পর্যালোচনা

অর্থ পাচার কি আইনি বৈধতা পাচ্ছে?

ড. মো. আইনুল ইসলাম

দার্শনিক টমাস বেকন (১৫১২-১৬৬৭) অর্জনপ্রবণ-মুনাফাকেন্দ্রিক ক্রয়-বিক্রয়প্রধান অর্থনীতির দাপট দেখে মন্তব্য করেছিলেন, ‘যেসব ব্যক্তি ব্যক্তিগত দুর্নীতি করে নিজেদের মুনাফার অনুসন্ধানে লিপ্ত, তারা হলেন লোভী, মেষপালক আর রাখাল স্বভাবের ভদ্রলোক।সবাই বলেন, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা বহু ধরনের দুর্নীতি করেন। মুদিখানার দোকানিদেরও তো হিসাবরক্ষণে আসল খাতা, নকল খাতা নামে একাধিক খাতা থাকে। বিভিন্ন পেশার মানুষও তো কম-বেশি দুর্নীতি করে। এমনকি মহৎ পেশার শিক্ষকও জ্ঞানার্জন জ্ঞান বিতরণে গাফিলতি করে দুর্নীতি করেন। রাষ্ট্রের তিন অঙ্গের (নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা বিচার বিভাগ) হেন কোনো বিভাগ নেই, যেখানে দুর্নীতি নেই। দুর্নীতি এখন বাংলাদেশে সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। শুধু কী ব্যবসায়ীদের দোষ! এই যে সাম্প্রতিক সময়ে সুইস ব্যাংক বাংলাদেশীদের বিপুল পরিমাণ টাকা জমা নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়েছে, প্রতি বছরই এমন একটা সময় আসে, যখন অর্থ পাচার প্রসঙ্গটি নিয়ে দেশের টং দোকান থেকে শুরু করে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পাঁচ তারকা হোটেলেও ব্যাপক আলোচনা হয়। এরপর যথারীতি সব থিতিয়ে যায়। পরবর্তী বছর দেখা যায়, পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় অর্থ পাচার আরো বেড়েছে। এভাবেই তো চলছে। বিরক্ত জনগণের অনেককেই তাই এখন বলতে শুনি, ‘অর্থ পাচার আইন করে বৈধ করে দেয়া হোক। তাহলেই তো সব পাঠ চুকে যায়।

দেশের জনগণ এমন মন্তব্য করতেই পারে। কেননা প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সুইস ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশীদের অর্থ পাচারের তথ্যে অতিশয়োক্তি রয়েছে বলে দাবি করে বক্তব্য দেন, সাংবাদিকরাঅত্যন্ত অন্যায়ভাবেবিষয়টিকে প্রচার করছেন। তবে কিছু অর্থ পাচার হয়। সেটি অতি যৎসামান্য। এটা নজরে নেয়ার মতোই নয়। কেননা  বর্তমান অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল ২০২১ সালের জুন সংসদে দাঁড়িয়ে বলেনকারা অর্থ পাচার করে, সেই তালিকা আমার কাছে নেই। নামগুলো যদি আপনারা জানেন, আমাদের দিন।কেননা পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, ‘সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের গচ্ছিত অর্থ দেশে ফেরত আনা প্রায় অসম্ভব এবং এর আইনি প্রক্রিয়াও নেই।কেননা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সদ্যবিদায়ী গভর্নর ফজলে কবির গত ১০ জুন বাজেট পেশ-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে কেউ অর্থ পাচার করে সুইস ব্যাংকে জমা করেছেএমন কোনো তথ্য আমরা পাইনি।অথচ ২০১৪ সালের ২৮ জুন জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘সুইস ব্যাংকে কে কত টাকা পাচার করেছেন, তার তালিকা হচ্ছে। দেশের টাকা আমরা দেশে ফিরিয়ে আনবই। অতীতেও দেশের সম্পদ লুটপাট করে বিদেশে পাচার করা টাকা আমরা ফিরিয়ে এনেছি। মে ২০১৯ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুক্তরাজ্য শাখা দলের সহযোগী সংগঠনগুলোর সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়তার সঙ্গে আবারো বলেন, ‘খুনি অর্থ পাচারকারীরা যেখানেই লুকিয়ে থাকুক, যত টাকাই খরচ করুকতাদের কোনো ক্ষমা নেই। জাতি তাদের ক্ষমা করবে না।

এসব বক্তব্যের মাঝেই তথ্য-উপাত্ত আসছে, বাংলাদেশ থেকে চলতি বছর আগের চেয়ে বেশি পরিমাণে অর্থ পাচার হয়েছে, এখন যার বার্ষিক পরিমাণ লাখ কোটি টাকা। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) বলেছে, শুধু ২০১৪ সালেই বাংলাদেশ থেকে হাজার কোটি ডলার পাচার হয়েছে, বাংলাদেশী মুদ্রায় যা প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকার সমান, যা দিয়ে তিনটি পদ্মা সেতু তৈরি করা যেত। ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে জিএফআই প্রকাশিত বৈশ্বিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আমদানি-রফতানি কার্যক্রমের মাধ্যমে মূল্য কম-বেশি দেখিয়ে ২০০৯-১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে হাজার ৯৬৫ কোটি মার্কিন ডলার পাচার হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে ৭৫ হাজার কোটি টাকা করে পাচার হয়েছে। জিএফআইয়ের হিসাবে, বাংলাদেশ থেকে যত পণ্য আমদানি-রফতানি হয়েছে এর মধ্যে ১৭ দশমিক শতাংশের মূল্য ঘোষণাতেই গরমিল থাকে। আমদানি-রফতানিতে মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে গত ১০ বছরে (২০০৯-১৮) গড়ে দশমিক ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (বর্তমান টাকার বাজারমূল্যে আনুমানিক ৭৩ হাজার কোটি টাকার মতো) পাচার হয়েছে, যা আমাদের বর্তমান জাতীয় বাজেটের মোট রাজস্বের প্রায় ১৮ দশমিক ৬০ শতাংশ। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড ২০২১শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের মোট অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় হাজার ২৭৬ কোটি টাকা, ২০২০ সালে যা ছিল ৫৬ কোটি ২৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে হাজার ৯২৮ কোটি টাকা বেড়ে ৫৫ শতাংশ হয়েছে। অথচ সুইস ব্যাংকে ২০০২ সালে বাংলাদেশীদের আমানত ছিল মাত্র কোটি ১০ লাখ ফ্রাঁ। অর্থাৎ দুই দশকে তা বেড়েছে প্রায় ৩০ গুণ। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ . আবুল বারকাত এক গবেষণায় উল্লেখ করেছেন, বিগত ৪৬ বছরে (১৯৭২-৭৩ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে) দেশে মোট অর্থ পাচারের পরিমাণ হবে কমপক্ষে লাখ ৯৮ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ থেকে পাচার অর্থে সুইস ব্যাংকের হিসাবই শুধু ফুলেফেঁপে উঠছে না, কানাডায় বেগমপাড়া, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম, অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডে ব্যবসা-বাড়িও ক্রয় হচ্ছে। ১২ আগস্ট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ প্রকল্প সম্পর্কিত এক সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে অর্থ মন্ত্রণালয় অতীতে ৬৭ জনের নাম উল্লেখ করে চিঠি দিয়ে সুইস ব্যাংকের থেকে তথ্য চেয়েছিল, কিন্তু কোনো তথ্য দেয়া হয়নি। পরবর্তী সময়ে শুধু একজনের তথ্য দেয়া হয়েছিল।পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেছেন, বেগমপাড়ায় যে ২৮ জন অর্থ পাচারকারীর নাম তিনি পেয়েছেন, তাদের অধিকাংশই সরকারি কর্মকর্তা রাজনীতিবিদ। দুদক মোট ৬০ ব্যক্তির অর্থ পাচারের তথ্য চেয়ে ১৮টি দেশে চিঠি দিয়েছিল, যার মধ্যে ৩০ জনের তথ্য সংস্থাটি পেয়েছে, যাদের মধ্যে বর্তমান সাবেক সংসদ সদস্যরাও আছেন। ১৮টি দেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, আরব আমিরাত, থাইল্যান্ড মালয়েশিয়ার নাম রয়েছে। পানামা পেপারসের বিদেশে অফশোর কোম্পানির তালিকায়ও বাংলাদেশের সাবেক এমপি, মন্ত্রী, আমলাও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ পেয়েছে। দুদক মাঝেমধ্যেই মহাআড়ম্বরে তদন্তের ঘোষণা দিলেও পরে আর সেসবের খবর থাকে না।

রাজনীতি অর্থনীতির জটিল সব হিসাব-নিকাশের মধ্যে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ আদৌ কি দেশে ফেরত আনা সম্ভব? অর্থনীতিবিদ পর্যবেক্ষকদের মতে, কিছুটা জটিল সময়সাপেক্ষ হলেও সরকার চেষ্টা করলে এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে আইনিভাবে অবশ্যই তা ফেরত আনা সম্ভব। বাংলাদেশ অতীতে দুর্নীতির মাধ্যমে বিদেশে পাঠানো অনেক টাকা ফেরত এনেছেও। পৃথিবীতে বছরে অর্থ পাচারের পরিমাণ আনুমানিক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার (অথবা লাখ কোটি মার্কিন ডলার) অর্থাৎ ১৬৬ লাখ কোটি টাকা, যা বৈশ্বিক জিডিপির শতাংশের সমপরিমাণ। কারণে অটোমেটিক এক্সচেঞ্জ অব ইনফরমেশন (এইওআই) নামে ব্যবস্থা থেকে তথ্য পাওয়ার আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয় ২০১৭ সালে, যার আওতায় নিজ দেশে কর ফাঁকি দিয়ে সুইস ব্যাংকে অর্থ জমা রাখলে তার তথ্য দিতে বাধ্য থাকে সুইস ব্যাংকগুলো। কাঠামোতে ১২১টি দেশ থাকলেও বাংলাদেশ নেই। ভারত, পাকিস্তান, এমনকি মালদ্বীপ এতে স্বাক্ষর করলেও বাংলাদেশ করেনি। সুইস ব্যাংক ২০২১ সালে ৯৬টি দেশের ৩৩ লাখ, ২০২০ সালে ৮৬টি দেশের ২১ লাখ এবং ২০১৯ সালে ৭৫টি দেশকে তালিকা দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ কখনো তালিকা পায়নি। কারণ, বাংলাদেশ আসলে কখনো বিধিবদ্ধভাবে তালিকা পাওয়ার চেষ্টাই করেনি, পাচারকৃত অর্থ ফেরতও আনতে চায়নি।

যখন অবস্থা, তখন জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব করার পরদিন ১০ জুন রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বাজেটে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ কর দিয়ে বৈধ করার প্রস্তাব দেয়া প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘যারা নিয়ে গেছেন বুঝতেই পারেননি, না বুঝেই নিয়ে গেছেন। সেজন্য তো হোয়াইট করার জন্য সেগুলোকে আমাদের অর্থনীতির মূলধারায় নিয়ে আসতে কাজটি করা হবে।এখানে স্মরণ করা সমীচীন হবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৮৮৩ সালে পেনডলেটন আইন পাস না হওয়া পর্যন্ত সরকারি চিফ হুইপ বা মার্কিন কংগ্রেসের মেজরিটি লিডারকেট্রেজারি বেঞ্চের পৃষ্ঠপোষক সেক্রেটারি’ (প্যাট্রোনেজ সেক্রেটারি অব দ্য ট্রেজারি) বলা হতো। কারণ, নিজ দলীয় ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতা স্বার্থ দেখাই ছিল তার প্রধান কাজ। আমাদের নীতিনির্ধারকদের কথাবার্তা আর কর্মকাণ্ডে মনে হয়, আমরা সেই দেড় বছর আগে ফিরে গেছি। অবস্থায় জনগণ যদি বলেন, ‘আইন করে অর্থ পাচার বৈধ করে দিন’, তাহলে অন্যায়ের তো কিছু নেই।

 

. মো. আইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন