ফায়ার সার্ভিসের তথ্য

দেশে পাহাড় ধসে প্রতি বছর গড়ে ২৬ প্রাণহানি

নিহাল হাসনাইন

পাহাড় ধসের দুর্ঘটনাগুলো চট্টগ্রামে বেশি ছবি: ফাইল/নিজস্ব আলোকচিত্রী

দেশে প্রতি বছর গড়ে পাহাড় ধসের মতো দুর্ঘটনা ঘটে ২১টি। এসব দুর্ঘটনায় গড়ে ২৬ জনের প্রাণহানি ঘটে। গুরুতর আহত হন গড়ে ৫১ জন। যেকোনো দুর্ঘটনায় দ্রুত সাড়া প্রদানকারী সংস্থা ফায়ার সার্ভিসের তথ্য বিশ্লেষণ করে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। পাহাড় ধসের জন্য মূলত টিলা কেটে বসতি তৈরিকে মূল কারণ হিসেবে মনে করে সংস্থাটি। তবে বিশেষজ্ঞরা জানান, এসব দুর্ঘটনা আর্থসামাজিক, পরিবেশগত ও রাজনৈতিক সমস্যারই প্রতিফলন।

ফায়ার সার্ভিসের হিসাব মতে, ২০২৩ সালে ৩৫টি পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় ১৫ জন। গুরুতর আহত হয় ২৩৪ জন। তার আগের বছর পাহাড় ধসের ১০টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় পাঁচজন। গুরুতর আহত হয় ১০ জন। ২০২১ সালে ১০টি পাহাড় ধ্বসের ঘটনায় মারা যায় ছয়জন। গুরুতর আহত হয় ৩৪ জন। ২০২০ সালে ১৩টি পাহাড় ধসের ঘটনায় মারা যায় ১৪ জন। গুরুতর আহত হয় ১৮ জন। তার আগের বছর ২০১৯ সালে ১৭টি পাহাড় ধসের ঘটনায় মারা যায় ১৩ জন। আহত হয় ২৮ জন। ২০১৮ সালে ২১টি পাহাড় ধসের ঘটনায় মারা যায় ৪৫ জন। গুরুতর আহত হয় ৩২ জন। ২০১৭ সালে ৫২টি পাহাড় ধসের ঘটনায় মারা যায় ৯১ জন। গুরুতর আহত হয় ৫২ জন। ২০১৬ সালে ১১টি পাহাড় ধসের ঘটনায় মারা যান সাতজন। আহত হয় ২০ জন। ২০১৫ সালে ২৩টি পাহাড় ধসের ঘটনায় প্রাণ হারায় ৩৯ জন। গুরুতর আহত হয় ৩১ জন।

ফায়ার সার্ভিসের গত নয় বছরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ সময়ের মধ্যে দেশে মোট পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে ১৯২টি। এসব দুর্ঘটনায় মারা গেছে ২৩৫ জন। গুরুতর আহত হয়েছে ৪৫৯ জন। হতাহতদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি। আর পাহাড় ধসের দুর্ঘটনাগুলো চট্টগ্রামে বেশি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পাহাড় ধসের মতো দুর্ঘটনা মূলত আর্থসামাজিক, পরিবেশগত ও রাজনৈতিক সমস্যারই প্রতিফলন। কারণ হিসেবে তারা জানান, সাধারণ মানুষ তীব্র আর্থিক সংকট থেকে নিজের একমাত্র মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে বেছে নিচ্ছেন পাহাড় কেটে তৈরি করা ঘরকে। বছরের পর বছর ধরে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটলেও এসব বাসিন্দারা অন্য কোথাও স্থানান্তর হতে চায় না। তার বড় কারণ হচ্ছে আর্থসামাজিক দুর্বলতা। এ ধরনের দুর্বলতার কারণে জীবনে ঝুঁকি নিয়েও মানুষ পাহাড়ে বসবাস করছে। ছিন্নমূল এসব মানুষের কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকায় তারা কম খরচে এমন ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় বসবাস করছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থানীয় ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে এ ঘরগুলো তৈরি করেন। পার্বত্য তিন জেলা, চট্টগ্রাম এমনকি শহরেও পাহাড় ঘেঁষে তৈরি করা অনেক বসতি রয়েছে ঝুঁকিতে।

সবচেয়ে বেশি পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে চট্টগ্রামে। পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির হিসেবে চট্টগ্রামে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় রয়েছে ২৫টি। এসব পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী লোকজনের সংখ্যা এক লাখের ওপরে। তাদের বেশির ভাগ নিম্ন আয়ের। এর মধ্যে ১৮টি পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের তালিকা করা হয়েছে। বাকি পাহাড়গুলোর তালিকা এখনো শেষ হয়নি। পাহাড় ধসের ঘটনায় নিহতদের প্রায় সবাই ছিল পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাসকারী হতদরিদ্র লোকজন।

পরিবেশবিদরা জানান, পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়াসহ ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরিয়ে নিতে প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগ না থাকায় পাহাড় ধসে মৃত্যু রোধ করা যাচ্ছে না। প্রশাসনের উদাসীনতা, রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের লেজুড়বৃত্তির কারণে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারী বাড়ছে। যে কারণে বছর বছর ঘটছে প্রাণহানি।

‌পাহাড় ধসের ঘটনাগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দুর্গম এলাকায় হয়ে থাকে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের মুখপাত্র মো. শাহজাহান শিকদার। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছতে বেশ সময় লেগে যায়। তাছাড়া উদ্ধার অভিযান চালানোর মতো পর্যাপ্ত সরঞ্জাম পাহাড়ি পথে বয়ে নিয়ে যেতে বেগ পেতে হয়। তবে এতসব প্রতিবন্ধকতার মাঝেও পাহাড় ধসের মতো দুর্ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস সর্বোচ্চ দ্রুততম সময়ের মধ্যে কাজ শুরু করে থাকে। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলার যথেষ্ট সক্ষমতা ফায়ার সার্ভিসের রয়েছে।’

পাহাড় ধসের ক্ষয়ক্ষতি ও মৃত্যু এড়াতে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থান পরিহার করার পরামর্শ দিয়েছেন মো. শাহজাহান শিকদার। তিনি জানান, ভারি বর্ষণে ধসের আশঙ্কা থাকায় পাহাড়ের ঢালে ও পাদদেশে বসবাসকারীদের আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে হবে।


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন