আবারো ১০ শতাংশের ওপরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি

খাদ্যদ্রব্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সরবরাহ শৃঙ্খল ঠিক রাখতে হবে

ছবি : বণিক বার্তা

দেশে ভোগ্যপণ্যের বাজারে দীর্ঘদিন ধরে অস্থিরতা বিরাজ করছে। খাদ্যদ্রব্যের বাজারদর ঊর্ধ্বমুখী। খাদ্য মূল্যস্ফীতির চাপে দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। বণিক বার্তার প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত মাসে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি কমলেও চলতি বছরের এপ্রিলে আবারো ১০ শতাংশের ওপরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি। ক্রমেই দাম বাড়ার কারণে ছোট হয়ে এসেছে মানুষের খাবার গ্রহণের তালিকা, আঁটসাঁট করে জীবন যাপন করতে হচ্ছে স্বল্প আয়ের মানুষদের। 

এরই মধ্যে সরকার নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে খাদ্য মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে। তবে দুঃখজনকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। দাম বেঁধে দিয়ে, শুল্ক কমিয়ে বাজারদর নিয়ন্ত্রণে সরকারের চেষ্টা যে খুব বেশি কার্যকর নয়, তা ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্তর বেশ ভালোভাবেই জানান দিচ্ছে।

বাজারদর স্থিতিশীল রাখার একটি অন্যতম উপায় হচ্ছে সরবরাহ শৃঙ্খল ঠিক রাখা। আমাদের দেশে প্রায়ই দেখা যায় খাদ্য উৎপাদনের প্রকৃত ও একক তথ্য পাওয়া যায় না। আবার আমদানি ও রফতানি-সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর  তথ্যে বিস্তর ফারাক পাওয়া যায়। এতে চাহিদা ও জোগানের ক্ষেত্রে সঠিক নীতি গ্রহণে যেমন সমস্যা দেখা দেয়, তেমনি অসাধু ও অতিমুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট কারসাজির মাধ্যমে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে সক্ষম হন। ফলে সরবরাহজনিত সংকটের মুখে পড়ে বাজারে হঠাৎ দাম বেড়ে যায় সব পণ্যের, বিশেষত খাদ্যদ্রব্যের। যার কারণে খাদ্য মূল্যস্ফীতি চড়াও হচ্ছে দিন দিন। আর ভোগান্তিতে পড়ছে ভোক্তারা, বাড়ছে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা। বিবিএসের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশে ২১ দশমিক ৯১ শতাংশ মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় আছে, যার মধ্যে তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এমন মানুষের সংখ্যা শূন্য দশমিক ৮৩ শতাংশ।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, খাদ্যের বাড়তি দাম বাংলাদেশের ৭১ শতাংশ পরিবারের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারের এমন অস্থিতিশীল অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে ও বাজারদর সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সরবরাহ শৃঙ্খল ঠিক রাখা অতি আবশ্যক। কেননা বাজার ব্যবস্থাপনার অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এটি। অন্যসব ঠিক থেকে চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ কমে গেলে মূল্যস্তর স্ফীত হতে থাকে। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গৃহীত মুদ্রানীতির সঙ্গে রাজস্বনীতির সমন্বয় প্রয়োজন। 

করোনা মহামারীর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি কমবেশি ৫ শতাংশের মধ্যে ছিল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিলে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ২২ শতাংশে, যা আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আর গত বছরের এপ্রিলে এ হার ছিল ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ। স্বাভাবিকভাবেই সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে খাদ্যপণ্যের পেছনে গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। আবার ব্যয় অনুসারে বাড়েনি আয়। ফলে চাপ পড়ছে মানুষের সঞ্চয়ে, কমছে বিনিয়োগ; যা অর্থনীতির গতিশীলতাকে ধীর করছে।

যেখানে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি ক্রমেই বাড়ছে সেখানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র পাকিস্তান ছাড়া অন্য সব দেশের মূল্যস্ফীতি তুলনামূলকভাবে কম। সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হিসেবে এক্ষেত্রে তুলে ধরা যায় শ্রীলংকার নাম। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালের সংকটকালে দেশটির মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৪৯ শতাংশের বেশি। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে এ হার নেমে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৩ শতাংশে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৪ সাল থেকে ধীরে ধীরে শ্রীলংকর অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করবে। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে শ্রীলংকা। এর মধ্যে কঠোর মুদ্রানীতি, ব্যাংকের সুদের হার ও রাজস্ব আয় বাড়ানো, ঋণ পুনর্গঠন, শিল্প ও কৃষি খাতে উৎপাদন বাড়ানো উল্লেখযোগ্য। 

আমাদের সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকও এমন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে মূল্যস্ফীতি কমাতে। ব্যাংক খাতে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ থেকে কয়েক দফা বাড়িয়ে উন্নীত করা হয়েছে ১৪ শতাংশে। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির অংশ হিসেবে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ প্রদানের নীতি থেকেও সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাজার নিয়ন্ত্রণে কয়েক দফায় নির্দিষ্ট কিছু নিত্যপণ্যের দরও নির্ধারণ করে দেয়া হয়। মজুদদারি নিয়ন্ত্রণে বারবার অভিযানেও নেমেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এত সব প্রয়াস সত্ত্বেও দেশে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন এর অন্যতম প্রধান কারণ সরবরাহজনিত সংকট ও মুদ্রানীতি-রাজস্বনীতির সমন্বয়হীনতা।

সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নেয়া হলেও বাজেট ছিল সম্প্রসারণমূলক। অন্যদিকে রাজস্ব আয় বাড়ানো যায়নি। পরোক্ষ কর বাড়ানো হয়েছে কিন্তু প্রত্যক্ষ করের আওতা বৃদ্ধি সম্ভব হয়নি। এসবের বিপরীতে অবস্থা আরো শোচনীয় হয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে কেবল নীতি প্রণয়ন নয়, সমন্বয়ও জরুরি। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ার পেছনে বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও কথিত সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই।

মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে এবং উৎপাদন বাড়াতে হবে। বাজার অর্থনীতিতে দাম নির্ধারণ করে বাজারদর নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন। কোনো দালাল, ফড়িয়া বা মধ্যবর্তী গোষ্ঠী যেন অতি মুনাফা অর্জনে কৃত্রিম সংকট তৈরি না করতে পারে এবং দাম বাড়িয়ে দিতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের এ বিষয়ে তৎপরতা বাড়ানো প্রয়োজন। বিশেষ করে সরকারিভাবে কৃষিদ্রব্যের গুদামজাত যত বেশি করা যাবে, অবৈধ মজুদকারীর দৌরাত্ম্য তত কমানো সম্ভব হবে। পাশাপাশি কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে আমদানিনির্ভরতা থেকে ধীরে ধীরে সরে আসা দরকার। বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাড়ানোর মাধ্যমে প্রতিযোগিতা বাড়াতে হবে। তাহলে দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা যাবে। 

তবে এসবই দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। চলমান সংকটে নিম্ন ও স্বল্প আয়ের মানুষকে বাড়তি দামের অভিঘাত থেকে রক্ষা করতে হলে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে হবে। টিসিবির মাধ্যমে খোলাবাজারে পণ্য বিপণন ও তদারকি জোরদার করতে হবে। এছাড়া আমদানি-রফতানি ব্যবস্থাপনায় কঠোর নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা নিশ্চিতে তৎপরতা দরকার। সর্বোপরি মূল্যস্ফীতির অভিঘাত থেকে রক্ষায় আরো বেশিসংখ্যক মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা জালের আওতায় আনা এক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি। আসন্ন অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো এখন সময়ের দাবি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন