বিদেশী এয়ারলাইনসের ৩২ কোটি ৩ লাখ ডলার পাওনা

দেশের ভাবমূর্তি রক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া দরকার

ছবি : বণিক বার্তা

বাংলাদেশে বিভিন্ন বিদেশী এয়ারলাইনসের ৩২ কোটি ৩০ লাখ ডলার আটকে থাকায় এভিয়েশন খাতে তৈরি হয়েছে জটিলতা। এ জটিলতা নিরসনে সরকারের পদক্ষেপ কাম্য। তা না হলে দেশের এভিয়েশন খাতের জন্য বড় ঝুঁকির কারণ হয়ে উঠতে পারে। পাওনা পরিশোধ না হলে বাংলাদেশ থেকে বিদেশী এয়ারলাইনসগুলো মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। এ অবস্থা জিইয়ে রাখলে অনেক এয়ারলাইনস বাংলাদেশ থেকে ধীরে ধীরে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আন্তর্জাতিক চুক্তির লঙ্ঘন এড়াতে বাংলাদেশ সরকারকে দ্রুতই এ অর্থ ছাড়ের অনুরোধ জানিয়েছে বৈশ্বিক আকাশ পরিবহন সংস্থাগুলোর সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইএটিএ)। এভিয়েশন খাতের ঝুঁকি এড়াতে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিত। 

বিদেশী যেসব এয়ারলাইনস বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনা করে তাদের টিকিট বিক্রির মুনাফা বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সি থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনসাপেক্ষে বিদেশে পাঠানো হয়। এটা প্রতি মাসে পাঠানোর কথা। লক্ষ করা যাচ্ছে, কয়েক বছর ধরে নিয়মিত বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন না পাওয়ায় এজেন্সিগুলো সঠিক সময়ে অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না, যার কারণে সৃষ্টি হয়েছে বিপুল এ দেনা। ডলারের মূল্য ওঠানামার সঙ্গে পাওনা অর্থের সামঞ্জস্য রাখতে এয়ারলাইনসগুলো ক্ষতি পোষাতে বাংলাদেশে তাদের টিকিটের দাম বাড়িয়েছে। টিকিটের দাম বাড়ানোর প্রভাব পড়বে যাত্রীদের ওপর। 

বিশ্বের প্রায় ৩০০ এয়ারলাইনসের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইএটিএ। এর মাধ্যমে আকাশপথে বিশ্বের ৮৩ শতাংশ পরিবহন হয়। বিদেশী এয়ারলাইনসের এ বিপুল পরিমাণ দেনা পরিশোধ না করায় পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে উঠেছে। এয়ারলাইনসগুলো বাংলাদেশে তাদের সেবা নির্বিঘ্ন রাখতে এ দেনা পরিশোধে সরকারের উদ্যোগ কাম্য। 

বাংলাদেশে বিদেশী এয়ারলাইনসের রাজস্ব আটকে থাকার ঘটনা অবশ্য নতুন নয়। এর আগে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে আইএটিএ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ২০ কোটি ৮০ লাখ ডলার রাজস্ব আটকে থাকার কথা জানায়। গত বছরের জুনে আটকে থাকা রাজস্বের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ২১ কোটি ডলার। এবার তা ৩২ কোটি ৩০ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে। 

বিদেশী এয়ারলাইনসের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলার সংকটের কারণে টিকিট বিক্রির মুনাফা নিজ দেশে নিতে পারছেন না। বাংলাদেশের ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর কাছে টিকিট বিক্রি বন্ধ করেছে বেশ কয়েকটি বিদেশী এয়ারলাইনস। এখন তারা অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সির (ওটিএ) কাছে টিকিট বিক্রি করছে। 

দেশে ডলারের সংকট রয়েছে তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। বৈদেশিক রিজার্ভ কমতে শুরু করায় বাংলাদেশ বিদেশী এয়ারলাইনসগুলোকে ধীরগতিতে মুনাফার অর্থ দিচ্ছে। আগে ব্যাংক থেকে ডলার কিনে নির্ধারিত ব্যাংকের মাধ্যমে এয়ারলাইনসগুলো তাদের আয় পাঠাতে পারত। সে পথও এখন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এভিয়েশন খাতের ঝুঁকি এড়াতে লেনদেন প্রক্রিয়া সহজীকরণের পাশাপাশি এয়ারলাইনসগুলো তাদের মুনাফা যাতে সহজে পাঠাতে পারে সেই ব্যবস্থা কাম্য। এর মাধ্যমে এভিয়েশন খাতের সম্ভাব্য ঝুঁকি কমে আসবে বলে আশা করা যায়। বাংলাদেশের ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসাও স্বাভাবিক হবে। 

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সির (ওটিএ) কাছে টিকিট বিক্রি করায় বেশ কয়েকটি সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এর একটি হলো স্থানীয় এজেন্টদের কাছে টিকিটের দাম বেড়ে যাওয়া। ফলে বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে যাত্রীদের, বিশেষ করে অভিবাসী শ্রমিকরা চাপে পড়ছেন। অন্যটি হলো, ট্রাভেল এজেন্টদের ব্যবসা দ্রুত লোকসানে পড়ছে।

আশঙ্কা করা হচ্ছে, পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বাংলাদেশের এয়ার টিকিট ব্যবসা বিদেশী অনলাইন ট্রাভেল এজেন্টদের হাতে চলে যাবে। জানুয়ারিতে কয়েকটি রুটে টিকিটের দাম; বিশেষত নিউইয়র্ক, কানাডা ও লন্ডনের মতো দূরের পথে টিকিটের দামও ৫০ থেকে ১০০ ডলার বেড়েছে। টিকিট বিদেশে বিক্রি হওয়ায় সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। সরকারের রাজস্ব আহরণ প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রাখতে বিদেশী এয়ারলাইনসগুলোর পাওনা পরিশোধে ব্যবস্থা নিতে হবে। 

বিদেশী এয়ারলাইনসগুলো বাংলাদেশে কম ভাড়ায় টিকিট বিক্রির ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়ায় যাত্রীদের বেশি দামে টিকিট কিনতে হচ্ছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে যেকোনো স্থানীয় ট্রাভেল এজেন্টের কাছে ব্যাংকক যাওয়ার টিকিটের দাম প্রায় ২৫ হাজার টাকা। একই টিকিট ওটিএ ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করছে।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছে, দীর্ঘদিন ধরেই এ সংকট চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটি এয়ারলাইনসকে তাদের আয়ের একটি অংশ পাঠানোর সুযোগ দিচ্ছে। তবে তা পর্যাপ্ত নয়। এ কারণে বেশির ভাগ এয়ারলাইনস বাংলাদেশে কম ভাড়ার টিকিট বিক্রি বন্ধ রেখেছে। ফলে বাংলাদেশী যাত্রী ও স্থানীয় ট্রাভেল এজেন্টরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এতে বাংলাদেশে সেবা দিতে আগ্রহী এয়ারলাইনসরা নিরুৎসাহিত হবে। 

কিছু বিদেশী এয়ারলাইনস দেশের বাজারে যে পরিমাণ রাজস্ব আয় করে তার চেয়ে বেশি পরিমাণ প্রত্যাবাসন করতে চায়। শুল্ককর ফাঁকি দিতেও বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। এসব কারণে কিছু বিল পরিশোধে অনেক সময় বিলম্ব হয়ে যায় বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা দাবি করেছেন, যা বণিক বার্তার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। যদি এ রকম ঘটনা হয়ে থাকে তাহলে তা আইনগতভাবে দ্রুত সুরাহার উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ এসব বিষয় জিইয়ে রেখে সমাধান আশা করা যায় না। উভয় পক্ষকে সমাধান করতে আইনগতভাবে এগিয়ে যেতে হবে। 

পাওনা পরিশোধের জটিলতায় বিদেশী এয়ারলাইনসের ফ্লাইট কমে গেলে প্রবাসী কর্মী পরিবহনে মারাত্মক অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে। এতে শ্রমিকদের বিদেশে যাওয়া কমে যাবে এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। ধস নামবে পর্যটন খাতেও। বিদেশী এয়ারলাইনসগুলোর কয়েক বছর ধরে আটকে থাকা দেনা পরিশোধে সরকারের ন্যায়সংগত উদ্যোগ কাম্য। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন