বস্তি ছেড়ে গ্রামে ফিরলে কর্মসংস্থানের সুযোগ

ইতিবাচক উদ্যোগটির কার্যকর বাস্তবায়ন কাম্য

জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ কাজের সুযোগ-সুবিধা কমে যাওয়ার কারণে ক্রমে শহরমুখী হচ্ছে গ্রামের ভূমিহীন অসহায় মানুষ। এর মধ্যে কভিড পরিস্থিতি আরো সঙিন করে তুলেছে দরিদ্র মানুষের জীবন-জীবিকা। স্বাধীনতা-পরবর্তী যেখানে দেশের মোট দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাত্র শতাংশ শহরে বসবাস করত, বর্তমানে তা ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। ঢাকায় নিম্ন আয়ের লোক বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ছে আবাসিক চাহিদা। তা মেটাতে বাড়ছে ছোট-বড় বস্তির সংখ্যা। যেখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে বাধ্য হচ্ছে এর বাসিন্দারা। দিনের পর দিন এভাবে থাকতে গিয়ে এদের অনেকেই যেমন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, তেমনি জীবিকার সংস্থান না হওয়ায় অনেক সময় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডেও জড়িয়ে পড়ছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে, সমাজে। পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধিপূর্বক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘরে ফেরা কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন, যার আওতায় বস্তি ছেড়ে গ্রামে ফেরা মানুষদের আবাসন-কর্মসংস্থানসহ আরো সুযোগ-সুবিধা দেয়া হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ যথাপোযুক্ত সময়োচিত। ইতিবাচক কর্মসূচির যথাযথ কার্যকর বাস্তবায়ন কাম্য।

আমরা জানি, অতীতে এর আগে দুই দফায় শহরের বিভিন্ন স্থানে বসবাসকারী অবহেলিত, অসহায় ছিন্নমূল মানুষদের গ্রামের নিজস্ব ঠিকানায় ফিরিয়ে নিতে ঘরে ফেরা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে ছিন্নমূল মানুষদের নিজ এলাকায় ফিরিয়ে নিতে প্রথমবারের মতো কর্মসূচি শুরু হয়। তবে পরবর্তী সময়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে কর্মসূচিটি স্থগিত করা হয়। এরপর ২০১০ সালে কর্মসূচিটি চালু করা হয়, কিন্তু শুরুর দিকে কাজের অগ্রগতি হলেও দীর্ঘমেয়াদে কর্মসূচিটির ধারাবাহিকতা ধরে রাখা হয়নি। আমরা আশা করছি এবার কর্মসূচিটি ঘিরে নীতিনির্ধারকরা সচেষ্ট হবেন। অসহায় মানুষগুলোকে শুধু গ্রামে ফিরিয়ে নিলেই কাজ হবে না, তাদের জীবিকার ব্যবস্থা করাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করাও জরুরি। সামাজিক নিরাপত্তা, খাদ্যনিরাপত্তা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, ক্ষুদ্র ঋণ এবং গ্রামীণ অকৃষি কার্যক্রমের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।

শুধু ঢাকায় নয়, বস্তি দক্ষিণ এশিয়ার মেগা সিটিগুলোর অন্যতম সমস্যা। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ইন্দোনেশিয়া, চীন, ভারতকে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে দেখা গেছে। ভারত যেমন তাদের মডেল ভিলেজ প্ল্যান কিংবা গ্রামাঞ্চলে শহুরে সুবিধা নামের কর্মসূচির আওতায় গ্রামীণ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে গ্রামে থাকাকে উৎসাহিত করেছে। তামিলনাড়ু, জম্মু কাশ্মীর, কিংবা ঝাড়খণ্ডও ওই কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নে অনেকটাই সক্ষম হয়েছে। আবহাওয়া এলাকাভেদে দেশটি বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করে। জম্মু কাশ্মীরের গ্রামগুলোয় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কৃষির বিকাশের লক্ষ্যে সেখানের কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্রের সঙ্গে স্থানীয় কৃষকের মোবাইল নম্বর যুক্ত করা হয়। এরপর কেন্দ্রের পক্ষ থেকে আবহাওয়া সম্পর্কিত বিভিন্ন পূর্বাভাসের খবর মোবাইল বার্তায় পাঠানো হয় কৃষিজীবী মানুষদের কাছে। শস্য উৎপাদন ফলন সম্পর্কেও বিভিন্ন ধরনের তথ্য পৌঁছে দেয়া হয়। শস্যবীজ বপনের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ, মাটি পরীক্ষা, শস্য সুরক্ষা, ফসল তোলার পরবর্তী পর্যায়ে প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বিপণন-সংক্রান্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়া হয় কৃষকদের। এদিকে তামিলনাড়ুতে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে  ব্যবস্থা করা হয় কর্মসংস্থানের। প্রশিক্ষণার্থীদের নিজস্ব শিল্পোদ্যোগ গড়ে তুলতে আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়। কাজটি করতে প্রতিটি এলাকা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যকে বেছে নিয়ে তার হাতে কাজের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। একই সঙ্গে ধরনের বিভিন্ন প্রকল্পে যুক্ত করা হয় বেসরকারি খাতকেও।

গ্রামে ফেরা কর্মসূচির পাশাপাশি আমাাদের দেশেও আশ্রয়ণ প্রকল্প কিংবা আমার গ্রাম-আমার শহর কর্মসূচি রয়েছে। এর আওতায় সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের কাজও করা হচ্ছে। আর্থসামাজিক দিক দিয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ। শহরের বস্তিতে বসবাস করা বেশির ভাগেরই নির্দিষ্ট কোনো পেশা নেই। এদের বেশির ভাগই হকার, দিনমজুর, পরিবহন শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, রিকশাচালক। যাদের নিয়মিত কাজের ব্যবস্থা নেই। এদের গ্রামে পুনর্বাসনের মাধ্যমে একদিকে গ্রামীণ অর্থনীতিকে যেমন শক্তিশালী করা সম্ভব, তেমনি ঢাকার ওপর থেকেও চাপ কমানো যাবে। গ্রামে তাদের আবাসনের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি সহজ শর্তে ব্যাংকঋণের মাধ্যমে কৃষিকাজ কুটির শিল্পভিত্তিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় উৎসাহী করলে তা অর্থনীতির জন্য ফলপ্রসূ হবে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে রকম শিল্প, যেমন মৃিশল্প, মত্স্য চাষ, ইলেকট্রিক ওয়ারিংয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। একই সঙ্গে গ্রামে উৎপাদিত পণ্য যাতে সহজেই শহরে আসতে পারে আবার গ্রামে যাতে কাঁচামালের সহজলভ্যতা নিশ্চিত হয়, সে ব্যবস্থা করতে বাজারজাতের সহজীকরণের প্রতি আমাদের নজর দিতে হবে। ডেলিভারি চ্যানেলকে শক্তিশালী বিস্তৃত করতে দেশের ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।

আমরা জানি কর্মসূচির অধীনে সরকারের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণ দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। তবে উপকারভোগীদের সক্ষমতা কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ-পরবর্তী তারা তাদের দক্ষতা কতটা কাজে লাগাতে পারছে তাও মনিটরিং করা জরুরি। প্রশিক্ষণ-পরবর্তী আয়বর্ধনকারী ব্যবসা বা পেশা চালুর জন্য যে ঋণ প্রদান করা হবে, উপকারভোগীরা সঠিক খাতে ব্যবহার করছে কিনা দেখতে হবে তাও। দরিদ্র ব্যক্তিকে মানবসম্পদে পরিণত করে আত্মপ্রত্যয়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই কর্মসূচির সঠিক বাস্তবায়ন হবে।  আমরা যেমন আশ্রয়ণ প্রকল্পের ক্ষেত্রে অনিয়মের ঘটনা দেখেছি, আশা করি ঘটনার পুনরাবৃত্তি প্রকল্পে ঘটবে না। তাই প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিশেষ কমিটি গঠনের মাধ্যমে কার্যক্রমের যথাযথ তদারকি জরুরি। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের প্রকল্প বাস্তবায়নে যত্নবান হতে হবে।

শুধু ঢাকা নয়, দেশের সব শহর নগরে মানুষ বাড়ছে। শহরে বাস করা মানুষের ৩৫ শতাংশই বস্তিবাসী। ঢাকার এক বর্গকিলোমিটার বস্তি এলাকায় প্রায় দুই লাখ মানুষ বাস করে। বস্তিতে বাস করা পরিবারগুলোর মধ্যে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা সবচেয়ে বেশি। অথচ প্রতি বছর উপকূলীয় এলাকা থেকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাবে মানুষ বাসস্থান হারিয়ে জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে শহরে আসছে। এভাবে জনগোষ্ঠীর শহরমুখী অভিগমন থাকলে শহরে আবাসন সংকট দেখা দেবে। বাড়বে নগর দারিদ্র্য, খাদ্যাভাব জনসংখ্যা। তাই এদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে প্রধানমন্ত্রীর কর্মসূচির যথাযথ বাস্তবায়ন হওয়া জরুরি। এর মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসন কার্যক্রম দ্রুততর টেকসই হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন