সিলেট অঞ্চলে পানিবন্দি ১৫ লাখ মানুষ

বন্যাদুর্গতদের জরুরি সেবা ও ত্রাণসহায়তা নিশ্চিত করতে হবে

ছবি : বণিক বার্তা

টানা পাঁচদিনের অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সিলেট ও সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা ডুবে যাওয়ায় এবং মৌলভীবাজারে প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় ১৫ লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ৩০ হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছে। সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির যে অবনতি দেখা গেল, তাকে প্রকৃতির এক সতর্কবার্তা বলাই শ্রেয়। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০০৪ ও ২০২২ সালের বন্যায় সিলেট নগরের অনেক এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। এরপর প্রতি বর্ষায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলেও এবারের মতো সুরমা নদীর উপচে পড়া পানিতে সিলেট নগরী বন্যাকবলিত হয়নি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজারসহ অনেক সরকারি কার্যালয়েও বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। বন্যার পানিতে শত শত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়ির জিনিসপত্র নষ্ট হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সিলেট, সুনামগঞ্জের মানুষের চরম জনদুর্ভোগ সহজেই অনুমেয়। মানুষ বন্যার পানিতে আটকা পড়েছে অথবা আশ্রয় কেন্দ্রগুলোয় ঠাঁই নিচ্ছে। খাদ্য ও অন্যান্য মৌলিক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অভাব তৈরি হয়েছে। এলাকার সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আশ্রয় কেন্দ্রে রূপান্তর করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে মানুষ অবর্ণনীয় কষ্টে আছে। এখন যা দরকার, তা হলো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ, যাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে অবিলম্বে সাহায্য পৌঁছানো যায়। ত্রাণ ও চিকিৎসা দলগুলোর জন্য পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোয় পাঠানো প্রয়োজন। বন্যা মোকাবেলায় সরকারের দীর্ঘমেয়াদে টেকসই প্রস্তুতি ও ব্যবস্থা নেয়া উচিত। এছাড়া উজানি ঢলে তিস্তার পানি বেড়ে প্লাবিত হয়েছে উত্তরাঞ্চলের নিম্নাঞ্চল। ভারি বর্ষণে প্লাবিত হয়েছে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার অন্তত ৫০টি গ্রাম। উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি অঞ্চলে বন্যা দেখা দিয়েছে।

অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টে দিনাতিপাত করছে সুনামগঞ্জ ও সিলেটের মানুষ। বানভাসিদের পান করার বিশুদ্ধ পানি নেই; ঘরে শুকনো খাবার নেই; প্রয়োজনীয় ওষুধ নেই; মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। বাঁচার আশায় আশ্রয় নিয়েছে উঁচু জায়গায়, বাসার ছাদে একটুখানি আশ্রয় কেন্দ্রে। হাজার হাজার অসহায় মানুষ হাত বাড়িয়ে আছে ত্রাণের জন্য। এসব এলাকায় প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। যারা আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে, বাড়িতে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত। এ মুহূর্তে চ্যালেঞ্জ হলো ত্রাণ ও ওষুধ সরবরাহ এবং বন্যাকবলিত এলাকায় জীবনযাত্রা স্বাভাবিক করা। বন্যায় সিলেট শহরসহ প্রতিটি উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া অনেক দোকান ও গুদাম পানির নিচে চলে যাওয়ায় সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সেখানে শিগগিরই খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। আরো একদিন যেহেতু বৃষ্টি হওয়ার পূর্বাভাস রয়েছে, সেজন্য পরিস্থিতি বিপজ্জনক মোড় নিতে পারে। সেক্ষেত্রে সরকারের প্রস্তুতিও হতে হবে জোরালো। প্রয়োজনে প্রশাসনের পাশাপাশি সব ধরনের নিরাপত্তা বাহিনীকে উদ্ধারকাজে পুরোপুরি সম্পৃক্ত করতে হবে। এ মুহূর্তে প্রধান করণীয় হলো বিপন্ন মানুষকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া। যেখানে সড়ক ও নৌ-যোগাযোগ বন্ধ আছে সেখানে হেলিকপ্টারে করে মানুষকে উদ্ধার করতে হবে। 

এরপর প্রত্যেকের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে হবে। বিশেষ করে যাদের ঘরবাড়ি ও কৃষি, মৎস্য খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার ঘর মেরামত করতে হবে তাকে আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। যার কৃষি উপকরণ দরকার তাকে উপকরণের ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতির সুযোগ নেই। আশা করি, স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা সমন্বিতভাবে কাজটি করবেন।

দেশে বন্যার প্রকৃতি ও ক্ষয়ক্ষতি মূলত তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। প্রথমত, উজান থেকে কী পরিমাণে পানি আসছে। দ্বিতীয়ত, কত দ্রুত বা ধীরগতিতে পানি আসছে আর কতদিন ধরে সেই পানি বাংলাদেশে থাকছে। তৃতীয়ত, দেশের নদী-নালা-খাল-বিলে পানির ধারণক্ষমতা। উজানের ভারতীয় অঞ্চলে এবং দেশের ভেতরের প্রাকৃতিক স্বাভাবিকতা বিনষ্ট হওয়ায় সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এ তিন ক্ষেত্রেই জটিলতা বেড়েছে এবং ক্ষয়ক্ষতি বেশি হচ্ছে। বিশেষত উজান থেকে আসা পলির পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে বর্ষা মৌসুমে নদীর তলদেশের গভীরতা ও নদীর পাড় ভাঙা বাড়ছে। আবার শুকনো মৌসুমে নদীগুলোর পানি পরিবহনক্ষমতা কমে যাওয়ার ফলে এ পলি নদীর তলদেশে জমা হয়ে নদী ভরাট করে ফেলছে। আবার দেশের ভেতরের নদ-নদীর নাব্য কমে যাওয়া, চ্যানেলগুলো বন্ধ হওয়ার কারণেও দিন দিন বন্যা বাড়ছে। এসব সংকটের সমাধান করতে না পারলে বন্যার দুর্ভোগ থেকে মুক্তি মিলবে না। বন্যা মোকাবেলায় সব কর্তৃপক্ষকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘন ঘন বন্যা আরো তীব্র আকার ধারণ করছে। এটি একটি আপৎকালীন অবস্থা, যা প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট উভয় কারণেই আরো খারাপ হয়েছে। পুকুর, খাল ও হাওর, যেগুলো একসময় এ অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত ছিল এবং বন্যার সময় অতিরিক্ত পানির জলাধার হিসেবে কাজ করত, গত কয়েক দশকে সেগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অবিবেচনাপ্রসূত উন্নয়ন, নগরায়ণ এবং ত্রুটিপূর্ণ সরকারি নীতির কারণে এমনটা হয়েছে। ওই এলাকায় অনেক নদ-নদীও দখল করা হয়েছে। এতে গ্রীষ্মকালে এগুলো শুকিয়ে যায় এবং স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি বৃষ্টি হলেই উপচে পড়ে। সিলেটের প্রধান নদীগুলোকে দখল ও দূষণের হাত থেকে রক্ষা করে দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই পরিকল্পনা নিতে হবে। বছর বছর নদী খননের জন্য অর্থ বরাদ্দ হলেও সে অনুপাতে কাজ হয় না। বৃহত্তর সিলেটের মানুষকে বন্যার হাত থেকে বাঁচাতে হলে লোক দেখানো নদী খননের কাজ বন্ধ করতে হবে। টেকসই ও পরিকল্পিত উপায়ে নদী খননে পদক্ষেপ নিতে হবে।    

বর্তমানে উদ্ধার কর্মসূচির পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রীও দ্রুত পৌঁছাতে হবে বন্যা উপদ্রুত এলাকায়। যেসব স্থানে রান্নার সুযোগ থাকবে না, সেসব স্থানে শুকনা খাবার সরবরাহ করতে হবে। ত্রাণ কেন্দ্রগুলোয় যাতে রোগ ছড়িয়ে না পড়ে, সে বিষয়েও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নজর দিতে হবে। দুর্গত এলাকায় খাদ্য ও ওষুধ পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বাগ্রে সবাইকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসতে হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট সব বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানকে একযোগে কাজ করতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদেরও। দেশে বহু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আছে, তাদেরও এ ত্রাণ ও উদ্ধারকাজে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। সরকারিভাবে অনেক এলাকায় ত্রাণসহায়তা দেয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে এসব মানুষের কাছে অতিদ্রুত ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিতে হবে। বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র এবং নিয়মিত বিশুদ্ধ পানি, খাবার ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। শিশু ও বৃদ্ধদের নিরাপদ স্থানে রাখতে হবে। গৃহপালিত পশু-পাখি নিরাপদে সরিয়ে আনতে হবে। তবে এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও দেশের সামর্থ্যবানদের বন্যাদুর্গত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে।

যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকট। ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগের লক্ষণ এখনো দেখা না গেলেও অচিরেই আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নদ-নদীর পানি উপচে বন্যার সৃষ্টি করতে পারে—এমন পরিস্থিতি আমাদের জন্য দুর্ভাবনার। সামনে ভয়াবহ বন্যার যে আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা আমলে নিয়েই সরকারের এখন থেকে পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যবস্থা নেয়া উচিত। বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এড়ানো আমাদের আয়ত্তের বাইরে। তবে যথাযথ প্রস্তুতি নিলে মানুষের দুর্ভোগ, ক্ষয়ক্ষতি নিশ্চয়ই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। বন্যার্তদের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্যসহায়তার সংস্থানে সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। বন্যার মৌসুম কেবল শুরু হলো। সামনের দিনগুলোয় বন্যার প্রকোপ আরো বাড়তে পারে, সেজন্য সরকারের আগাম ও টেকসই প্রস্তুতি থাকা জরুরি বলে মনে করি। বিশুদ্ধ পানি, ওষুধপত্র ও চিকিৎসাসেবাও প্রস্তুত রাখা দরকার। সরকার ও প্রশাসন এ বিষয়ে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবে—এটাই প্রত্যাশা করি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন