১৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশই সবচেয়ে কম সাবমেরিন কেবলে যুক্ত। টেলিজিওগ্রাফির হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার চারটি সাবমেরিন কেবলে যুক্ত। মালয়েশিয়া সাবমেরিন কেবলের ল্যান্ডিং স্টেশন ২৯টি। সিঙ্গাপুর যুক্ত ৩৮টিতে আর ইন্দোনেশিয়া নিজে ৬৫টি কেবলের মাধ্যমে সংযুক্ত। এছাড়া শ্রীলংকা ও পাকিস্তান যথাক্রমে নয়টি ও দশটি সাবমেরিন কেবলে যুক্ত। বাংলাদেশেও সাবমেরিন কেবলের সংখ্যা বাড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিতে হবে। কেননা ইন্টারনেটের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্কও জড়িত। শিগগিরই এ সমস্যা সমাধান না হলে এবং এর বিকল্প তৈরি না হলে অর্থনৈতিকভাবে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। 

সাধারণ ব্যবহারকারীরা ইন্টারনেট ব্যবহারে খুব বেশি সমস্যার সম্মুখীন না হলেও ফ্রিল্যান্সার এবং দেশের বাইরের কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধভাবে কাজ করা কোম্পানিগুলোর কাছে নিরবচ্ছিন্ন সেবা না পাওয়া বেশ ভোগান্তির। এতে আর্থিকভাবে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। 

দেশে ব্যান্ডউইডথের চাহিদা এবং জোগান সমপর্যায়ে রয়েছে। ফলে একদিকে আমাদের কোনো উদ্বৃত্ত নেই, অন্যদিকে আমাদের কোনো বিকল্প সোর্স নেই। যার কারণে দুটি কেবলের একটি কাটা পড়ায় এ সংকট তৈরি হয়েছে এবং এটি দীর্ঘায়িত হবে। বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবলস কোম্পানি (বিএসসি) সূত্রে জানা যায়, বিচ্ছিন্ন হওয়া কেবল মেরামত করতে ইন্দোনেশিয়া সরকারের অনুমতি লাগবে। সবকিছু ঠিকঠাক করে ইন্টারনেটের গতি ফিরে পেতে প্রায় এক মাস লাগবে।

ইন্টারনেট একটি জরুরি সেবা। সবসময় এর বিকল্প ব্যবস্থা রাখা উচিত। দেশের অর্থনীতি এখন তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে। ব্যান্ডউইডথের বিকল্প উৎস এখন সময়ের দাবি। সাবমেরিন কেবলের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক টেরিস্ট্রিয়াল কেবল (আইটিসি) সংযোগও বাড়ানো উচিত। তবে শুধু সংযোগ বাড়ালেই হবে না, কেবলের রক্ষণাবেক্ষণও গুরুত্বপূর্ণ নির্বিঘ্ন ইন্টারনেট সেবা অব্যাহত রাখতে।

ব্যান্ডউইডথের সহজলভ্যতা ও রিডান্ডেন্সি নিশ্চিত করতে এবং সাবমেরিন কেবলের রক্ষণাবেক্ষণ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের ঝুঁকি কমাতে বাংলাদেশ ২০১১ সালে প্রথম আইটিসি লাইসেন্স চালু করে। যদিও সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে ব্যান্ডউইডথ সরবরাহ বেশি উপযোগী। কেননা সাবমেরিন কেবলে বিনিয়োগ এককালীন ব্যয়, কিন্তু আইটিসি কোম্পানিগুলোকে প্রতি মাসে ব্যান্ডউইডথের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হয়। তবু সাবমেরিন কেবলে বিপর্যয়ের দিনে আইটিসি সংযোগ বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারে। সেক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ঝুঁকির মুখে পড়তে হবে না আমাদের। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) হিসাব অনুযায়ী, দেশের সব শ্রেণীর মানুষ যদি উচ্চ গতির ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হয়, ডিজিটাল প্রবৃদ্ধির গতি অব্যাহত থাকে এবং ফাইভজি চালু হয়, তাহলে ২০২৫ সালের মধ্যে ব্যান্ডউইডথের ব্যবহার বেড়ে ৩৪ হাজার জিবিপিএসে উন্নীত হতে পারে।

দেশে এখন সাড়ে পাঁচ হাজার ব্যান্ডউইডথের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠান সাবমেরিন কেবল কোম্পানি আড়াই হাজারের বেশি ব্যান্ডউইডথ সরবরাহ করে। এ দুই সাবমেরিন কেবলের বাইরে প্রায় ২ হাজার ৭০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইডথ আন্তর্জাতিক টেরিস্ট্রিয়াল কেবল (আইটিসি) মাধ্যমে স্থলসীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে আমদানি করা হয়। বিএসসিপিএলসি মারফত জানা যায়, এরই মধ্যে তৃতীয় সাবমেরিন কেবল সিমিইউ-৬ সংযোগের কাজ শুরু হয়েছে। এটি ২০২৫ সালে চালু হওয়ার কথা। এ সংযোগ চালু হলে ১৩ হাজার ২০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইডথ যুক্ত হবে। আশা করা যায়, এটি চালু হলে আগামীতে এ ধরনের বিপর্যয় এতটা প্রকট হবে না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন