আলোকপাত

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য তরুণ জনগোষ্ঠীর কেমন প্রস্তুতি থাকা চাই

ড. মোহাম্মদ আসিফ হোসেন খান

ছবি : বণিক বার্তা

প্রযুক্তি সদা পরিবর্তনশীল। বিগত ২০ বছরে প্রযুক্তি যেভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, ভাবতে পারেন ২০ বছর পর তা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? এই পরিবর্তন আমাদের জীবন এবং জীবিকা দুটোতেই প্রভাব ফেলে চলেছে। পরিবর্তনের এই নতুন যুগের নামই চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, যা প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। মেশিন লার্নিং, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, অগমেন্টেড রিয়ালিটি, ভার্চুয়াল রিয়ালিটি, থ্রিডি প্রিন্টিং, রোবোটিকস ও আইওটি ইত্যাদি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই প্রযুক্তিগুলোকে যুগান্তকারী প্রযুক্তিও বলা হয়; কেননা এরা সমাজের বিদ্যমান চাহিদা পূরণ করার প্রচলিত প্রথাকে পাল্টে দিচ্ছে। ফলে চাকরির বাজারে এরা যোগ করছে নতুন মাত্রা। অনেক কাজ এবং দক্ষতাকে প্রতিস্থাপন করছে প্রযুক্তি দিয়ে। ফলে চাকরি হারাচ্ছে মানুষ। 

সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ প্রমাণ করে চলেছে যেকোনো পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সে অতুলনীয়। এবারো মানুষ এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবে তাতে সন্দেহ নেই। তবে কথা হচ্ছে কত ভালোভাবে খাপ খাওয়াবে আর এই খাপ খাইয়ে নিতে কত সময়ই বা লাগবে। প্রযুক্তির এই চ্যালেঞ্জের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শুধু টিকে থাকাই নয়, বরং উৎকর্ষ সাধনে কী ধরনের দক্ষতা অর্জন করতে হবে মানুষকে? 

McKinsey Global Institute-এর গবেষণা অনুযায়ী ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের প্রায় ৪০ কোটি থেকে ৮০ কোটি মানুষ অটোমেশনের কারণে তাদের চাকরি হারাবে যার মধ্যে ৫০ লাখের বেশি থাকবে বাংলাদেশী। একটা মজার বিষয় খেয়াল করেছেন? বিশ্বের সবচেয়ে বড় ট্যাক্সি কোম্পানি উবারের কোনো গাড়ি নেই, বিশ্বের সবচেয়ে বড় মিডিয়া কোম্পানি ফেসবুক কোনো কনটেন্ট তৈরি করে না, আলিবাবার কোনো ওয়্যারহাউজ নেই, আর বিশ্বের সবচেয়ে বড় হোটেল সার্ভিস প্রোভাইডার এয়ারবিএনবির কোনো হোটেল বা অ্যাপার্টমেন্ট নেই। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে তাল মিলাতে গিয়ে বিশ্বের বহু প্রতিষ্ঠান তাদের বিজনেস মডেলে পরিবর্তন এনেছে এবং আনছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০২০ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে শিল্প বিপ্লবের কারণে যেমন প্রায় সাড়ে আট কোটি লোক চাকরি হারাবে, তেমনি বিজনেস মডেলের এই পরিবর্তনের কারণে নতুন প্রায় ১০ কোটি চাকরির সুযোগ তৈরি হবে; অর্থাৎ দেড় কোটি নতুন মানুষের কর্মসংস্থান ঘটবে। প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের যুব সমাজ কি এই সুযোগ কাজে লাগাতে প্রস্তুত? 

এই প্রস্তুতির প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো শেখার মানসিকতা তৈরি করা। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা শেষ হয়ে গেলে জীবনে আর পড়ালেখা করতে হবে না—এমন ধারণা পোষণকারীদের জন্য চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে কোনো স্থান নেই। এ যুগে টিকে থাকতে হলে যতদিন কর্মক্ষম থাকবেন ততদিনই নতুন নতুন জ্ঞান ও নতুন নতুন দক্ষতা অর্জন করতে হবে। ফলে নতুন কিছু শেখার মানসিকতা গড়ে তোলা খুবই জরুরি। 

বাংলাদেশের শ্রমবাজারে দক্ষতার অভাব খুবই প্রকট। এর জন্য আমাদের শিক্ষা পদ্ধতিকে দোষ দেয়া যেতেই পারে। ২০২১ সালে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক জরিপের তথ্যানুযায়ী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ৬৬ শতাংশ গ্র্যাজুয়েটই বেকার। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের শিক্ষার্থীদের মাঝে গবেষণা ও উদ্ভাবনকে আরো বেশি উৎসাহিত করতে হবে। মেশিন লার্নিং, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, অগমেন্টেড রিয়ালিটি, ভার্চুয়াল রিয়ালিটি, থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের মতো চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে সম্পৃক্ত টেকনোলজিগুলোকে টুলস হিসেবে কীভাবে ব্যবহার করা যায়, শিক্ষার্থীদের সেই শিক্ষা প্রদান করতে হবে। চ্যাটজিপিটির কথাই ধরা যাক। এটি বেশকিছু নতুন নতুন চাকরির সুযোগ বয়ে এনেছে। যেমন—কাস্টমার সার্ভিস অটোমেশনে চ্যাটজিপিটি-ভিত্তিক চ্যাটবটের চাহিদা বেড়েই চলেছে। এই বটগুলোকে একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের জন্য কনফিগার করা, ডেপ্লয় করা এবং রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য জনবল প্রয়োজন। চ্যাটজিপিটি—যেমন শুধু টেক্সট তৈরি করতে পারে, এমন অনেক আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স (এআই) টুলস রয়েছে যারা অডিও এমনকি ভিডিও তৈরি করতে পারে। এ ধরনের অডিও ভিজুয়াল কনটেন্টের চাহিদাও দিন দিন বাড়ছে। ফলে ওই টুলসগুলো ব্যবহার করে কনটেন্ট তৈরি করতে পারে এমন জনবলের চাহিদাও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত এক সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের অনলাইন শ্রমবাজারে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। এখানে ১৬ শতাংশ কর্মীই বাংলাদেশী। এ বছর ফেব্রুয়ারিতে ডেইলি স্টারে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১০ লাখ ফ্রিল্যান্সার কর্মরত। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের তথ্যানুসারে, ফ্রিল্যান্সাররা দেশের অর্থনীতিতে বছরে ১ বিলিয়ন ডলারের অবদান রাখছে। এরা বর্তমানে যে কাজগুলো করছে তার মধ্যে অনেকগুলোই ভবিষ্যতে কোনো কম্পিউটার প্রোগ্রাম করে দেবে। ফলে এরা বাজার হারাবে। কিন্তু এরাই যদি এআই টুলসের ব্যবহারে নিজেদের দক্ষ করে তুলতে পারে, তাহলে নানা ধরনের কনটেন্ট ক্রিয়েশনের কাজের অভাব হবে না। অর্থাৎ টিকে থাকতে হলে নতুন নতুন দক্ষতা অর্জন করে যেতে হবে।  

আমরা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের স্বর্ণযুগ পার করছি। গত বছর বিআইডিএসের এক জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ১১ কোটি মানুষ কর্মক্ষম গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত; অর্থাৎ এদের বয়স ১৫-৬৪ বছরের মধ্যে। এটি খুব ভালো খবর। কিন্তু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রায় পৌনে চার কোটি মানুষ নিষ্ক্রিয় জনসংখ্যার (এনইইটি) ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ এরা কোনো শিক্ষা, উপার্জন বা প্রশিক্ষণমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত নয়। আশঙ্কার বিষয়, এদের মধ্যে প্রায় সোয়া এক কোটি মানুষের বয়স ১৫-২৯ বছরের মধ্যে। তাহলে আমরা কি ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে কাজে লাগাতে পারছি? এ অবস্থা চলতে থাকলে অদূরভবিষ্যতে আমাদের প্রযুক্তি আমদানি করার সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেয়ার জন্য জনশক্তিও আমদানি করতে হবে। 

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশে যেখানে বিদেশী কর্মীর সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৭, সেখানে ২০২১-২২ অর্থবছরে তা দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ১২৮ জনে। গ্লোবাল নলেজ পার্টনারশিপ অন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (কেএনওএমএডি) তথ্যানুসারে, ২০১৮ সালে বিদেশী কর্মীরা বাংলাদেশ থেকে ৫৭ মিলিয়ন ডলার বৈধ চ্যানেলে বিদেশে পাঠিয়েছে। আর ২০২২ সালে পাঠিয়েছে ১৩৭ মিলিয়ন ডলার। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) তথ্য অনুসারে, বৈধ-অবৈধ চ্যানেল মিলিয়ে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বিদেশী কর্মীরা ৩-৪ বিলিয়ন ডলার নিয়ে যায়। ভাবতে পারেন? অথচ আমরা বলি দেশে চাকরি নাই! 

যদিও এ অবস্থার পরিবর্তনে সরকার অনেক উদ্যোগ নিয়েছে। অটোমেশন ও ডিজিটালাইজেশনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে ডিজিটাল বাংলাদেশ। তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রযুক্তিভিত্তিক সেবা পৌঁছে দিতে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশন-২০৪১’ বাস্তবায়নে কাজ করছে সরকার। ভিশন-৪১-এর মূল চারটি ভিত্তি হচ্ছে স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি। এক্ষেত্রে নাগরিকদের প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ করে গড়ে তুলতে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। 

২০১১ সালে সরকার জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করে। এই নীতিমালার আলোকে অর্থ মন্ত্রণালয় ২০১৭ সালে ‘জাতীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন ফান্ড’ গঠন করেছে। বাজারমুখী দক্ষতা অর্জনের মধ্য দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির উদ্দেশে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত ট্রেনিং প্রোগ্রামগুলোকে এই ফান্ড থেকে সহায়তা প্রদান করা হয়। বাংলাদেশের কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কারিকুলাম এই নীতিমালার আলোকে পরিচালিত হয়। জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতিমালা-২০২০-এর যে ড্রাফট প্রকাশিত হয়েছে সেখানে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবভিত্তিক প্রযুক্তিগুলোর ওপর দক্ষতা বৃদ্ধিতে জোর দেয়া হয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের চাহিদার ভিত্তিতে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির লক্ষ্যে ২০১৯ সালে সরকার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (এনএসডিএ) গঠন করে।

শ্রমবাজারে উৎপাদনশীলতা এবং উন্নত কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে কারিগরি ও পেশামূলক শিক্ষা ব্যবস্থা (টিভিইটি) প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষা কার্যক্রমকে আধুনিকায়নে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) অর্থায়নে স্কিল-২১ প্রকল্প কাজ করে চলেছে। 

আইসিটি, গার্মেন্টস, টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, নির্মাণকাজ, জাহাজ নির্মাণ, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ, পর্যটন, নার্সিং, গাড়ি চালনা ও স্বাস্থ্য প্রযুক্তির মতো কিছু অগ্রাধিকারভিত্তিক খাত রয়েছে। এ খাতের জনবলকে স্কিলিং এবং রি-স্কিলিং করার মাধ্যমে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ঘটানোর লক্ষ্যে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) ২০১৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ফলে স্কিল ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (এসইআইপি) প্রকল্পের উদ্ভব হয়। 

বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের শিল্প কারখানাগুলোর তৈরি দ্রব্যের চাহিদা ধরে রাখতে ও শিল্প কারখানাগুলোকে উদ্ভাবনী করার লক্ষ্যে এনএসডিএ এবং শিল্প কারখানাগুলোর মধ্যে একটি যোগসূত্র তৈরি প্রয়োজন। এ যোগসূত্র স্থাপনে ইন্ডাস্ট্রি স্কিল কাউন্সিল (আইএসসি) গঠনে এসইআইপি কাজ করে যাচ্ছে। 

১৫-২৯ বছর বয়সী বাংলাদেশের ৯০ লাখ এনইইটি জনগোষ্ঠীকে সমাজ ও অর্থনীতির মূল ধারায় অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে ২০২৩ সালে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে ইকনোমিক অ্যাকসিলারেশন অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স ফর এনইইটি (ইএরআরএন) প্রকল্প কাজ শুরু করেছে। এ প্রকল্পের আওতায় গ্রাম পর্যায়ে ১৬ হাজার থেকে ১৮ হাজার ট্রেনিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হবে। এই প্রকল্পের আওতায় ট্রেনিংপ্রাপ্তদের মধ্যে ৭০ শতাংশই হবে নারী। তরুণ সমাজের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ যে অসাধারণ কাজ করে চলেছে তার স্বীকৃতিস্বরূপ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালে ইউনিসেফের চ্যাম্পিয়ন অব স্কিল ডেভেলপমেন্ট ফর ইয়ুথ পুরস্কার পেয়েছেন। সরকার চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবেলায় কাজ করছে। কিন্তু আমরা নিজেদের জন্য কী করছি? 

কার কী করণীয়—

ব্যক্তি পর্যায়ে

প্রথমেই বলেছি, শেখার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা থাকতে হবে। দক্ষতা বাড়ানোর জন্য এআই-টুলসের সহায়তা নিতে হবে। শিক্ষার্থীরা গ্রেডস্কোপ, নুয়েন্স ড্রাগন স্পিচ রিকগনিশন, আইভি চ্যাটবট, কগনি, কার্নেগি লার্নিং প্লাটফর্ম, সেঞ্চুরি টেকের মতো এআই টুলস ব্যবহার করতে পারেন। ভাষাশিক্ষার জন্য ব্যবহার করতে পারেন নৌজি, লেখার দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্লাটিও ব্যবহার করতে পারেন। সায়েন্স, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ম্যাথ শেখার জন্য কুয়েরিয়াম একটি ভালো এআই টুল। তাছাড়া কোর্সেরা, ইউডেমি, খান একাডেমি, টেন মিনিট স্কুলের মতো সাইটগুলো থেকেও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রযুক্তিবিষয়ক কোর্স করতে পারেন অনায়াসে। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলামের বাইরেও অনেক কোর্স করতে হবে নিজ উদ্যোগে। আপনি যদি বিজ্ঞানের ছাত্র নাও হন, তাতেও কিছু আসে যায় না। আপনার ফিল্ডে এআই, মেশিন লার্নিং, আইওটি, এআর, ভিআর কীভাবে ব্যবহার করা যায় তা গুগল, ইউটিউবে খুঁজে দেখুন। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র না হয়েও আপনি যেমন ক্যালকুলেটর ব্যবহার করেন, এই টেকনোলজিগুলোকেও টুলস হিসেবে দেখতে শিখুন; দেখবেন ভয় কেটে যাবে।  

সরকারি পর্যায়ে

সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের বিষয়ে আলোচনা করেছি। কিন্তু যেখানে আরো ফোকাস করতে হবে তা হলো গবেষণায় অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জিডিপির মাত্র দশমিক ৩ শতাংশ গবেষণা খাতে ব্যয় হয়, যা দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষেত্রে ৪ দশমিক ৯৩ শতাংশ (২০২১), জাপানের ক্ষেত্রে ৩ দশমিক ৩ (২০২১), জার্মানির ক্ষেত্রে ৩ দশমিক ১৪ (২০২১), চীনের ক্ষেত্রে ২ দশমিক ৪৩ (২০২১), এমনকি ভারতের ক্ষেত্রে দশমিক ৬৫ শতাংশ (২০২০)। এই খাতে বরাদ্দ না বাড়ালে উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ ঘটবে না। 

সমন্বিত কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা-প্রশিক্ষণ (টিভিইটি) শক্তিশালী ও জনপ্রিয় করতে হবে। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রির যোগাযোগ বাড়াতে হবে। তাদের কারিকুলাম হতে হবে সবুজ অর্থনীতি, সুনীল অর্থনীতি এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তিগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বাংলাদেশের সমাজে টিভিইটিকে শিক্ষাকে জনপ্রিয় করে তোলাটা দেশের অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আগেই বলেছি, এক জরিপে দেখা গেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ৬৬ শতাংশ শিক্ষার্থীই বেকার। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা কয়জন শিক্ষার্থী তার পঠিত বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ চাকরিতে ঢুকতে পারে তা আমাদের আশপাশে তাকালেই বোঝা যায়। অথচ আমাদের দেশ থেকে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত নার্স, ড্রাইভার, প্লাম্বার, ইলেকট্রিশিয়ান, কম্পিউটার টেকনিশিয়ান নেয়ার জন্য অনেক দেশ মুখিয়ে আছে, আমরা চাহিদা পূরণ করতে পারি না। 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যায়ে

প্রথমেই কারিকুলামকে যুগোপযোগী করতে হবে। প্রতিটি প্রোগ্রামকে অ্যাক্রেডিটেশনের আওতায় আনতে হবে। আউটকাম বেজড এডুকেশন (ওবিই) নিশ্চিত করতে হবে। বিদেশী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও দেশীয় ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। মিড লেভেল ম্যানেজমেন্টের ট্রেনিং প্রোগ্রাম, ডিপ্লোমা প্রোগ্রাম চালু করতে হবে। সর্বোপরি শিক্ষার্থীদের প্রজেক্ট, ইন্টার্নশিপ, প্রেজেন্টেশন, ইনোভেশন, কেস-স্টাডিতে উৎসাহিত করা প্রয়োজন; মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এসব ক্ষেত্রে থিওরির চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। সায়েন্স, আর্টস, কমার্স যেই ধারার পড়ালেখাই হোক না কেন, সেটা পড়া এবং পড়ানো দুই ক্ষেত্রেই টেকনোলজির সন্নিবেশ ঘটাতে হবে। বিশেষ করে এআইভিত্তিক টিচিং-লার্নিং-ইভাল্যুয়েশন টুলসের ব্যবহার বাড়াতে হবে। শিক্ষাকে করতে হবে ইন্টারডিসিপ্লিনারি। 

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে তরুণদের সে দক্ষতাগুলো অর্জন করতে হবে

সফট স্কিল

শেখার মানসিকতা; নিজের দক্ষতা বাড়ানো; নিজের উৎকর্ষ সাধনে সচেষ্ট থাকা; অভিযোজন ক্ষমতা বাড়ানো

সামাজিক স্কিল

দলবদ্ধ হয়ে কাজ করার দক্ষতা; কমিউনিকেশন; নেতৃত্বদানের দক্ষতা; নতুন নতুন ভাষা শেখা 

পদ্ধতিগত স্কিল

উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল চিন্তাভাবনা; ক্রিটিক্যাল থিংকিং; বিশ্লেষণাত্মক স্কিল; দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার দক্ষতা; সমস্যা সমাধানের দক্ষতা; সময়ের সঠিক ব্যবহার এবং সময়ানুবর্তিতা; পরিকল্পনা এবং সংগঠিত করার দক্ষতা

হার্ড স্কিল

ডাটা অ্যানালাইসিস করার দক্ষতা; সাইবার সিকিউরিটিসংক্রান্ত দক্ষতা; এআইটুলস ব্যবহারের দক্ষতা; গণিত ও পরিসংখ্যানে দক্ষতা

পরিশেষে বলতে চাই, এই স্কিলসেটই শেষ নয়; চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আরো নতুন নতুন দক্ষতার দাবি নিয়ে আসবে, কিন্তু ওপরের দক্ষতাগুলো অর্জন করতে পারলে নতুন দক্ষতা আয়ত্ত করা সহজতর হবে। এআই, রোবোটিকসের যুগে মানুষের কাজের সুযোগ কমে যাবে—এ ধারণাটা ভুল; বরং বেড়ে যাবে। তবে কমে যেতে পারে নতুনভাবে সৃষ্ট কাজগুলোকে করার উপযোগী দক্ষ মানবসম্পদ না থাকলে। সেটা ঠেকাতে হলে সরকারি, বেসরকারি খাত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। আর নিজের দক্ষতা বাড়াতে সচেষ্ট হতে হবে তরুণ নেতৃত্বকে। 

ড. মোহাম্মদ আসিফ হোসেন খান: অধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ও পরিচালক, আইসিটি সেল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন