মানবিক কারণ দেখিয়ে বেসিক ব্যাংকে নিয়োগ অনিয়ম নিষ্পত্তির উদ্যোগ

জেসমিন মলি

সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল হাই বাচ্চু ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৪ সালের জুলাই পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। সে সময় ব্যাংকটিতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ দেয়া হয়। এমন প্রমাণও রয়েছে যে চেয়ারম্যান থাকাকালে আবদুল হাই বাচ্চু জীবনবৃত্তান্তের সঙ্গে চিরকুট লিখে পদ-পদবিও নির্ধারণ করে দিতেন। তার নিয়মবহির্ভূত নির্দেশনা বাস্তবায়ন করত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পর্ষদ। সে সময় হাজার ৫২০ জনবল নিয়োগ পদায়নের সত্যতা উঠে আসে বাংলাদেশ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজিকার্যালয়ের নিরীক্ষায়। বিষয়ে আপত্তিও জানায় সিএজি কার্যালয়। বেসিক ব্যাংকের নিয়োগে অনিয়মের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান এখনো মামলা পর্যন্ত গড়ায়নি। উল্টো নিয়োগ-পদোন্নতিসংক্রান্ত অনিয়মের বিষয়গুলো এখন মানবিক কারণ দেখিয়ে নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে উপস্থাপনের জন্য সিএজি কার্যালয়ের তৈরি করা এক প্রতিবেদন বণিক বার্তার হাতে এসেছে। সেই প্রতিবেদনে বেসিক ব্যাংকের ২০১৩-১৪ অর্থবছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে নিয়োগ নীতিমালা উপেক্ষা করে নিয়োগ এবং কৃতিত্বপূর্ণ অবদান বা অর্জন না থাকা সত্ত্বেও এক্সিলারেটেড প্রমোশন দেয়ায় ব্যাংকের শৃঙ্খলা ভঙ্গ শীর্ষক একটি আপত্তি ওঠে। সরকারি হিসাব কমিটির ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে আপত্তির বিষয়টি মানবিক দিক বিবেচনা করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর কী ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে সে বিষয়ে মতামতসহ প্রতিবেদন দিতে একটি কমিটি গঠন করে দেয়া হয়। ছয় সদস্যের ওই কমিটির প্রধান করা হয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবকে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর, বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব। কমিটিকে ৬০ দিনের মধ্যে সিএজি কার্যালয়ের মাধ্যমে প্রতিবেদন পাঠানোর সুপারিশ করা হয়। পরে চলতি বছরের ২১ জুলাই বৈঠকে কমিটির মেয়াদ আরো চার সপ্তাহ বাড়িয়ে নেয়া হয়।

বেশ কয়েকটি সভায় কমিটির সদস্যরা আপত্তিভুক্ত ৮০৪ জন কর্মচারীর নিয়োগ পদোন্নতি-সংক্রান্ত সব কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। সেটির সারাংশ সিএজি কার্যালয়ে পাঠানো হয়। তবে তাতে বিস্তারিত উল্লেখ নেই বলে নিরীক্ষা কর্তৃপক্ষ পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পাঠানোর কথা বলে। যে কথা সিএজির প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়েছে।

বেসিক ব্যাংকের নিয়োগের আরেকটি আপত্তি ছিল নীতিমালা অনুসরণ না করে উপযুক্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা সিভি বা আবেদনপত্র না থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন পদে ৭২৬ জন কর্মকর্তা নিয়োগ। যার মাধ্যমে ব্যাংকের দায় বৃদ্ধিসহ আর্থিক ক্ষতিসাধনের অভিযোগ ওঠে। এটিও নিষ্পত্তির জন্য ছয় সদস্যের ওই কমিটিতে পাঠানো হয়। আপত্তির বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন না দেয়ায় সিএজি কার্যালয় পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন চেয়ে অনুশাসন দেয়ার কথা তাদের প্রতিবেদনে জানায়।

যথাযথ নিয়োগ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে নিয়োগ দেয়া, ভুয়া সনদের মাধ্যমে চাকরিতে যোগদান, চাকরিচ্যুতির পর আবারো নিয়োগ দেয়ার বিষয় নিয়ে নিরীক্ষায় আরেকটি আপত্তি ওঠে। এছাড়া অন্য আপত্তিগুলো ছিল বয়স্ক অনুপযুক্ত প্রার্থীকে উচ্চতর পদে নিয়োগ, অবৈধ পন্থায় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সেখান থেকে অর্জিত স্নাতক সনদ জমা দিয়ে ব্যাংকে অনিয়মিতভাবে নিয়োগ এবং বেতন-ভাতা পরিশোধ করায় ব্যাংকের ১৪ লাখ ২০ হাজার টাকার ক্ষতি। এসব আপত্তির বিষয়টিও মানবিক দিক বিবেচনা করে প্রতিবেদন দিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের কমিটিতে পাঠানো হয়।

তবে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আরো দুটি আপত্তির বিষয় উঠে এসেছে। এগুলো হলো ব্যাংক কোম্পানি আইন বাংলাদেশ ব্যাংকের আদেশ অমান্য করে অর্থ আত্মসাৎ, দুর্নীতি জালিয়াতির অভিযোগে চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেয়ায় ব্যাংকের ক্ষতি ২০ লাখ ১১ হাজার টাকা এবং ক্ষমতাবহির্ভূতভাবে অধ্যক্ষের পদ না থাকা সত্ত্বেও অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেয়ায় ব্যাংকের বেতনভাতাদি বাবদ ৩৯ লাখ টাকা অপচয়। দুটি আপত্তির বিষয়ে বেসিক ব্যাংক বেশকিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে আরো ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিষয়টি যাচাই-বাছাই করতে কমিটির পক্ষ থেকে সুপারিশ করা হয়েছে।

সরকারি হিসাব কমিটির সভাপতি মো. রুস্তম আলী ফরাজী বণিক বার্তাকে বলেন, সরকারি হিসাব কমিটি বেসিক ব্যাংকের নিয়োগসংক্রান্ত অনিয়মের জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করে দিয়েছিল। হিসাব কমিটির কাছে সিএজির মাধ্যমে সেই প্রতিবেদন এসেছে। সেই ভিত্তিতে আমরা আপত্তির বিষয়ে সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখানে মানবিক দিক বিবেচনার কোনো সুযোগ নেই। দুটি আপত্তির বিষয় আরো স্পষ্ট করতে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নিতে বলা হয়েছে। সেই অনুসারে কমিটি পরবর্তী সময়ে সিদ্ধান্ত নেবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন