চূড়ান্ত হয়নি জাতীয় গাইডলাইন

তাপপ্রবাহে মৃত্যুর সঠিক তথ্য ও কারণ জানা নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

তাপপ্রবাহে শরীরে যে হিট স্ট্রেস তৈরি হয়, তাতে মৃত্যু হতে পারে ছবি: ফাইল/নিজস্ব আলোকচিত্রী

চলতি মাসে অস্বাভাবিক গরমে সারা দেশে প্রায় অর্ধশত মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তাপপ্রবাহে শরীরে যে হিট স্ট্রেস তৈরি হয়, তাতে হিট স্ট্রোক ছাড়াও বিভিন্ন কারণে মৃত্যু হতে পারে বলে জানিয়েছেন রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্যবিদরা। তবে তাপপ্রবাহজনিত মৃত্যুর সঠিক তথ্য দিতে পারছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ পর্যন্ত হিট স্ট্রোকে ১০ জনের মৃত্যুর কথা বলেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। মৃতরা কী কী শারীরিক জটিলতায় মারা গেছেন, তা তাৎক্ষণিক জানার বিজ্ঞানসম্মত উপায় নেই বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

নাটোরে তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে নলডাঙ্গা উপজেলায় ভুট্টা তুলতে গিয়ে গতকাল সকালে অসুস্থ হয়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। জেলার সিভিল সার্জন ডা. মো. মশিউর রহমান জানান, খাজুরা ইউনিয়নের উজানপাড়ায় এ ঘটনা ঘটেছে। পঞ্চাশ বছর বয়সী মৃত মো. খায়রুল ইসলাম ১৫ দিন আগে সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে আসেন। সকালে শ্রমিকদের সঙ্গে তার ভুট্টার জমিতে কাজ করছিলেন। বেলা ১১টার দিকে তীব্র গরমে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ সময় শ্রমিকরা তাকে উদ্ধার করে খাজুরা বাজারে নিলে সেখানে তার মৃত্যু হয়। জেলাটিতে গতকাল ও রোববার তীব্র তাপমাত্রার কারণে আরো দুজনের মৃত্যু হয়েছে।

একইভাবে মুন্সিগঞ্জে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। তাপপ্রবাহজনিত কারণে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন সাতজন। গতকাল বেলা ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় প্রথমে হাসপাতালে নেয়া হয় ওমর আলীকে (৬৫)। এরপর কিছুক্ষণের ব্যবধানে একই অবস্থায় নেয়া হয় আব্দুল বাতেন মাঝিকেও (৭০)।

মৃতের স্বজন ও চিকিৎসকরা জানান, সকালে কৃষিজমিতে সেচ দিতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন কৃষক ওমর আলী। এছাড়া একই দিন সকালে জমিসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে জেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে যান আব্দুল বাতেন মাঝি। তাদের মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক পরীক্ষা করে মারা যাওয়ার কথা জানান।

এছাড়া চলতি সপ্তাহে কক্সবাজারে একজন, মাদারীপুরে দুজন, চট্টগ্রামে একজন, নরসিংদীতে একজন, চাঁদপুরে একজন, বরিশালে একজন, মুন্সিগঞ্জে একজন, সিলেটে একজন, নওগাঁয় একজন, কক্সবাজারে দুজন, রাজধানীতে তিনজন, নাটোরে দুজনের মৃত্যু হয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। তবে চলতি মাসে তাপপ্রবাহের কারণে সারা দেশে অর্ধশত মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

গতকাল বিকালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ (হেলথ ইমার্জেন্সি অ্যান্ড অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম) জানিয়েছে, গত এক সপ্তাহে হিট স্ট্রোকে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে আরো পাঁচজন দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন। গত ২২ এপ্রিল থেকে সারা দেশের সরকারি হাসপাতালে হিট স্ট্রোকের রোগীর তথ্য সংগ্রহ করা শুরু করে স্বাস্থ্য বিভাগ। হিট স্ট্রোকে মারা যাওয়া ১০ জনের মধ্যে আটজন পুরুষ ও দুজন নারী। মৃত ১০ জনের মধ্যে দুজন মারা গেছেন মাদারীপুরে। এছাড়া চুয়াডাঙ্গা, খুলনা, হবিগঞ্জ, রাজবাড়ী, ঝিনাইদহ, লালমনিরহাট, বান্দরবান ও চট্টগ্রাম জেলায় একজন করে মারা গেছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএসের (ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট জেলা হাসপাতাল বা উপজেলা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যে তথ্য পাঠায় তা সংগ্রহ করা হচ্ছে। শতভাগ নিশ্চিত হয়েই এসব তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তবে হিট স্ট্রোকের বাইরে অন্য কোনো কারণে মৃত্যু আছে কিনা জানতে চাইলে তারা জানান, ঠিক কোন কারণে মৃত্যু হয়েছে তা জানতে হলে ময়নাতদন্ত প্রয়োজন। মাঠ পর্যায় থেকে হিট স্ট্রোকের কথা উল্লেখ করে তথ্য পাঠানো হচ্ছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে মৃদু তাপপ্রবাহ, ৩৮ থেকে ৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে মাঝারি তাপপ্রবাহ, ৪০ থেকে ৪১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তীব্র তাপপ্রবাহ ও ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি হলে সেটি অতি তীব্র তাপপ্রবাহ।

বাংলাদেশে তাপমাত্রাজনিত কারণে এমন পরিস্থিতি আগে সৃষ্টি না হওয়ায় কেউ সতর্ক ছিল না বলে মন্তব্য করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘দেশে এর আগে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। ফলে কেউই প্রস্তুত ছিল না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যে তথ্য আসছে আর মাঠে যে তথ্য রয়েছে তার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য আছে। প্রকৃত তথ্য পাওয়া না গেলে জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পদক্ষেপ কঠিন হয়ে পড়ে। কোথায়, কোন বয়সী মানুষ ঠিক কী কারণে মারা যাচ্ছে তার সঠিক তথ্য নেই। ময়নাতদন্ত ছাড়া কোনো মৃত্যুর কারণ সঠিকভাবে বলা যাবে না। গত বছরও অনেক গরম থাকলেও চলতি বছরই মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।’

ডা. এবিএম আব্দুল্লাহর মতে, তাপমাত্রা বেশি হলে সাধারণত হিট স্ট্রোকে বেশি মৃত্যু হয়। অন্যান্য কারণও হতে পারে। যেমন হৃদরোগ দেখা দিতে পারে। তবে ঠিক কী কারণে অসুস্থ হচ্ছে বা মৃত্যু হচ্ছে তা পরীক্ষা না করে অনুমাননির্ভর বললে প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (সিডিসি) বলছে, প্রচণ্ড তাপের কারণে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যারা ঘরের বাইরে কাজ করেন, তাদের ঝুঁকি বেশি। তাপের ফলে হিট স্ট্রোক, ক্লান্তি, হৃদরোগ, হিট ক্র্যাম্প (লবণ ও পানির অভাবে পেশিতে খিঁচুনি), তাপ ফুসকুড়ি হতে পারে। তাপমাত্রার অধিক্যের কারণে যাদের বয়স ৬৫ বা তার বেশি তারা ঝুঁকিতে বেশি পড়েন। এছাড়া যাদের অতিরিক্ত ওজন, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে তারা গরমে মারাত্মক অসুস্থ হতে পারেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, চলমান তাপপ্রবাহের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে হাসপাতালগুলোতেও হিট স্ট্রোকের রোগী বাড়ছে। চলমান পরিস্থিতি মোকাবেলায়ও প্রস্তুতি রয়েছে সরকারের। হিট স্ট্রোকসহ তাপমাত্রাজনিত পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলায় একটি জাতীয় গাইডলাইন (নির্দেশিকা) তৈরি করা হয়েছে। এ নির্দেশিকা খসড়া করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মের প্রথম ১০ দিনের মধ্যে এ গাইডলাইন চূড়ান্ত হতে পারে। এরই মধ্যে খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের চিকিৎসকদের অনলাইনে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য বিভাগের চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।

‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল গাইডলাইন অন হিট রিলেটেড ইলনেস’ শিরোনামে নির্দেশিকা তৈরি কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. রুবীনা ইয়াসমিন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘গাইডলাইনটি সাধারণ মানুষের জন্য নয়। যারা চিকিৎসা দেবেন ও চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করবেন তাদের জন্য। তবে গাইডলাইনের শেষে জনসাধারণের জন্য কিছু পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। শুরুর দিকের অধ্যায়গুলোয় তাপপ্রবাহ এবং জনস্বাস্থ্যে জরুরি ঝুঁকিগুলো তুলে ধরা হয়েছে। পরের অধ্যায়গুলোয় হাসপাতালের প্রস্তুতি, বয়স্ক রোগীদের চিকিৎসা, গর্ভবতীদের জন্য চিকিৎসা, শিশুদের চিকিৎসা, প্রতিরোধের বিষয়ে কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে এসব রয়েছে। কী কী পরীক্ষা করতে হবে, কীভাবে রোগীকে ব্যবস্থাপনার আওতায় নিতে হবে, কী চিকিৎসা দেয়া হবে এসব রয়েছে।’

তিনি জানান, অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। ব্যক্তিভেদে ঝুঁকি ভিন্ন হয়। কারো হৃদযন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, কারো মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হতে পারে অথবা কেউ অন্য কোনো কারণে মারা যেতে পারে। ৩০ বছর বয়সী কেউ অতিরিক্ত তাপমাত্রাজনিত অসুস্থতা এবং ৭০ বছর বয়সী ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ এক নয়। মৃত্যু বিশ্লেষণ করতে হলে প্যাথলজিক্যাল অটোপসি (ময়নাতদন্ত) করতে হবে। এসব মৃত্যুর অটোপসির যে প্রক্রিয়া, তা অনেক ক্ষেত্রে করা যায় না। রোগীদের মেডিকেল হিস্ট্রিও জানা যায় না। ফলে চিকিৎসক তাৎক্ষণিকভাবে ধারণা করতে পারেন না, ঠিক কী কারণে মৃত্যু হয়েছে।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মৃত্যুর কারণ ময়নাতদন্ত না করে বলা যায় না। অতিরিক্ত তাপমাত্রার ফলে হিট স্ট্রোক ছাড়া হৃদরোগ বা অন্য কোনো কারণে মৃত্যু হতে পারে।’ বাংলাদেশের মতো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুর দেশে তাপপ্রবাহজনিত অসুস্থতার বিষয়ে আগে কেন গাইডলাইন তৈরি করা হয়নি, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘তাপপ্রবাহের ফলে দেশে আগে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। এখন বিষয়টি জনস্বাস্থ্যের জন্য উদ্বেগ তৈরি করছে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি, যেন সব অসুস্থতা এবং মৃত্যুর সঠিক তথ্য সংরক্ষণ করা যায়।’

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন বণিক বার্তার চট্টগ্রাম ব্যুরো ও সংশ্লিষ্ট জেলার প্রতিনিধিরা)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন