অভিমত

বৈষম্য কমিয়ে দুর্নীতির লাগাম ধরা জরুরি

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ

ছবি : বণিক বার্তা

ছাত্রটি মাঝেমধ্যে আমার রুমে আসে। অন্য এক বিভাগের ছাত্র। সমাজ-সংস্কৃতির নানা বিষয় নিয়ে জানতে চায়। পোশাকে-আশাকে বেশ সাধারণ। স্বাভাবিকভাবেই ওর ব্যক্তিগত জীবন আমার জানা হয়নি। সেদিন ওর আলাপচারিতার একপর্যায়ে আমি চমকে গেলাম। কিছুদিন আগে ওর ভুল ভেঙেছে। ওর মতো অনেক ছাত্রের ধারণা ছিল, আমরা শিক্ষকরা সরকারি প্রণোদনায় বেশ ভালো আছি। আমি বেতন স্কেলের এক নম্বর গ্রেডে বেতন পাই। ওর বাবা অতিরিক্ত সচিব থেকে কিছুদিন আগে অবসর নিয়েছেন। তাই ওর হিসাবমতো আমি ওর বাবার চেয়েও আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধায় ভালো থাকব। ও শুনে অবাক হলো, শিক্ষকদের আর কোনো সুবিধা থাকে না বলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসায় থাকি, তাই ৫০ ভাগ বাসা ভাড়া কেটে নেয়। প্রভিডেন্ট ফান্ডসহ আরো নানা কাটাকুটি আছে। বাড়ি বানাতে গিয়ে রিভলবিং ঋণ নিতে হয়েছে ব্যাংক থেকে। সব মিলিয়ে বেতন হাতে আসে ৫০ হাজার টাকার মতো। পৈতৃক বাড়ির ভাড়া, লেখালেখি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন পড়িয়ে কোনোক্রমে জীবন নির্বাহ করছি। আর যেসব শিক্ষকের এসব সুবিধা নেই তাদের অবস্থা অনুমান করা যায়। 

ছাত্রটির চেহারা বিষণ্ণ হয়ে গেল। বলল, আর সব বাদ দিই স্যার, সরকারি গাড়ি সুবিধা থাকার পরও আমার বাবার মতো অফিসাররা সহজ শর্তে ৩০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনেছেন। এর মেইনটেন্যান্স খরচের জন্য মাসে ৫০ হাজার টাকা পান। ছেলেটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, আমার বাবা চাকরি সুবাদে যে বিত্তবৈভব করেছেন তা আমার কাছে একটি প্রশ্ন হয়ে রয়েছে। আপনারা আমার বাবাদের পড়িয়েছেন। অথচ এ সমাজে আপনাদের কায়ক্লেশে জীবন নির্বাহ করতে হয়। এবার ওর প্রশ্ন, স্যার আপনার ব্যক্তিগত গাড়ির মেইনটেন্যান্স খরচ কত? ওর প্রশ্নবাণে জর্জরিত আমি জানালাম—দেখো, খরচ বাঁচাতে খুব দরকার না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে যাতায়াত করি। আমাদের অসুবিধা নেই—প্রভাষক থেকে অধ্যাপক সবাই বন্ধুর মতোই একই বাসে যাতায়াত করতে পারি। তবু ওর প্রশ্নের উত্তর দিতে হলো, বললাম ড্রাইভারের বেতনসহ ২৫ হাজার টাকার মধ্যে থাকতে চেষ্টা করি। ছাত্রটি হয়তো ওর বাবার পাওয়া ৫০ হাজার টাকার সঙ্গে তুলনা করছিল। 

সমাজের একটি পরিবর্তন দেখছি। আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি ঘুস খাওয়া-দুর্নীতি করা অফিসারদের অনেক শিক্ষিত সন্তান লজ্জা নিয়ে সমাজে চলত। অনেক পরিবার এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলত। এখন তেমন দেখা যায় না। ‘সুশিক্ষিত’ সন্তানরা বাবার অস্বাভাবিক আয় নিয়ে প্রশ্ন তোলে না, বরং অর্থের দাপটে মাথা উঁচু করে চলে। আমার কাছে আসা সরকারি আমলার ছেলেটি দেখলাম ব্যতিক্রম। ধীরে ধীরে জানলাম ও বাবার বিত্ত বেসাত গ্রহণ করে না। মায়ের কাছ থেকে সামান্য হাত খরচ নেয়। নানা বাড়ির সূত্রে ওটি মায়ের নিজস্ব আয়। এখানে টিউশনি করে। সাধারণ পোশাকে, সাধারণ খাবারেই ও তুষ্ট আছে।

এ কথাগুলো আজ লিখতে ইচ্ছা হলো কয়েক বছর আগে এক জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের কথা মনে পড়ায়। সংবাদটি ছিল সম্ভবত ভূমি সচিবের ‘সামান্য’ দুর্নীতি নিয়ে। এ সচিব নাকি এমন দুঃসময়ের সমাজে অপেক্ষাকৃত সৎ অফিসার বলে পরিচিত। একজন সৎ অফিসারের হাল-হকিকত নিয়ে যা লেখা হয়েছে, কম সৎদের ফিরিস্তি কী হবে জানি না। এমনিতেই সবাই বলেন, সরকারি আমলাদের সরকারি গাড়ি ব্যবহারের মেনিয়া আছে। কে কতটা গাড়ি কবজায় রাখতে পারেন তা নিয়ে নাকি চাকরির আভিজাত্য বিচার করা হয়। অনেক আগে আমি এক পরিচিত আমলাকে আনন্দ পেতে দেখেছি একটি প্রজেক্টে প্রেষণে নিয়োগ দেয়ায়। তার স্বস্তি, এই প্রজেক্টে নাকি গাড়ি সুবিধা ভালো।

আমাদের এ সচিব মহোদয় নিজে সরকারি গাড়ি ব্যবহার করেন। আরো দুটি দামি গাড়ি স্ত্রী-সন্তানদের ব্যবহারের জন্য দিয়েছেন। কোনো প্রজেক্টের একটি দামি গাড়িও ব্যবহার করে পরিবার। সরকারি সুবিধার ঋণে ৩০ লাখ টাকা দিয়ে গাড়ি কিনেছেন। ওটি তেমন ব্যবহার হয় না। সরকারি গাড়ি ব্যবহার করলে নিয়ম অনুযায়ী ২৫ হাজার টাকা মেইনটেন্যান্স খরচ নিতে পারেন। তিনি পূর্ণকালীন ব্যবহার দেখিয়ে ৫০ হাজার টাকা উত্তোলন করেন। আমাদের এ ‘সৎ’ আমলা ঝুলির বেড়াল খুলে দিয়েছেন। সাংবাদিকরা যখন প্রশ্ন করেন—অন্যায়ভাবে পরিবার-পরিজনকে সরকারি গাড়ি ব্যবহার করতে দিচ্ছেন কেন? উত্তরে জানালেন, সবাই তা করে। প্রশ্ন করা হলো, সরকারি গাড়ি ব্যবহার করেও ৫০ হাজার টাকা কেন উঠিয়ে নিচ্ছেন। একই উত্তর সবাই দিয়ে থাকে। আমি বিশ্বাস করি, আমলাদের মধ্যে সবাই নষ্ট হয়ে যাননি। সংখ্যায় আণুবীক্ষণিক হলেও কিছু সংখ্যক সৎ অফিসারও রয়েছেন। আমার এক সহকর্মী হাসতে হাসতে মন্তব্য করেছিলেন আমাদের দেশের রাজনৈতিক সরকারগুলো দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাদেরই পছন্দ করেন। কারণ আমলাদের দিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করানো যায়। সৎ মানুষ তো সহজে নতজানু হন না। এ কারণে অসৎ আমলাদের সাত খুন মাফ। স্বনামে-বেনামে এ দেশের আমলাদের প্লট-ফ্ল্যাট আর আর্থিক সমৃদ্ধির অভাব নেই। জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে যার মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। না হলে আমি বা আমার মতো ১ নম্বর গ্রেডে বেতন পাওয়া শিক্ষক যখন সংসার নির্বাহে হিমশিম খায় সেখানে আমাদের চেয়ে দু-তিন ধাপ নিচের অফিসারও ঠাটবাটে আমাদের ছাড়িয়ে অনেক আগে মগডালে উঠে যায়। 

আমি যুক্তরাজ্যের অনেক জায়গায়ই খোঁজ নিয়ে জেনেছি, উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের বিশাল ট্যাক্স দেয়া ও সংসার নির্বাহের খরচ মিটিয়ে খুব একটা ব্যাংক ব্যালান্স থাকে না। তবে ওরা কেউ বসে থাকে না। পরিবারের কর্মক্ষম সবাই কোনো না কোনো কাজ করে। এভাবে তারা মোটামুটি ভদ্রোচিতভাবে জীবন নির্বাহ করে। সাধারণত ১৮ বছরের পর ছেলেমেয়েরা নিজেদের উপার্জন নিজেরাই করে নেয়। রাষ্ট্রের দেয়া ঋণে লেখাপড়া করে।

আমাদের সমাজের অন্যতম বড় সংকট হচ্ছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য। দুর্নীতিগ্রস্ত দাপুটে ক্ষমতাবানরা যদি ক্রমাগত রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা পেতে থাকে এবং একই সমাজে মেধাবী প্রতিভাবানরা যদি রাষ্ট্রের কাছ থেকেও প্রণোদনা না পান তবে এদের মধ্যে হতাশা বাড়বে। এ অবস্থা সুস্থতা দিতে পারে না। 

২০১৮ সালে নর্দান আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্টে গিয়েছিলাম। সেখানে আমার পরিচিত বাংলাদেশের এক মেধাবী ছাত্রী আছে। কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএস করেছে ইংরেজি ভাষার ওপর। বলল, স্যার, এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা মাঝেমধ্যে প্রশ্ন রাখেন নানা গবেষণা প্রকল্পে, বিশেষ করে একাডেমিক প্রোগ্রামে তোমাদের দেশ থেকে শিক্ষকের বদলে সরকারি অফিসারদের পাঠানো হয় কেন! ওদের পারফম্যান্সও ভালো হয় না, আবার প্রায়োগিক ক্ষেত্রে ওরা শেখা বিদ্যা খুব একটা কাজেও লাগাতে পারবে না।

এমনিতেই পৃথিবীর নানা দেশে স্কলারশিপের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরও আর্থিক সামর্থ্য থাকে না যে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে গেলে শিক্ষকরা নিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্থিক সহযোগিতা পাবেন। এ কারণে অনেক মেধাবী শিক্ষক বিভিন্ন দেশে পিএইচডির জন্য ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েও অর্থের অভাবে শেষ পর্যন্ত যেতে পারেন না। বঙ্গবন্ধুর নামে একটি বড় ফান্ড আছে। বিদেশে গবেষণার জন্য ভর্তি হতে পারলে যোগ্যতার বিচারে বেশ আকর্ষণীয় অর্থ দেয়া হয়। শুনেছি, এই স্কলারশিপের সিংহভাগই নাকি আমলাদের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা হয়েছে।

এভাবে নানা বৈষম্যের আবর্তে ঘুরছে এ দেশ। সরকার অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আমরা বহুকাল ধরে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে হাঁটতে অনুরোধ করে আসছি। সবাই বলছেন, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতি কমাতে না পারলে অনেক শুভ ইচ্ছা ও শুভ পদক্ষেপ শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে না। অন্য কোথায়ও আস্থার জায়গা না থাকায় বারবার এ দেশের অসহায় মানুষের চাতক দৃষ্টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিকে। আজ সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য সচেতন মানুষকে নতুন করে শঙ্কায় ফেলেছে। এ কথা স্বীকার করতেই হবে বর্তমান সময়ের বাস্তবতায় দেশকে এগিয়ে নিতে হলে একদিকে যেমন দুর্নীতি কমাতে হবে তেমনি অন্যদিকে সুশিক্ষিত, সৎ ও দেশপ্রেমিক মানবসম্পদ তৈরি করতে হবে। সব উন্নত ও সভ্য দেশ শিক্ষাকে সবার ওপর গুরুত্ব দেয়। সমাজের চোখে শিক্ষককে মর্যাদাবান করার জন্য সুচিন্তিত নীতিনির্ধারণ করে। সেখানে কুটিল রাজনীতি ঢুকিয়ে শিক্ষক সমাজেও একটি নৈতিক অবক্ষয়ের পথ তৈরি করা হয়েছে। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষক প্রত্যক্ষভাবে আর্থিক দুর্নীতির সঙ্গে হয়তো নিজেদের জড়ান না বা জড়াতে পারেন না। কিন্তু দুষ্ট রাজনীতির ঘেরাটোপে পড়ে নৈতিক স্খলন তো অনেকেরই ঘটছে। এ জায়গাটি সংস্কার করার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। আমলাদের প্রতি সরকার যতটুকু সুদৃষ্টি দিচ্ছে এর চেয়ে বেশি নজর দিতে হবে শিক্ষকদের প্রতি। বৈষম্য কমাতে হবে পেশাজীবীদের মধ্যে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাজেটের দু-তিন ভাগ মাত্র গবেষণার জন্য বরাদ্দ থাকে। বিষয়টা এমন, ‘সব কাজ সেরে যদি সময় থাকে তো একটু গবেষণা করে নি’ এমন বাস্তবতা রেখে শিক্ষার মানোন্নয়ন কেমন করে হবে! বিশ্ববিদ্যালয়কে যদি আমরা জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান সৃষ্টির তপোবন মনে করতে চাই তবে শিক্ষা ও গবেষণার যথার্থ ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে। আর এ লক্ষ্যে সঠিক যাত্রা শুরু করতে হবে স্কুল থেকে। 

যতই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং দেশবাসী উন্নত দেশে পৌঁছার লক্ষ্যে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে চান না কেন, রাজনৈতিক দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজ আমলাতন্ত্র ততবারই পেছন দিক থেকে টেনে ধরবে। উন্নত দেশে পৌঁছার লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সুশিক্ষিত আলোকিত মানুষ দরকার। এ দিকটাকে পরিচর্যা করার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলার পথ অনেকটাই শক্ত ভিত্তি পাবে।

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন