জিডিপির অনুপাতে বাজার মূলধন নেমেছে ১৩ শতাংশে

পুঁজিবাজার শক্তিশালী করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে

ছবি : বণিক বার্তা

অর্থনীতির শক্ত ভিত গড়ে তুলতে পুঁজিবাজারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে পুঁজিবাজার প্রায়ই অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। ফলে বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারান এবং পুঁজিবাজার কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়। কয়েক বছর ধরে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারেও। সে ধারাবাহিকতায় চলতি বছর পুঁজিবাজারের সূচক তেমন বাড়েনি। ফ্লোর প্রাইস, সুদহার বৃদ্ধি, টাকার অবমূল্যায়ন, ডলারের বিনিময় হারের অস্থিরতা, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর আয় কমে যাওয়া ও বিদেশী শেয়ার বিক্রির মতো বিভিন্ন ইস্যুতে দীর্ঘদিন ধরেই দেশের পুঁজিবাজার অস্থিতিশীল ও নেতিবাচক ধারায় রয়েছে। যে কারণে বিনিয়োগকারীরা প্রত্যাশা অনুযায়ী মুনাফা অর্জন করতে পারেননি। 

একটি দেশের পুঁজিবাজারের আকার কত বড় তা পরিমাপ হয়ে থাকে মূলত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সঙ্গে বাজার মূলধনের অনুপাতের মাধ্যমে। সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের ধারাবাহিক অবনতির কারণে প্রভাব পড়েছে দেশের পুঁজিবাজারে। দেশে জিডিপির আকার বড় হচ্ছে। কিন্তু সেই অনুপাতে বাড়ছে না পুঁজিবাজারের মূলধনের আকার। পুঁজিবাজারের ক্রমাগত নিম্নমুখিতার কারণে বর্তমানে দেশের জিডিপির অনুপাতে বাজার মূলধনের পরিমাণ নেমে এসেছে ১৩ শতাংশে, যা উন্নত ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির তুলনায় অনেক কম। উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোয় এ অনুপাত ১০০ থেকে ২০০ শতাংশের মধ্যে ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোয় ৫০ শতাংশ থেকে প্রায় সমান হয়। পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে নিতে হবে কার্যকর পদক্ষেপ। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে রয়েছে আস্থার সংকট। এ সংকট কাটিয়ে উঠতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। দেশের ভালো ও বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে পুঁজিবাজারে আনতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে, যা বাজার মূলধন বাড়াতে সহায়ক হবে। এসব কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে আনতে মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির সমন্বিত বাস্তবায়ন জরুরি। একই সঙ্গে তাদের প্রণোদনা দেয়ার পাশাপাশি পুঁজিবাজারে আসার জন্য আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমেই পরিস্থিতির উত্তরণ সম্ভব ও জিডিপির অনুপাতে বাজার মূলধন বাড়তে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। 

আগামী অর্থবছরের বাজেটে মূলধনি মুনাফার ওপর করারোপের প্রস্তাব করা হবে—এমন খবরেও দেশের পুঁজিবাজারে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। এ নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শঙ্কাও কাজ করছে। কারণ দুই বছর ধরে ফ্লোর প্রাইসের কারণে তারা আটকে ছিলেন, তেমন কোনো মুনাফা করতে পারেননি। এ অবস্থায় মূলধনি মুনাফায় করারোপ করা হলে তারা লোকসানে পড়তে পারেন। তাই সার্বিক দিক বিবেচনায় নিয়ে মূলধনি মুনাফায় করারোপ মোটেই ভালো হবে না। এতে পুঁজিবাজারের গতিশীলতাকে শ্লথ করে দিতে পারে। 

বরাবরের মতোই বিনিয়োগকারী ও সংশ্লিষ্টরা চলতি বছর সমন্বিত প্রচেষ্টায় পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা করেছিলেন। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের হারানো পুঁজি ফিরবে এমন প্রত্যাশাও ছিল। ২০২৩ সালের হতাশা কাটিয়ে পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে—এমনটিই প্রত্যাশা ছিল তাদের। কিন্তু পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি, বরং অধঃপতন হয়েছে।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষকদের ভাষ্যমতে, পুঁজিবাজারে গতি ফেরাতে হলে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এজন্য দেশী-বিদেশী ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া পুঁজিবাজার কারসাজিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে ব্যাংক খাতের সমস্যার সমাধানও করতে হবে। এ মুহূর্তে পুঁজিবাজারের সবচেয়ে বড় সমস্যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকট। বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের কোনো আস্থা নেই। ফলে বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারবিমুখ হয়ে গেছেন। যে কারণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হলেও বাজারে তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।

আর্থিক খাত ও পুঁজিবাজার সংস্কারে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। এজন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারের পাশাপাশি পুঁজিবাজারের সুশাসন পরিস্থিতির উন্নতি হলে সেটি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে সহায়ক হবে এবং বাজারও ঘুরে দাঁড়াবে। পুঁজিবাজার শক্তিশালী করতে টোটকা পদক্ষেপের বিপরীতে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেয়ার প্রতি জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। 

পুঁজিবাজারে গতি ফেরাতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কার্যকর ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ প্রয়োজন। বেশির ভাগ বিনিয়োগকারীর ধারণা, নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদারকির ঘাটতির ফলেই বাজারে নানাভাবে কারসাজির ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে একটি গোষ্ঠী তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য বাজারকে নানাভাবে ব্যবহার করছে, এমন অভিযোগ ২০১০ সালের বিপর্যয়ের পর থেকে বারবার উত্থাপন করা হচ্ছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে সুচিন্তিত পদক্ষেপের পাশাপাশি ভালো কোম্পানিগুলোকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করতে উৎসাহিত করতে হবে।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের পর দেশের পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে—এমন প্রত্যাশা ছিল সবার। এ কারণে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহার করে নেয়। এতে বড় দরপতনের শঙ্কা থাকলেও শুরুর ধাক্কা সামাল দিয়ে বাজার ঘুরে দাঁড়ানোর আভাস দিয়েছিল। যদিও সেটি খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি নিম্নমুখী হতে শুরু করে পুঁজিবাজার, যার প্রভাব এখনো বিদ্যমান। পুঁজিবাজারের এ নিম্নমুখিতার কারণে ক্রমান্বয়ে কমছে জিডিপির অনুপাতে বাজার মূলধনের অনুপাতও।

দেশে নিবন্ধিত কোম্পানির সংখ্যা অনেক। কিন্তু পুঁজিবাজারে কোম্পানিগুলোর উপস্থিতি একেবারে কম। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী সরকারি কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। আশা করা যায়, তার নির্দেশনা অনুসারে এসব কোম্পানি পুঁজিবাজারে এলে বাজার মূলধন বাড়বে। 

২০১০ সালের ধসের পর পুঁজিবাজারের প্রতি মানুষের নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়, যা এখনো অনেকাংশে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। এজন্য বিনিয়োগকারীরা ফিরলে পুঁজিবাজারে গতি ফিরবে বলে আশা করা হচ্ছে। এজন্য দরকার প্রয়োজনীয় আইনগত সংস্কার ও উদ্যোগ। পরিশেষে পুঁজিবাজারে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও সুশাসন নিশ্চিত করে বাজার মূলধন বাড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে—এটিই প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন