সিলেটাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি

বৃষ্টি কমলেও উজানের ঢলে বেড়েছে দুর্ভোগ

বণিক বার্তা ডেস্ক

সিলেট নগরীর অনেক বাসা-বাড়ি ও রাস্তাঘাট এখনো পানিতে নিমজ্জিত ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

বৃষ্টিপাত কমায় সিলেটের অনেক এলাকা থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। তবে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে কমছে না দুর্ভোগ। এখনো সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পাঁচটি পয়েন্টে পানি প্রবাহিত হচ্ছে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে। কেবল সারি গোয়াইন নদীর গোয়াইনঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার নিচে নেমেছে। তবে ভারতের মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জিতে তেমন ভারি বৃষ্টিপাত না হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হচ্ছে। অন্যদিকে উজানি ঢলের কারণে উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, দুধকুমার, ব্রহ্মপুত্র, ধরলাসহ ১৬টি নদ-নদীর পানি বেড়েই চলেছে। প্লাবিত হয়েছে অনেক নিম্নাঞ্চল। 

সিলেট জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, এখনো জেলার ১৩টি উপজেলাসহ সিলেট সিটি করপোরেশনের ২৩টি ওয়ার্ডের ৯ লাখ ৫৭ হাজার মানুষ পানিবন্দি। ৬৯৮টি আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছে ২১ হাজার ৭৮৬ বানভাসি। পুরো সিলেট বিভাগের ২৬ হাজার ৪০৪ হেক্টর আউশ ধান ও বীজতলা, সবজিখেত বন্যার পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। সিলেট জেলার ৪৬৭টি স্কুল ও মাদ্রাসায় পানি ঢুকে পড়েছে। এতে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বিদ্যালয়ের মেঝে ও আসবাব।

বন্যা পরিস্থিতির কারণে সিলেটে বিভিন্ন বিদ্যুৎ স্থাপনাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিদ্যুৎহীন অবস্থায় রয়েছে ১০-১২ হাজার গ্রাহক। গতকাল বিদ্যুৎ বিভাগের প্রকাশিত প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, সিলেটে বন্যায় প্রায় ১ কোটি ৬৭ লাখ ৫৩ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। এদিকে বিতরণ অঞ্চল, বাবিউবো, সিলেট অঞ্চলের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে। 

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, গতকাল বেলাল ৩টায় সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে ৭৮ সেন্টিমিটার, নদীর সিলেট পয়েন্টে ২৪, কুশিয়ারা নদীর আমলশীদ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৮৪, শেওলা পয়েন্টে ৩৩, ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে ১০২ ও শেরপুর পয়েন্টে ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। তবে সব পয়েন্টেই আগের দিনের তুলনায় কিছুটা পানি কমেছে।

পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, ‘ভারতের চেরাপুঞ্জির বৃষ্টির ওপর সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির বিষয়টি অনেকটা নির্ভর করছে। কারণ ভারতের পাহাড়ি ঢলেই এখানে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়। এ কারণে চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি কম হলে সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। বর্তমানে বৃষ্টির পরিমাণ কমে আসায় নদ-নদীগুলোয় পানির স্তর অল্প অল্প করে নামছে।’

এদিকে সিলেট নগরীর শাহজালাল উপশহর, ঘাসিটুলা, মাছিমপুর, ছড়ারপার, তালতলা, কুয়ারপার, মেন্দিবাগ, কামালগড়, চালিবন্দর, যতরপুর, সোবহানীঘাট, কালীঘাট, শেখঘাট, তালতলা ও জামতলার বাসাবাড়িতে এখনো হাঁটু সমান পানি। এসব এলাকার বাসিন্দারা জানান, রিজার্ভ ট্যাংকে নর্দমার পানি প্রবেশ করায় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। 

সিলেটের ডেপুটি সিভিল সার্জন জন্মেঞ্জয় দত্ত জানান, যে তিনটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পানি উঠেছিল সেগুলো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়েছে। সেবা কার্যক্রম চলছে আগের মতোই। তবে চত্বরে পানি রয়েছে এখনো। 

সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বলেন, ‘জেলার ১৫৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ১৩০টির ১ হাজার ৬০২ গ্রাম বন্যায় প্লাবিত। আর সিটি করপোরেশনের ২৩টি ওয়ার্ডে বন্যাকবলিত মানুষের সংখ্যা ৫৫ হাজার। বন্যাকবলিত এলাকায় এরই মধ্যে ২৮ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে এবং ৬০০ টন চাল দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে উদ্ধার তৎপরতা চালানো হচ্ছে। বরাদ্দ আরো বাড়বে।’ 

সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি: গতকাল সকাল থেকে সুনামগঞ্জে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় শহরের বাসাবাড়ি থেকে নামতে শুরু করেছে ঢলের পানি। তবে এখনো প্লাবিত রয়েছে শহরের কাজিরপয়েন্ট, উকিলপাড়া, ষোলঘর, নবীনগর, নতুনপাড়া, মধ্যবাজার, সাহেববাড়িঘাটসহ অধিকাংশ আবাসিক এলাকা। ডুবে আছে জেলা সদর, দোয়ারাবাজার, ছাতক, বিশ্বম্ভরপুরসহ অধিকাংশ উপজেলার রাস্তাঘাট, ফসলের মাঠ। জেলা সদরের সঙ্গে ওইসব উপজেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। পানিবন্দি হয়ে আছে জেলার প্রায় ১৫ লাখ মানুষ। 

সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, ‘সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। আগের তুলনায় অনেক পানি কমেছে। ভারতের চেরাপুঞ্জি ও মেঘালয়ে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় পানি কমছে। আমরা আশাবাদী শিগগিরই বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে।’

ঢলের পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু: মৌলভীবাজারে ঢলের পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল দুপুরে সদর উপজেলায় চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের শ্যামেরকোনা গ্রামে মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মৃত শিশুরা হলো শ্যামেরকোনা গ্রামের জমির আলীর ছেলে হৃদয় আহমদ এবং একই গ্রামের ফয়সল মিয়ার ছেলে সাদী আহমদ।

স্থানীয়রা জানান, গত কযেক দিনের বৃষ্টি ও ধলাই নদীর পানিতে পুরো শ্যামেরকোনা গ্রামের বাড়িঘরের আশপাশ, রাস্তাঘাট ও ফসলের মাঠ পানিতে তলিয়ে যায়। গতকাল দুপুরে সাদী বাড়ির পাশে ঢলের পানি দেখতে গিয়ে এক পর্যায়ে তাতে পড়ে যায়। পরে পাশের বাড়ির হৃদয় তাকে উদ্বার করতে এসে সেও পানি ডুবে যায়। মৌলভীবাজার সদর থানার ওসি নজরুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। 

ধরলা-তিস্তার পানি বিপৎসীমার ওপরে: কুড়িগ্রামে তিস্তা, দুধকুমার, ব্রহ্মপুত্র, ধরলাসহ ১৬ নদ-নদীর পানি বেড়েই চলছে। ধরলা নদীর পানি বিপৎসীমার ২৬ সেন্টিমিটার ও তিস্তার পানি বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও এখনো বিপৎসীমা অতিক্রম করেনি। এদিকে পানি বাড়ার কারণে নদ-নদীর অববাহিকার নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলের শত শত পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ভেঙে পড়েছে এসব এলাকার গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা। তলিয়ে গেছে বিভিন্ন কাঁচা সড়ক। ডুবে গেছে সবজিখেতসহ বিভিন্ন উঠতি ফসল।

কুড়িগ্রাম পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিবুল হাসান বলেন, ‘আরো দুই-তিনদিন নদ-নদীগুলোর পানি বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে যেসব এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে সেখানে ভাঙনরোধে আমাদের কাজ চলছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন