সময়ের ভাবনা

ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় গবেষণায় জোর দেয়া দরকার

ড. মো. গোলাম ছারোয়ার

ছবি : বণিক বার্তা

গত দুই যুগে ডেঙ্গুর যে বিস্তার তার মূলে যেতে পারলেই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া সম্ভব। পরিকল্পনা প্রণয়ন হতে হবে একেবারেই সুনির্দিষ্টভাবে। যে উদ্দেশ্য নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে তার সংশ্লিষ্ট সব বিষয়কে অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। মিশন ও ভিশন সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। যতগুলো রিস্ক ফ্যাক্টর আছে সবগুলোকে আমলে নিয়েই পরিকল্পনা করতে হবে। একটু উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। যদি ভেক্টর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পরিকল্পনা প্রণীত হয় তবে তার মধ্যে নির্দিষ্ট স্থানের মানুষের ঘনত্ব, বাসস্থানের প্রকৃতি জীবনযাত্রার মান ও প্রকৃতি। জলবায়ুর বিভিন্ন উপাদানের প্রাচুর্য ও প্রভাব, মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতি ইত্যাদি যথাযথভাবে বিবেচনায় নিয়ে মশা প্রজনন ক্ষেত্র (কৃত্রিম ও প্রাকৃতিক) কেমন হবে তার বিশ্লেষণে পরিকল্পনা তৈরি না হলে তা কখনই টেকসই হতে পারে না। একইভাবে আক্রান্ত রোগীর সুচিকিৎসার জন্য ডেথ রেফারেন্সসহ সুপরিকল্পিত টিম না থাকলে চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাই চিকিৎসা ব্যবস্থায় বিশেষায়িত চিকিৎসক ও প্রয়োজনীয় ডায়াগনসিস এবং চিকিৎসক রোগীর যুক্তিযুক্ত অনুপাত সুনিশ্চিত করা অত্যন্ত প্রয়োজন। একই ধারাবাহিকতায় সব কার্যক্রম যথাযথ বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে সময়মতো তদারকি করতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন হবে না। তদারকির মাধ্যমে ফলাফল মূল্যায়ন করতে অবশ্যই আন্তর্জাতিক মাপকাঠি ও গুণগত মান সমুন্নত রেখেই করতে হবে। সেই মূল্যায়নই বলে দেবে সঠিক পথে কার্যক্রম চলছে নাকি তা ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে। এখন একটু বিস্তারিত করে যদি বলি তাহলে সবারই বুঝতে সুবিধা হবে।

পরিকল্পনা: ডেঙ্গু অধ্যুষিত যেসব দেশ ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে সেসব দেশের পরিকল্পনা সুদূরপ্রসারী এবং দূরদর্শীসম্পন্ন ছিল। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা সুচারুভাবে পরিচালনা করতে সর্বপ্রথম যে বিষয়টি যত্নসহকারে বিবেচনায় নিতে হবে তা হলো, প্রয়োজনীয় বিশেষায়িত মানবসম্পদ। একটু গভীরে গেলে বলতে হয়, যারা এ বাহকের ইকোলজি, বায়োলজি, ফিজিওলজি ও আচরণগত দিক নিয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা করবেন তাদের তৈরির জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। উদাহরণ দিলে আরো পরিষ্কার হবে। কিডনি রোগী, হার্টের রোগী, নাক, কান ও গলার রোগী, চোখ, স্কিন, মেন্টাল ডিজঅর্ডার, দাঁত ও ব্রেইনের জন্য যেমন আলাদা আলাদাভাবে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য নির্দিষ্ট ইনস্টিটিউট, বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা ইনস্টিটিউট রয়েছে। রয়েছে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে অ্যাক্রিডেশন। একই ধারাবাহিকতায় আখ, তুলা, ধান, পাট, কন্দাল ফসল, তৈলবীজ, মসলা, গবাদি পশু উন্নয়ন, মৎস্যসম্পদ উন্নয়ন, পোলট্রি উন্নয়ন এবং ফল ও ফুলের উন্নয়নের জন্য যেমন নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক লেখাপড়ার পাশাপাশি গবেষণার মাধ্যমে তার উন্নয়ন ও প্রয়োগ নিশ্চিত হয়। কৃষিক্ষেত্রে লেপিডোপটেরা, হাইমিনেপটেরা, কোলিওপটেরা, ডিকটাওপটেরা, ডিপটেরা, ওডোনেটা ও থাইছানোপটেরা প্রভৃতি অর্ডারের বিপুলসংখ্যক কীটকে যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করে কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন নিশ্চিত সম্ভব হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে বিশেষায়িত বিষয়ে লেখাপড়া, মানবসম্পদ তৈরি ও গবেষণা, তার উন্নয়ন ও প্রয়োগের মাধ্যমে। তাই মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পনায় অবশ্যই মশার জীবন চক্র হতে শুরু করে আচরণ পর্যন্ত সব বিষয়ে বিশেষায়িত মানবসম্পদ তৈরির জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং তার উন্নয়ন ও প্রায়োগিক সক্ষমতায় গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার বিকল্প নেই। যদি পরিকল্পনায় এর ঘাটতি থাকে তবে অবশ্যই সব প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় রূপ নেবে। কারণ টেকসই নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে গবেষণার কোনো বিকল্প নেই।

পরিকল্পনার প্রয়োগ বা বাস্তবায়ন: পরিকল্পনা যত দূরদর্শী ও সুদূরপ্রসারীই হোক না কেন তার যদি প্রয়োগ যথাযথ না হয় তবে আশান্বিত ফলাফল কখনই সম্ভব নয়। যে দেশগুলো ডেঙ্গুর বিস্তার দমনে সফলতা অর্জন করেছে তারা সবাই পরিকল্পনা অনুযায়ী সঠিকভাবে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে। বাস্তবায়নের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো সময়, স্থান ও পদ্ধতি নির্বাচন করে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা। একটি উদাহরণ দিলেই পরিষ্কার হবে। আমাদের দেশের যে যে জায়গায় এডিস মশার বংশ বিস্তারের প্রবণতা ঝুঁকিপূর্ণ তা ক্রমানুসারে নির্ধারণ করে পদ্ধতি নির্বাচন করতে হবে। পদ্ধতির মধ্যে মশার প্রজনন স্থান ধ্বংস করা, প্রাকৃতিক শত্রুর সংরক্ষণ, বায়োলজিক্যাল পদ্ধতি বা প্রিডেটর, প্যারাসাইটস বা প্যাথোজেন বা বায়োলজিক্যাল এজেন্ট প্রয়োগ করা। যুক্তিযুক্ত (র‌্যাশনাল) উপায়ে রাসায়নিক বালাইনাশক (অ্যাডাল্টিসাইড বা লার্ভিসাইড প্রয়োগ) প্রত্যেক দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি নিজ নিজ দায়িত্বে সাধারণ জনগণের মাঝে সচেতনতা তৈরি করে জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়িয়ে নিজ নিজ এলাকা এডিস মুক্ত করবেন। কোনো স্থানে রোগী শনাক্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে সেই এলাকার সবাইকে সম্পৃক্ত করে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করতে হবে। যেকোনো পদ্ধতি প্রয়োগে সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। পদ্ধতি নির্বাচনে অবশ্যই বিশেষায়িত বিশেষজ্ঞদের পরামর্শকে গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। কারণ কোনোভাবেই যেন কোনো পদ্ধতি পরিবেশ তথা অন্যান্য জীবের কোনো ক্ষতির কারণ না হয় সেদিকে সুদৃষ্টি রাখতে হবে।

তদারকি: সব কার্যক্রমের তদারকি হবে উন্নতমানের সিস্টেমে বা প্রযুক্তির সব আধুনিক পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে। যেমন মশার ঘনত্ব অনুযায়ী জিআইএস পদ্ধতির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ক্রমানুসারে বিভিন্ন সংকেতের মাধ্যমে রিপোর্ট প্রদান করবেন, কার্যক্রম পদ্ধতিগতভাবে পরিচালিত হচ্ছে কিনা বা কোন সুনির্দিষ্ট জায়গায় কাজের ব্যাঘাত ঘটছে। একই সঙ্গে তা উত্তরণের পদ্ধতি হিসেবেও প্রতীয়মান হবে। তদারকির জন্য যেমন উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে, একই সঙ্গে তদারকি হতে হবে অত্যন্ত চৌকস টিম দিয়ে উন্নত বিশ্বের ব্যবহৃত টুলস বা চেক লিস্টের মাধ্যমে সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। ক্রস চেকের মাধ্যমেই কাজের গতি-প্রকৃতি উন্নয়নের ধারা ও প্রবণতা তৈরি হবে। বেগবান হবে কাজের পরিধি আর আসবে কাঙ্ক্ষিত সফলতা। 

মূল্যায়ন: পরিশ্রমলব্ধ কর্মের সাফল্যে যে আনন্দ তা সত্যিই নির্মল ও হৃদয়গ্রাহী। ভালো কাজের যথাযথ মূল্যায়ন কাজের ও সফলতার পরিধি ক্রমান্বয়ে বাড়াতে থাকে। তবে তার সঙ্গে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে কোনোভাবেই যেন অবমূল্যায়ন না হয়। মূল্যায়নটা যদি হয় কোনো সিদ্ধহস্ত ব্যক্তির মাধ্যমে তাহলে তো আর কোনো কথাই নেই। ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে পরিচালিত কার্যক্রম মূল্যায়ন অবশ্যই বিশেষায়িত ব্যক্তির বিশেষায়িত জ্ঞান-বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতার নিরিখে হতে হবে। যারা মশক নিধনকর্মী আছেন তাদের কাজের মূল্যায়ন ও ইন্টারভেনশনের উন্নয়ন অবশ্যই তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণে মূল্যায়ন করতে হবে। যারা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও তদারকি করছেন সবাইকে মূল্যায়নের আওতায় এনে অবশ্যই যোগ্য ও যুক্তিযুক্ত সম্মান প্রদান করতে হবে। ব্যর্থতা শুধরে দিয়ে মূল্যায়ন ত্বরান্বিত করতে হবে। 

পরিশেষে ভেক্টর বাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে ভেক্টর-বাহক-পোষক শরীরের রসায়ন মূল্যায়নে পরিকল্পনাকারীদের যথাযথ পরামর্শ প্রদান করার মাধ্যমেই আমরা এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি হতে রক্ষা পেতে পারি।

ড. মো. গোলাম ছারোয়ার: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন