অভিমত

বৈশ্বিক ফ্যাশন বাজারে বাংলাদেশের সম্ভাবনা

মো. মহিউদ্দিন রুবেল

বৈশ্বিক ফ্যাশন বাজার বহুমুখী এবং আইটেম/পণ্যের দিক থেকে বাজারটির শ্রেণীবিন্যাস করা দুরূহ। তবে বিশ্বব্যাপী ব্যবহার করা পোশাকগুলোকে বিস্তৃতভাবে কম-বেশি ১২টি বিভাগ/ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যেতে পারে।

যদি আমরা ২০২১ সালের ১২টি ক্যাটাগরির প্রতিটির বিপরীতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের রফতানি বিশ্লেষণ করি, তাহলে আমরা আমাদের শিল্পের শক্তি, বৈশ্বিক পোশাক বাজারে এর বর্তমান অবস্থান এবং বাজারে শেয়ার বাড়ানোর জন্য আরো কী করা দরকার, তার একটি বিশদ ধারণা পাব। পণ্য বাজার বৈচিত্র্যকরণ নিয়ে প্রায়ই আলোচনা হয়। কিন্তু নতুন সুযোগগুলো কাজে লাগানো এবং ফ্যাশন বিশ্বের পরিবর্তনশীল প্রবণতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভবিষ্যিভত্তিক পণ্য এবং বাজার নিয়ে পর্যন্ত খুব কম গবেষণা হয়েছে, যেখানে স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা ধারণা পেতে পারেন, সঠিক কোন ক্ষেত্রে তারা বিনিয়োগ করতে পারেন।

বিশ্লেষণটি উদ্যোক্তা এবং বিনিয়োগকারীদের ক্যাটাগরি অনুসারে রফতানির বাস্তব চিত্র পেতে সাহায্য করবে। আমরা বুঝতে সক্ষম হব, কোন কোন নতুন পণ্যের ওপর আরো বেশি নজর দিতে পারি এবং নতুন বিনিয়োগ বাজারে বৈচিত্র্য আনতে পারি।

আমাদের পোশাক রফতানি ঝুড়ির প্রধান ক্যাটাগরি/বিভাগগুলো হলো: . ট্রাউজার, . নিটেড শার্ট, . সোয়েটার, . আন্ডারগার্মেন্টস, . অ্যানোরাক্স এবং উইন্ডচিটার, . পুরুষ/ছেলেদের ওভেন শার্ট, . শিশুদের পোশাক, . মহিলাদের শার্ট এবং ব্লাউজ, . কোট এবং ওভারকোট, ১০. স্যুট এবং ট্র্যাকস্যুট, ১১. জ্যাকেট এবং ব্লেজার, ১২. অন্যান্য

আমরা ১২টি ক্যাটাগরির প্রতিটিকে তুলনামূলক বিশ্লেষণ সহকারে এক এক করে উপস্থাপন করব, এটা বোঝার জন্য বিশ্ববাজারে প্রতিটি ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশের অবস্থান পারফরম্যান্স কী এবং একই সঙ্গে কোথায় কোথায় বাংলাদেশের সম্ভাবনা রয়েছে।

ট্রাউজার: ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী ট্রাউজার বাজারের আকার ছিল ৯৪ দশমিক ২৭ শতাংশ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যেখানে বাংলাদেশের শেয়ার ছিল ১৫ দশমিক ৭০ শতাংশ। উল্লিখিত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বে ১৪ দশমিক ৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের ট্রাউজার রফতানি করেছে, যা বাংলাদেশের মোট পোশাক রফতানির ৪১ দশমিক ৫৬ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি।

ট্রাউজার ক্যাটাগরির মধ্যে প্রধান পণ্যগুলো হলো বিভিন্ন টেক্সটাইল উপকরণ (কটন, নিটেড, কৃত্রিম ফাইবার, উল জাতীয় তন্তু) দিয়ে প্রস্তুতকৃত পুরুষ, ছেলে, মহিলা এবং মেয়েদের ট্রাউজার, বিব এবং ব্রেস ওভারওল, ব্রিচ শর্টস প্রভৃতি। এগুলোর মধ্যে পুরুষ ছেলেদের কটন ওভেন ট্রাউজার এবং মহিলা মেয়েদের কটন ওভেন ট্রাউজারের শেয়ার ছিল যথাক্রমে ২৪ দশমিক ১৭ এবং ২০ দশমিক শূন্য শতাংশ।

অন্যদিকে মহিলা মেয়েদের নিটেড ট্রাউজার এবং পুরুষ ছেলেদের নিটেড ট্রাউজারের শেয়ার ছিল যথাক্রমে ২০ দশমিক ৫৮ এবং ১৩ দশমিক শূন্য শতাংশ। বিভাগে উচ্চ শেয়ারসহ অন্যান্য প্রধান ট্রাউজার আইটেম হলো পুরুষ ছেলেদের জন্য ওভেন এমএমএফ ট্রাউজার ১০ দশমিক ৭৯ এবং ওভেন ট্রাউজার, বিব, ব্রেস ওভারঅল, ব্রিচেস বিভিন্ন টেক্সটাইল উপকরণ দিয়ে প্রস্তুতকৃত শর্টস ১১ দশমিক শূন্য শতাংশ। মহিলা মেয়েদের ওভেন এমএমএফ ট্রাউজার ১১ দশমিক ১৭ শতাংশ।

পরিসংখ্যান থেকে এটিও দেখা যায়, ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী ৪৩৭ দশমিক বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পোশাক ব্যবহার হয়েছিল; ট্রাউজারের শেয়ার ছিল ২১ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এটি ইঙ্গিত দেয় বিশ্বব্যাপী ট্রাউজারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের আইটেমের বাজারে আরো অংশ দখলের সুযোগ রয়েছে।

আমরা ক্যাটাগরিতে আমাদের যেকোনো সময়ের চেয়ে ক্রমাগত ভালো করছি এবং দিনে দিনে শক্তিশালী হয়ে উঠছি। কারণ, বাংলাদেশে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প বিকশিত হচ্ছে।

নিটেড শার্ট: ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশ রফতানি করেছিল দশমিক ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যেখানে বিশ্বের মোট ব্যবসা ছিল ৪৯ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, অর্থাৎ ব্যবসায় আমাদের ১৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ শেয়ার রয়েছে, যার অর্থ আমাদের খাতে আরো প্রবৃদ্ধি অর্জনের সুযোগ রয়েছে।

মোট ৪৯ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন মার্কিন মূল্যের নিটেড শার্টের বাজারের মধ্যে বাংলাদেশের দখলে রয়েছে ১১ দশমিক ৩৭, যা প্রমাণ করে, বিভাগেও আমাদের অনেক কিছুই করার আছে। প্রকৃত বিষয়টি হলো, আমরা বেশির ভাগই মৌলিক আইটেমগুলো সরবরাহ করছি এবং আমাদের এখন উচিত উচ্চ মূল্যসংযোজিত পণ্যগুলোর ওপর নজর দেয়া, যেগুলো কিনা অধিকাংশই সরবরাহ করছে চীন ভিয়েতনাম। যদিও আমরা তুলা উৎপাদনকারী দেশ নই, তবু আমরা আমাদের প্রধান প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় ভালো করছি।

প্রকৃতপক্ষে কটন পণ্যের তুলনায় ম্যানমেইড ফাইবার (এমএমএফ) দিয়ে তৈরি পণ্যগুলোর চাহিদা বেশি বাড়ছে, তাই আমাদের উচিত কটনভিত্তিক পণ্যগুলোর তুলনায় এমএমএফভিত্তিক পণ্যগুলোয় আরো বেশি মনোযোগ প্রদান করা, যেহেতু ক্যাটাগরিতে এরই মধ্যেই স্থানীয় পর্যায়ে অনেক উদ্যোক্তা রয়েছেন। আমাদের অবশ্যই পণ্যে বৈচিত্র্য এবং এমএমএফ খাতে বেশি বিনিয়োগ করতে হবে।

সোয়েটার: বিভাগে বিশ্বব্যাপী ব্যবসা ছিল ৬১ দশমিক ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের, যেখানে বাংলাদেশের ছিল দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ব্যবসায় আমাদের ১০ দশমিক ৫৬ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। আমাদের দেশের মোট পোশাক রফতানিতে সোয়েটারের অবদান ১৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ। ক্যাটাগরিতে মোট রফতানি হয়েছে ৬১ দশমিক ২১ বিলিয়ন। তাই খাতেও আমাদের প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।

সোয়েটার একটি ঋতুভিত্তিক পণ্য, তাই আমরা যখন পণ্যের বৈচিত্র্য নিয়ে কথা বলি, আমাদের উচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র/ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়িয়ে এমন অঞ্চলে দিকে মনোনিবেশ করা, যেখানকার ঋতুচক্র আলাদা, বিশেষ করে দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে স্বতন্ত্র।

সম্প্রতি আমাদের সোয়েটার শিল্পে ব্যাপক অটোমেশন হয়েছে এবং প্রযুক্তি দক্ষতার উন্নয়ন, বিশেষ করে প্রযুক্তিগত দক্ষতাগুলোতে আরো বিনিয়োগের প্রয়োজন।

আন্ডারগার্মেন্টস: আন্ডারগার্মেন্টস অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি ক্ষেত্র, যেখানে বাংলাদেশ সম্প্রতি ক্রমবর্ধমান নজরদারি বাড়াচ্ছে। যদিও খাতটি বিকাশমান, তথাপি বিভাগে এখন পর্যন্ত আমাদের উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ বা রফতানি নেই। বাংলাদেশ কিছু মৌলিক আইটেম উৎপাদন করে, তবে অভিনব আইটেমগুলো সংখ্যায় বেশি নয়। একই সময়ে আমরা ক্যাটাগরিতে তুলাভিত্তিক আইটেমগুলোয় অধিক নজর দিচ্ছি, যখন কিনা সমগ্র বিশ্ব বিভাগে এমএমএফভিত্তিক পণ্যগুলোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকার কারণ হলো, বাংলাদেশে কাঁচামাল সংকট এবং দক্ষতা কম থাকার কারণে স্থানীয় উৎপাদনকারীরা খাতের বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহী নন।

বাংলাদেশ উল্লিখিত সময়ে ক্যাটাগরিতে দশমিক ৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রফতানি করেছে, যেখানে বিশ্বব্যাপী ক্যাটাগরিতে বাণিজ্য ছিল ২৬ দশমিক ৭১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, অর্থাৎ আমাদের শেয়ার দশমিক শূন্য শতাংশ। তাই খাতটিতেও আমাদের বেড়ে ওঠার সুযোগ রয়েছে। মোট ২৬ দশমিক ৭১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিশ্বের পোশাক ব্যবহারের দশমিক ১০ শতাংশ এবং জীবনযাপনে পরিবর্তন আসার কারণে আন্ডার গার্মেন্টস শিল্প অন্যান্য আইটেমের তুলনায় বেশি বিকাশ লাভ করবে।

আন্ডারগার্মেন্টস ক্যাটাগরিতে রফতানি, বাংলাদেশের মোট রফতানির দশমিক ৪৩ শতাংশ, যা কিনা রফতানি ঝুড়িতে নগণ্য। দেশে যত বেশি এমএমএফভিত্তিক ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প গড়ে উঠবে, ততই ক্যাটাগরিতে রফতানি বাড়বে। আমাদের ক্যাটাগরিতে আরো বেশি বিনিয়োগ, দক্ষতা এবং প্রযুক্তিতে মনোযোগ বাড়ানো উচিত হবে।

অ্যানোরাক্স এবং উইন্ডচিটার: ক্যাটাগরিতে আমাদের শেয়ার বাড়াতে হবে। আশার বিষয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ক্যাটাগরিতে রফতানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্যাটাগরিতে উৎপাদনের বেশির ভাগ কাঁচামাল আমদানি করা হয়। এর অর্থ হলো স্থানীয় পর্যায়ে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ বেশি করে গড়ে উঠলে খাতে রফতানি আরো বাড়বে।

বাংলাদেশ ক্যাটাগরিতে দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পোশাক রফতানি করেছে, যেখানে বিশ্বের মোট বাণিজ্য ছিল ২৩ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ আমাদের শেয়ার ছিল দশমিক শূন্য শতাংশ। মোট ২৩ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলারের পোশাক, বিশ্বে মোট পোশাক ব্যবহারের দশমিক ৪৮ শতাংশ। বিভাগের জন্য আমাদের উচিত লাতিন আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদির মতো অপ্রচলিত বাজারগুলোয় আরো বেশি মনোনিবেশ করা। কারণ অঞ্চলগুলোর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের চেয়ে আলাদা ঋতুচক্র রয়েছে। আমাদের মোট পোশাক রফতানিতে ক্যাটাগরির পোশাক রফতানির শেয়ার মাত্র দশমিক ৩৩ শতাংশ। অন্যান্য আইটেমের তুলনায় বিভাগে বিনিযোগ যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য নয়।

পুরুষ/ছেলেদের ওভেন শার্ট: বিশ্ববাজারে ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশ তুলনামূলক ভালো অবস্থানে। ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশ থেকে আমরা রফতানি করেছি দশমিক ৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিশ্ববাজারে আইটেমের ১৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ। আইটেমের জন্য বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য ছিল দশমিক ৮৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার অর্থ খাতে আরো প্রবৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে।

উল্লেখ্য, দশমিক ৮৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হলো বিশ্বের মোট পোশাক ব্যবহারের দশমিক ২৬ এবং বাংলাদেশের মোট পোশাক রফতানির দশমিক ৮৮ শতাংশ। এটি একটি বহুলব্যবহূত আইটেম, যেখানে আমরা আমাদের প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা প্রমাণ করেছি। পরবর্তী কয়েক বছরের জন্য আইটেমটি নিয়ে কাজ করার সময় আমাদের উচিত হবে বেশি মূল্যসংযোজনের দিকে মনোনিবেশের। এখানে খাতটির বেড়ে ওঠার সুযোগও বেশি, কারণ এটি কটনভিত্তিক নয়। খাতে আরো ভালো করার জন্য প্রয়োজন স্থানীয় পর্যায়ে ওভেন ফেব্রিক্সের জন্য আরো ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প স্থাপন দক্ষতা অর্জন। [চলবে]

 

মো. মহিউদ্দিন রুবেল: পরিচালক, বিজিএমইএ এবং পরিচালক, ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন