সংকীর্ণ ও অগভীর হচ্ছে পটুয়াখালীর নদী

দখলমুক্ত ও অপরিকল্পিত নদী শাসন বন্ধ করতে হবে

ছবি : বণিক বার্তা

‘নদীমাতৃক বাংলাদেশ’—এ পরিচয় আজ বিলীনের পথে। দেশের বুক চিরে যত জলধারা প্রবহমান ছিল একসময়, সেসব নদী এখন নানা সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে—দখল-দূষণ, অপরিকল্পিতভাবে নদী শাসন, জলবায়ু বিপর্যয় ইত্যাদি। এসব সংকট নদীগুলোকে সংকীর্ণ ও অগভীর নদীতে পরিণত করেছে। এমনই অবস্থা বর্তমানে পটুয়াখালীর নদীগুলোর, দৃষ্টিপাত করলে শীর্ণকায় নদীর স্বরূপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

বণিক বার্তার প্রতিবেদন অনুসারে, গত কয়েক বছরে জেলাটির নদীগুলোর গভীরতা ও প্রশস্ততা হারিয়েছে ব্যাপক মাত্রায়। দখল, অপরিকল্পিত নদী শাসন, অবকাঠামো নির্মাণ ও পলি পড়ে সংকীর্ণ ও অগভীর হয়ে পড়ছে নদীগুলো। অনেক স্থানেই প্রশস্ততা নেমে এসেছে আগের তুলনায় অর্ধেকে। নাব্য সংকটে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে সংকীর্ণ এলাকার পরিমাণ। পটুয়াখালীর নদীগুলোকে বাঁচাতে হলে দখলমুক্ত ও অপরিকল্পিতভাবে নদী শাসন, অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। এজন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে নদী রক্ষা কমিশনকে। ২০১৯ সালে হাইকোর্ট নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ মর্যাদা প্রদান করে এবং নদী রক্ষার গুরুভার অর্পণ করা হয় নদী রক্ষা কমিশনকে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন ২০১৩ অনুযায়ী, নদীর অবৈধ দখল-দূষণ রোধ, অবৈধ অবকাঠামো নির্মাণ এবং নদীর তীরে নানা অনিয়ম ইত্যাদি রোধ করে নদীর রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করার দায়িত্ব নদী রক্ষা কমিশনের। এ কমিশনের উচিত তার দায়দায়িত্ব পালনে সোচ্চার হওয়া, দখলদারদের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নেয়া। অন্যথায় পটুয়াখালীসহ বিলুপ্তির পথে বয়ে যাওয়া নদীগুলোকে আর বাঁচানো যাবে না। তাছাড়া নদী রক্ষা সাংবিধানিক দায়িত্বও বটে। সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রের দায়িত্ব দেশের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। 

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, পটুয়াখালী জেলায় নদ-নদীর সংখ্যা ৩৭টি। ভাটিতে অবস্থানের কারণে এক-দেড় দশক আগেও এগুলো ছিল বেশ প্রশস্ত ও খরস্রোতা। এ জেলার অন্যতম প্রধান নদী গলাচিপা। নদীটির বিভিন্ন পয়েন্টে গত ৩৫ বছরে প্রশস্ততা ও গভীরতা কমে নেমে এসেছে এক-তৃতীয়াংশ থেকে এক-চতুর্থাংশে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে নাব্য সংকটে নদীটি দিয়ে ভারী ও মাঝারি নৌযান চলাচল প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। নদীর গলাচিপা পৌর এলাকার মধ্যকার অংশটি এখন প্রায় পুরোপুরিই দখলদারদের আওতায়। গলাচিপা নদীর মতোই জেলার আগুনমুখা, লোহালিয়া, কোরালিয়া নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে গভীরতা ও প্রশস্ততা কমে অর্ধেক থেকে এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে। 

বাংলাদেশ নদী রক্ষা কমিশনের ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, জেলার নদীগুলোয় দখলদারের সংখ্যা ৯৯৯। এর মধ্যে পটুয়াখালী সদরে ৩০১ আর গলাচিপা উপজেলায় ২৮৯ জন। এছাড়া কলাপাড়ায় ১৮৬ ও রাঙ্গাবালীতে আছে ৫৫ জন। বাকিরা অন্যান্য উপজেলার বাসিন্দা। অনুমান করাই যায়, বর্তমানে দখলদারের সংখ্যা আরো বেশি। নদী দখল করে পারে গড়ে তুলেছে অবৈধ স্থাপনা, দোকানপাট; গড়েছে বাজার ও বসতি। ফলে নদীগুলো শীর্ণ হয়ে এসেছে। তবে দখলের পাশাপাশি নদীগুলোর এমন পরিস্থিতির জন্য উজান থেকে পানিপ্রবাহ হ্রাস ও পলিপ্রবাহ বেড়ে যাওয়া, অপরিকল্পিত স্লুইস গেট ও সেতু নির্মাণও অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করছেন পানি বিশেষজ্ঞরা। 

বন্যা প্রতিরোধের নামে খালগুলোর সঙ্গে নদীর সংযোগস্থলে স্লুইস গেট নির্মাণ করে পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এতে নদীর তলদেশে পলির পরিমাণ বেড়ে যায় ও অগভীর হয়ে যায় নদী। এছাড়া কোনো সেতু নির্মাণ করা হলে নদী পারের অনেকটা অংশ ভরাট করে ফেলা হয় এবং নদী সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। সুতরাং নদীকে তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে খালগুলোকে রক্ষা করা যেমন জরুরি, তেমনি প্রয়োজন অপরিকল্পিতভাবে সেতু নির্মাণ না করা। সেই সঙ্গে গভীরতা ও প্রশস্ততা ঠিক রাখতে পটুয়াখালীর নদ-নদীগুলোয় নিয়মিত ড্রেজিং করা আবশ্যক। তবে সেটি হতে হবে বৈজ্ঞানিক উপায় মেনে। উন্নত দেশ যেমন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের অসংখ্য দেশ, চীন, দক্ষিণ কোরিয়াসহ অন্য দেশগুলো বৈজ্ঞানিক উপায় অবলম্বনের মাধ্যমে এটি করে থাকে। কারণ এক নদী থেকে অন্য নদীর গঠন কাঠামো ভিন্ন হয়ে থাকে।

উন্নত দেশেও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনেই ড্রেজিং করা হয় এবং নদীর নাব্যতা ধরে রাখা হয়। নদীর নাব্যতা ফেরাতে এটিই সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি। বাংলাদেশেও ড্রেজিং পদ্ধতির প্রচলন রয়েছে। তবে উন্নত দেশে ড্রেজিং কার্যকর ভূমিকা রাখলেও এখানে তেমন কোনো পরিবর্তন রাখতে ব্যর্থ। কারণ কেবল বালি উত্তোলন করে খননকাজ করলেই নদীর নাব্যতা বজায় রাখা সম্ভব নয়। এজন্য চাই নদীবিশেষে বিশেষ ব্যবস্থা। নদী নিয়ে গবেষণা তাই জোরদার করা উচিত। প্রতিটি নদীর গতিপ্রকৃতি বিবেচনায় নিয়ে এর ব্যবস্থাপনাও আলাদাভাবে করতে হবে। নদীতে পলি জমবে, এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। পলি অপসারণে নিয়মতান্ত্রিক উপায় অনুসরণ করা জরুরি। বঙ্গোপসাগর-তীরবর্তী জেলা পটুয়াখালী। ভাটিতে অবস্থিত হওয়ায় পলি যেন জোয়ার-ভাটায় পুনরায় নদীগর্ভে নিপতিত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এতে নদী ভরাটের সমস্যা প্রকট হবে না অন্তত, যা নাব্য সংকটের অন্যতম কারণগুলোর একটি। আর খননকাজের সঙ্গে পলি কোন জমিতে অপসারণ করা হবে তা আগেই নির্ধারণ করতে হবে।

সারা দেশেই নদীর নাব্য সংকট বর্তমান। একসময় পটুয়াখালী থেকে ঢাকা ও অন্যান্য স্থানে চলাচলের প্রধান মাধ্যম ছিল নৌপথ। কিন্তু এখন এ জেলার নদীগুলোসহ অধিকাংশ নদী দিয়ে চলাচল করতে গিয়ে ডুবোচরের আধিক্য এবং গভীরতা না থাকার কারণে বড় নৌযানগুলোকে বিপত্তিতে পড়তে হয়, এমনকি চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক নৌপথ। পটুয়াখালীর নদীসহ দেশের সব নদীর পানিপ্রবাহ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পানির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে দীর্ঘস্থায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নদী এ দেশের মানুষের জীবন-জীবিকার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বহুলাংশে নদীর ওপর নির্ভরশীল। নদী বাঁচলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন