অভিমত

উন্নয়ন প্রকল্পের নামে অর্থের অপচয় বন্ধ হোক

কায়সুল খান

ছবি : বণিক বার্তা

মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করার পর থেকে এরই মধ্যে ৫০ বছরেরও বেশি সময় পার হয়েছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের ভঙ্গুর অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক কাঠামোকে সংস্কার করে বাংলাদেশ আজ একটি উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। কৃষিভিত্তিক একমাত্রিকতা থেকে বের হয়ে মূলত পোশাক শিল্পের হাত ধরে আমাদের অর্থনীতি বহুমাত্রিক গতিপথ লাভ করেছে। তবে এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, সময়ের পরিক্রমায় এবং সরকারের পরিকল্পনাহীনতার দরুন বাংলাদেশের পাট শিল্প, চামড়া শিল্প, চা শিল্প প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। কৃষিতেও ধান উৎপাদনে অতি আগ্রহের ফলে পাট, গম, সবজি, তেলবীজ উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা তথা অর্থনীতির জন্য শুভ সংবাদ নয়।

গত শতকের আশির দশকের শেষ ভাগে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। এতে আমাদের অর্থনীতি যে নতুন গতি পায় তা এ দেশে অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তাকে জরুরি করে তুলেছিল। ফলে সারা দেশব্যাপী যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। আমরা জানি, বাংলাদেশে উন্নয়নের নামে অর্থনীতির আয়তনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এমন প্রকল্প নেয়ার জন্য একটি তীব্র প্রতিযোগিতা দৃশ্যমান। এ দেশের বাজারে কাঁচামাল, শ্রমিকের মজুরি, সরকারি কর, দ্রব্য পরিবহন খরচ ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় নিলে উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় অতিমাত্রায় বেশি বলে প্রমাণ মেলে। আমাদের অবকাঠামোর মান, স্থায়িত্ব এবং প্রকল্প পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণের হিসাব বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও উন্নত দেশের উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে তুলনা করলে এটা সুস্পষ্ট যে, বাংলাদেশে অর্থের ব্যাপক অপচয় হয়। এ অপচয়ের ফলে অর্থনীতিতে অসম আয়ের পথ যেমন উন্মুক্ত হয়, তেমনি নাগরিকের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। ফলে বাংলাদেশের নাগরিকদের জীবনযাপনের ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ সে অনুযায়ী আয়ের পথ স্বাভাবিক কারণেই না বাড়ার ফলে রাষ্ট্রের অধিকাংশ নাগরিকের আর্থিক সক্ষমতা হ্রাস ও নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য ও কাম্য নয়।

পৃথিবীজুড়ে উন্নয়নশীল ও ছদ্মগণতান্ত্রিক দেশগুলোর সরকার অবকাঠামোগত উন্নয়নকে জনতুষ্টির একটি হাতিয়ার হিসেবে দেখাতে চেষ্টা করে। এ ধরনের দেশগুলোয় যখন গণতন্ত্রহীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে পড়ে তখন জনগণের সামনে অবকাঠামোগত উন্নয়নের চিত্র মেলে ধরা হয়। এটাকে সরকারের সাফল্য হিসেবে দেখানো হয় এবং তথাকথিত এ উন্নয়নের বিনিময়ে জনগণের অধিকার হরণকে জায়েজ করতে চায়। অবকাঠামোগত উন্নয়নের সবচেয়ে বড় সুবিধা, এটা দৃশ্যমান এবং সহজে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণে দারুণ কার্যকরী। অবকাঠামোগত উন্নয়নকে উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করে বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের দেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে দেখাতে চায় সরকার। অথচ বাংলাদেশে অবকাঠামো ব্যয় বিশ্বের মাঝে অন্যতম ব্যয়বহুল এবং অনেক ক্ষেত্রেই কাজের মান খুবই খারাপ। আমাদের সড়ক-মহাসড়ক, ব্রিজ-কালভার্ট, ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন, মেট্রোরেল, বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর কিংবা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয় মান অনুযায়ী অস্বাভাবিক রকমের বেশি এবং কিছু ক্ষেত্রে সেগুলো ইউরোপ-আমেরিকার চেয়েও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেশি। 

ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে যেকোনো ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প সরকারি দলের স্বার্থ কিংবা রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারকেন্দ্রিক হয়ে থাকে এবং সরকার বদলের পরিপ্রেক্ষিতে সেগুলোর ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হওয়ার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদলে উন্নয়ন প্রকল্প স্থগিত হওয়ার অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যায় এবং সেটি জাতীয় কিংবা স্থানীয় উভয় পর্যায়ের জন্যই প্রযোজ্য। যদিও বিতর্কিত নির্বাচনে বারবার ক্ষমতায় যাওয়া বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতা ১৫ বছরের অধিক সময় ধরে চলমান থাকায় অবকাঠামোগত উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বিনষ্ট হয়নি, কিন্তু একই সঙ্গে এ সরকারের আমলে অপব্যয় ও কল্পনাতীত ব্যয়বহুল বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এই যে বাংলাদেশে সরকারি কর্মকাণ্ডের নিরীক্ষা হওয়ার সুযোগ সীমিত হওয়ায় এবং শক্তিশালী বিরোধী দল ছাড়া বারবার জাতীয় সংসদ গঠিত হওয়ায় জনগণের করের অর্থে সংস্থান হওয়া সরকারি ব্যয়ের কোনো ধরনের হিসাব দেশের কোনো দায়িত্বশীল নিরীক্ষা সংস্থাকে দিতে হয় না। বরং দুর্নীতির যে অভিযোগগুলো পত্রপত্রিকা কিংবা দেশী-বিদেশী গবেষণা সংস্থাগুলো উপস্থাপন করে সেগুলোকে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হিসেবে দেখানোর একটা সংস্কৃতি লক্ষ করা যায়।

বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসের (বিবিএস) দেয়া তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে জানা যায়, এ দেশে ধন-বৈষম্য ক্রমে প্রকট হচ্ছে। অবকাঠামোগত খাতে অপরিকল্পিত অর্থায়ন ও অপব্যয় এ ধন-বৈষম্যকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলেছে। ফলে যেকোনো সরকারের আমলে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী ধনী থেকে আরো বেশি ধনী হয়ে উঠছে এবং বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ করার সুযোগ হারাচ্ছে এবং রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে তাদের কর্মসংস্থান ও আর্থিক সক্ষমতা প্রবলভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। 

অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে অপব্যয়ের আরেকটি কারণ হলো বৈদেশিক ঋণ সহায়তা। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় প্রতিবেশী ভারত, নতুন অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি চীন এবং ঐতিহাসিকভাবে শত্রুভাবাপন্ন দেশ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ দেয়ার মাধ্যমে ক্রমে নানা শর্তারোপের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কৌশলগত পরিকল্পনা ও রাজনৈতিকর দলগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে মুখিয়ে থাকে। বাংলাদেশের বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে সুপরিচিত জাপান কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবও সাম্প্রতিক সময়ে উপর্যুক্ত পন্থা অবলম্বনের প্রমাণ দিয়েছে। ফলে ঢাকার মেট্রোরেল প্রকল্প, চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর টানেল, পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র কিংবা পায়রায় গভীর সমুদ্র বন্দরের নির্মাণ ব্যয় অস্বাভাবিক রকমভাবে বারবার বৃদ্ধি করতে দেখা গেছে। বাংলাদেশের আরেকটি বড় সংকটের কেন্দ্রবিন্দু হলো প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে গত দেড় দশকে আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণকারী দেশটি তাদের সেভেন সিস্টার্সখ্যাত রাজ্যগুলোর ওপর সার্বভৌমত্ব, সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারের জন্য বাংলাদেশের কাছে অস্বাভাবিক রকম সুবিধা গ্রহণ করছে এবং ট্রানজিটের নামে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে পূর্ব-ভারতীয় রাজ্যগুলোয় পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের নাগরিকের পয়সায় বা নামে ইস্যুকৃত ঋণের অর্থে সড়ক যোগাযোগের ব্যবস্থা করেছে, যার ফলে একদিকে ভারতের যেমন বিপুল অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে বাংলাদেশের জনগণের ওপর ঋণ ও করের বোঝা ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

বাংলাদেশ সরকারকে একটি বিষয় উপলব্ধি করতে হবে যে, অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা সর্বজনস্বীকৃত। তবে মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা অবকাঠামোগত উন্নয়নের চেয়ে অধিক জরুরি। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের কিংবা উন্নত দেশে পরিণত হতে চাইলে আমাদের জনশক্তিকে স্বাস্থ্যবান, সুশিক্ষিত, নিয়মতান্ত্রিক ও দক্ষ করে তুলতে হবে। সেজন্য প্রয়োজন চিকিৎসা ও শিক্ষায় বিপুল বিনিয়োগ। অবিশ্বাস্যজনক হলেও সত্য যে, স্বাস্থ্য খাতের জন্য আমাদের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ শতাংশেরও কম পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রয়েছে, যা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন (বাংলা ট্রিবিউন, ১৯ মে, ২০২৪)। স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশ নাগরিকপ্রতি বার্ষিক মাত্র ৫৮ ডলার ব্যয় করে। অথচ বাংলাদেশের বাস্তবতায় যা ন্যূনতম ৮৮ ডলার হওয়া উচিৎ। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভুটান ও মালদ্বীপে এই ব্যয়ের অংক যথাক্রমে ১৮০ ও ১০৩৮ ডলার (প্রথম আলো, ১৬ মে, ২০২৪)। অন্যদিকে শিক্ষা খাতেও বাংলাদেশের বাজেট বরাদ্দ অস্বাভাবিক রকমের কম। শিক্ষা ও প্রযুক্তি মিলিয়েও বাংলাদেশ মোট জিডিপির ২ শতাংশের কম অর্থ ব্যয় করে থাকে। ইউনেস্কোর পরামর্শ হলো, কেবল শিক্ষা খাতে একটি দেশের মোট জিডিপির অন্তত ৬ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া উচিত। 

বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় স্থান করে নিতে চাইলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পের চেয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বৃদ্ধির দিকে মনোযোগী হতে হবে। আমাদের সরকারকে ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থের বাইরে গিয়ে রাষ্ট্রের সব নাগরিকের জন্য যৌক্তিক ও ন্যায্যতাভিত্তিক আর্থিক সক্ষমতা নিশ্চিতের প্রতি আগ্রহী হতে হবে। অন্যথায় বিপুল অপব্যয়ী অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প ক্রমে জাতির কাঁধে ঋণের বোঝা বাড়াবে, যা দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশী নাগরিকদের জীবনমানের আকাঙ্ক্ষিত ও ইতিবাচক পরিবর্তন করতে পারবে না। বরং জাতির ভবিষ্যৎকে ক্রমে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেবে। 

কায়সুল খান: গবেষক, নোভা ইউনিভার্সিটি অব লিসবন, পর্তুগাল 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন