![](https://bonikbarta.net/uploads/news_image/news_384930_1.jpg?t=1718895055)
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে ভারতের কলকাতায় হত্যা করা হলেও তার পরিকল্পনা হয় ঢাকায় বসে। সে অনুযায়ী দীর্ঘ দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে তাকে অনুসরণ করে অপরাধীরা। পরবর্তী সময়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয় কলকাতার নিউ টাউনের একটি ফ্ল্যাটে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার তিনজনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে এমপি আজীম হত্যার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরতে গিয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান।
এদিকে এমপি আনোয়ারুল আজীমের খুনিদের সম্পর্কে তথ্য বিনিময় করতে এরই মধ্যে ঢাকায় এসেছে ভারতীয় গোয়েন্দাদের তিন সদস্যের একটি দল। তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাত্র ৩০ মিনিটের কিলিং মিশনে অংশ নেয় দুই দেশের চার অপরাধী। এমপি আজীমকে হত্যার পর দেহ খণ্ড-বিখণ্ড করে তাতে হলুদ মিশিয়ে ব্যাগে ভরে গুম করা হয়। এ অবস্থায় তার মরদেহ উদ্ধারের সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে মনে করা হচ্ছে।
হত্যাকাণ্ডের পর ভারতীয় পুলিশের দেয়া তথ্যে বাংলাদেশ থেকে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। তারা হলো আমান উল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ভূঁইয়া, শিলাস্তি রহমান ও ফয়সাল আলী ওরফে সাজি। আজীমের মেয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় যে মামলা করেছেন, তাতে গ্রেফতার দেখিয়ে ওই তিনজনকে আজ আদালতে সোপর্দ করে রিমান্ড চাওয়া হবে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানান, ঢাকার গুলশান ও বসুন্ধরায় বসে একাধিকবার আলোচনা করেছে হত্যাকারীরা। এমপি আনোয়ারুল আজীমকে প্রথমে তারা বাংলাদেশে হত্যা করতে চেয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারা দেশের বাইরে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। তারই অংশ হিসেবে গত ২৫ এপ্রিল কলকাতায় বাসা ভাড়া নেয়া হয়। নিহত সংসদ সদস্যের বন্ধু আক্তারুজ্জামান শাহীন, তার বান্ধবী ও পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা আমান উল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ভূঁইয়া গত ৩০ এপ্রিল ঢাকা থেকে উড়োজাহাজে করে কলকাতায় গিয়ে সেই বাসায় ওঠে। মূলত পরিবার নিয়ে থাকার তথ্য দিয়ে বাড়ির মালিকের সঙ্গে চুক্তি করে তারা।
হত্যার আগে এমপি আজীম খুনিদের নজরদারিতে ছিলেন—এমন তথ্য দিয়ে হারুন অর রশীদ জানান, হত্যাকারীরা দুই মাস ধরে সংসদ সদস্যকে নজরদারিতে রেখেছিল। কখন তিনি কলকাতায় যান তারও খবর রাখছিল। কেননা ওই সংসদ সদস্য বিভিন্ন সময়ে কলকাতায় যেতেন। সেখানে তিনি দীর্ঘদিন বাস করেছেন, বন্ধুবান্ধবও রয়েছে। অপরাধীরা এ সুযোগই কাজে লাগিয়েছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান বলেন, ‘অপরাধীরা জানত ১২ মে সংসদ সদস্য কলকাতায় যাবেন। তাই তারা ৩০ এপ্রিল কলকাতায় গিয়ে স্থানীয় দুজনকে ঠিক করে। তারা হলো জিহাদ ওরফে জাহিদ ও সিয়াম। সংসদ সদস্যকে হত্যার পর কোন গাড়ি ব্যবহার হবে, কাকে কত টাকা দিতে হবে—সেগুলো ঠিক করে পরিকল্পনাকারী শাহীন ১০ মে বাংলাদেশে ফিরে আসে। এর মধ্যে এমপি আনোয়ারুল আজীম কলকাতায় গিয়ে তার বন্ধু গোপালের বাসায় ওঠেন। পরে ১৩ মে ওই বাসায় যান। যাওয়ার পথে একটি সাদা গাড়িতে করে ফয়সাল নামের এক ব্যক্তি তাকে নিয়ে যায়। কিছু পথ যাওয়ার পর হত্যাকারী আমান উল্লাহ সেই গাড়িতে ওঠে। চালক ছিল রাজা নামে একজন।’
হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে ডিবিপ্রধান বলেন, ‘সেই বাসায় (নিউ টাউন এলাকার সঞ্জিভা গার্ডেন) আগে থেকে জাহিদ ও সিয়াম অবস্থান করছিল। ওইদিন বেলা ২টা ৫১ মিনিটে বাসাটিতে প্রবেশ করেন আনার। এর ৩০ মিনিটের মধ্যেই হত্যা করা হয় তাকে। পরে ঘাতকরা সংসদ সদস্যের মোবাইল ফোন দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে মেসেজ পাঠায়। এরপর তারা মরদেহ খণ্ড-বিখণ্ড করে। পরবর্তী সময়ে দুটি ব্রিফকেসে করে জাহিদ ও সিয়াম সেগুলো গাড়িতে করে ফেলে দেয়, যাতে আনারের চিহ্ন না থাকে। কাজ শেষ করে ১৫ মে আমান ও শাহীনের প্রেমিকা শিলাস্তি দেশে ফিরে আসে। সবাই ফিরে আসায় হত্যার মাস্টারমাইন্ড শাহীন বিমানে করে দিল্লি, সেখানে ২ ঘণ্টার ট্রানজিট নিয়ে কাঠমান্ডু যায়। সেখান থেকে অন্য কোনো দেশে চলে যায়। মূলত শাহীনের পরিকল্পনায় হত্যার কাজটি করে আমান ওরফে শিমুল।’
এদিকে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া ভারতীয় একজনকে গ্রেফতারের পর চাঞ্চল্যকর বেশকিছু তথ্য পেয়েছে দেশটির আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তার কাছ থেকে পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিনিময়ে ভারতীয় গোয়েন্দাদের তিন সদস্যের একটি দল গতকাল ঢাকায় এসেছে। তারা বাংলাদেশে গ্রেফতার তিনজনের সঙ্গেও কথা বলবেন। প্রয়োজনে তাদের জিজ্ঞাসাবাদও করা হতে পারে বলে জানান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) খ. মহিদ উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘ভারতীয় গোয়েন্দা দলের তিন সদস্য হত্যাকাণ্ড নিয়ে তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও আনোয়ারুল আজীমের পরিবারের সঙ্গে কথা বলবেন। বাংলাদেশে গ্রেফতার তিন আসামিকেও জিজ্ঞাসাবাদ করবেন তারা।’
এর আগে গতকাল সকালে সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘এমপি আজীম হত্যার প্রায় সবকিছু চিহ্নিত হয়েছে। আমরা এখনো তদন্ত করছি। তদন্তের প্রয়োজনে ভারতের একটি টিম এখানে এসেছে। প্রয়োজনে আমাদের একটি টিমও ভারতে যাবে।’
ঝিনাইদহ-৪ আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য আনার কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। গত ১১ মে তিনি চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। প্রথমে কলকাতার বরাহনগরে তার বন্ধু স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন। কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হন। এরপর স্থানীয় থানায় জিডি করেন গোপাল বিশ্বাস। তদন্ত শুরু হয় দুই দেশে। বুধবার সকালে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে খবর আসে, নিউ টাউনের এক বাড়িতে খুন হয়েছেন এমপি আনার।
কলকাতায় সঞ্জিভা গার্ডেন নামের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের যে ফ্ল্যাটে আনার খুন হয়েছেন সেটি ঘুরে দেখে স্থানীয় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির আইজি অখিলেশ চতুর্বেদি। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে যা তথ্য আছে তাতে এমপি আনোয়ারুলকে সর্বশেষ ১৩ মে এখানে ঢুকতে দেখা গেছে। এর আগে তিনি এখানে এসেছিলেন কিনা সেটি আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। তবে তার মরদেহ উদ্ধার করা যায়নি।’
মরদেহ উদ্ধার না করে কীভাবে তাকে হত্যার বিষয়ে নিশ্চিত হচ্ছেন—এ বিষয়ে জানতে চাইলে অখিলেশ চতুর্বেদি বলেন, ‘আমাদের কাছে ইনপুট আছে। যে ফ্ল্যাটে সংসদ সদস্য আনারকে খুন করা হয়েছে, সেটির মালিক সন্দ্বীপ রায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কর্মচারী। ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছিলেন আক্তারুজ্জামান নামে এক ব্যক্তি, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। তবে আক্তারুজ্জামান এখনো ধরা পড়েননি। ভারত থেকে নেপাল হয়ে এরই মধ্যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন বলে খবর পেয়েছে ঢাকার পুলিশ।’
কলকাতার পুলিশ সূত্রের বরাত দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যমগুলো লিখেছে, শ্বাসরোধে হত্যার পর টুকরো টুকরো করে কাটা হয় সংসদ সদস্য আনারের দেহ। ১৬-১৮ মে পর্যন্ত তিনদিন ধরে দেহের অংশগুলো সরিয়ে ফেলা হয়। তবে সেগুলো কোথায় ফেলা হয়েছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
সিসি ক্যামেরার ভিডিও খতিয়ে দেখার পর তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, বরাহনগর থেকে একটি গাড়িতে চেপে নিউ টাউনের ওই বাড়িতে পৌঁছান সংসদ সদস্য আনার। পশ্চিমবঙ্গের সিআইডি সেই গাড়ির চালককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এছাড়া একটি রাইড শেয়ারের গাড়িও দেখা গেছে সিসি ক্যামেরায়, যে গাড়িতে করে সন্দেহজনক কয়েকজন ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। সেই গাড়ির চালককেও আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।