এনবিআর

দেশের অর্থনীতির ৩০-৪০ শতাংশ সরকারি হিসাববহির্ভূত

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : বণিক বার্তা

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে দেশের অর্থনীতির আকার (জিডিপি) ৪৫৪ বিলিয়ন ডলার। এর বাইরে সরকারি হিসাববহির্ভূত অর্থনীতি রয়েছে জিডিপির ৩০-৪০ শতাংশ বা ১৩৬-১৮০ বিলিয়ন ডলারের মতো। ছোট ব্যবসা থেকে শুরু করে বৃহৎ অনেক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অবৈধভাবে পরিচালিত হওয়ায় এ খাতটি দিন দিন বড় হচ্ছে। সরকারি হিসাবের বাইরে থাকায় এখান থেকে কোনো রাজস্বই পায় না সরকার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এনবিআরের পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়। 

প্রত্যাশা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় বাড়াতে না পারায় প্রতি অর্থবছরই সরকারের ঘাটতি বাজেটের আকার বড় হচ্ছে। জিডিপি অনুপাতে রাজস্ব আদায়ের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারেই পেছনের সারিতে। বর্তমানে দেশের রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত মাত্র ৭ দশমিক ৮ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যেও সর্বনিম্ন। এ অবস্থায় আইএমএফ থেকে ঋণ প্রাপ্তির শর্ত হিসেবে রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত সাড়ে ৯ শতাংশে উন্নীত করার শর্ত দেয়া হয়েছে। এ শর্ত পরিপালনে রাজস্ব আয় বাড়ানোর বিষয়ে নিজেদের পরিকল্পনা তুলে ধরে এনবিআর। গত ২৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে উত্থাপিত ‘রেভিনিউ মোবিলাইজেশন: ট্রেন্ডস অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক পজিশন পেপারে সরকারি হিসাবের বাইরে থাকা অর্থনীতির চিত্র সামনে আনা হয়েছে। 

এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের নিবন্ধিত করদাতার (টিআইএন নম্বরধারী) সংখ্যা এক কোটি। এর মধ্যে আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন অর্ধেকেরও কম, মাত্র ৪০ লাখ। দেশে সরকারি হিসাবের বাইরে থাকা অর্থনীতি ও জিডিপির অনুপাত ৩০-৪০ শতাংশ। অর্থনীতির বিরাট এ অংশ গণনার বাইরে থেকে যাওয়ার কারণেই কর-জিডিপির অনুপাত বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না।

এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা তো এখনো প্রাতিষ্ঠানিক খাতকেই পুরোপুরি রাজস্বের আওতায় আনতে পারিনি। এক কোটি টিআইএনধারী থাকলেও রিটার্ন দিচ্ছে কেবল ৪০ লাখ। তার মানে ৬০ লাখ এখনো করজালের বাইরে।’

ব্যক্তিশ্রেণীর করদাতাদের পাশাপাশি নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান থেকেও যথাযথ শুল্ক আদায় করতে পারছে না এনবিআর। সংস্থাটির হিসাবে, দেশে নিবন্ধিত শুল্কধারীর সংখ্যা ৪ লাখ ৮০ হাজার। অথচ শুল্ক আয় করা সম্ভব হচ্ছে ৪ লাখ ৫০ হাজার প্রতিষ্ঠান থেকে। এক্ষেত্রে অন্তত ৩০ হাজার প্রতিষ্ঠান শুল্ক দিচ্ছে না। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানেও বাংলাদেশের চেয়ে বড় অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত রয়েছে। তারপরও রাজস্ব আদায়ের হারে অনেক এগিয়ে রয়েছে তারা। সরকারি হিসাবের বাইরে থাকা অর্থনীতির কারণে রাজস্ব আয় কম হচ্ছে বিষয়টি এমন নয়। বরং দেশের অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও শিল্প গ্রুপও কর ফাঁকি দিচ্ছে। যে কারণে জিডিপির আকার এত বড় হওয়া সত্ত্বেও রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। 

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যেখানে আয় হবে সেখান থেকেই কর নিতে হবে এনবিআরকে। আদায় না করতে পারলে এটা ব্যর্থতা। কারণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হলেই মানুষকে ভ্যাট দিতে হচ্ছে। তবে ন্যূনতম করসীমা সাড়ে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকার মধ্যে থাকলে তাদের হয়তো আয়কর দিতে হয় না। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কারণে কর বাড়ছে না—এটা আসলে সঠিক যুক্তি না। যদি তাই হয় দেশের অর্থনীতির আকার এত বড় হয়েছে কীভাবে? তাহলে বড়রা কর ফাঁকি দিচ্ছে হয়তো। যে কারণে রাজস্ব আয় বাড়ছে না।’ 

বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বড় অনুষঙ্গ এখন অপরাধমূলক অর্থনৈতিক কার্যক্রম। চোরাচালান, ডলার বিনিময় হার-সংক্রান্ত অসামঞ্জস্যতা, রফতানি পণ্যের গরমিল দেখিয়ে অর্থ পাচার, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ পাচার ও শ্রমশক্তির যথাযথ হিসাব না থাকা। সেই সঙ্গে স্বর্ণ-মাদকসহ অন্যান্য দ্রব্য চোরাচালান ও মানব পাচারের মতো অপরাধমূলক কার্যক্রমে হুন্ডি-হাওলার ব্যবহার এখন বৃহৎ আকারে বেড়েছে। অত্যন্ত রক্ষণশীলভাবে হিসাব করে দেখা গেছে, দেশে হুন্ডি-হাওলার বাজার ৩০-৩৫ বিলিয়ন (৩ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি) ডলার ছাড়িয়েছে। অর্থনীতিবিদ ও খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আরো গভীর ও গবেষণাভিত্তিক অনুসন্ধান চালালে দেখা যাবে এর বাজার তার চেয়েও অনেক বড়। 

হিসাব অনুযায়ী, দেশে আন্তর্জাতিক পণ্য বাণিজ্যে হুন্ডি-হাওলার মাধ্যমে লেনদেনকৃত অর্থের পরিমাণ কমপক্ষে ১৫ বিলিয়ন ডলার। রেমিট্যান্স হিসেবে আসছে আরো ১০ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া দুর্নীতি ও কালোবাজারির মাধ্যমে অবৈধ অর্থ পাচার, স্বর্ণ ও অন্যান্য পণ্য চোরাচালান, মানব পাচারের মতো কার্যক্রমে হুন্ডি-হাওলার অবদান ৫-১০ বিলিয়ন ডলার। 

বাংলাদেশ সরকার ‘ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ফর প্রিভেন্টিং মানি লন্ডারিং অ্যান্ড কমব্যাটিং ফাইন্যান্সিং অব টেরোরিজম ২০১৯-২১’ শীর্ষক একটি কৌশলপত্র তৈরি করেছে। তাতে দেশ থেকে অর্থ পাচারের গন্তব্য হিসেবে ১০টি দেশের কথা উল্লেখ করা হয়। এগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত (বিশেষ করে দুবাই), মালয়েশিয়া, কেইমান আইল্যান্ড ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস। এসব গন্তব্যে অর্থ পাচারের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হলো হুন্ডি-হাওলা।

স্বর্ণ চোরাচালানেও এখন নগদ অর্থের ব্যবহার বেড়েছে। পাশাপাশি এর অনুষঙ্গ হিসেবে সীমান্তকেন্দ্রিক হুন্ডি বাণিজ্যও এখন বড় হয়েছে। শুধু স্বর্ণ চোরাচালান নয়, আরো অনেক ক্ষেত্রেই অবৈধ হুন্ডির ব্যবহার বেড়েছে। এর পেছনে ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থের প্রবাহ বেড়ে যাওয়াকেই দায়ী করছেন পর্যবেক্ষকরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পাঁচ বছরের ব্যবধানে ব্যাংকের বাইরে থাকা দেশের নগদ অর্থের পরিমাণ বেড়েছে অন্তত ৭০ শতাংশ। 

সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার অন্যতম একটি খাত হলো জমি ও ফ্ল্যাট বিক্রি। জমি বিক্রির ক্ষেত্রে প্রকৃত মূল্য না দেখিয়ে মৌজা মূল্য দেখানো হয়। আবার ফ্ল্যাট বিক্রির ক্ষেত্রেও প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অনেক কম মূল্য দেখানো হচ্ছে। জমি, আবাসন কিংবা ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে কর ফাঁকি প্রমাণের কথাও জানিয়েছে এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি)। স্বনামধন্য ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, আইনজীবী, জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় আছেন এ তালিকায়।

কর আদায়ের ক্ষেত্রে নজরদারি বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিক খাতের মধ্যে যারা কর দিচ্ছে না, তাদের দিকে নজর দিলে রাজস্ব আয় বাড়বে। পাশাপাশি কর আদায় ব্যবস্থার সংস্কার করা গেলেও আয় বাড়ানো সম্ভব হবে। এমনিতে আমাদের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত অনেক বড়। কিন্তু করযোগ্য অনেক ব্যবসায়ীও টিআইএনধারী বা লাইসেন্স গ্রহণ করেন না। সেক্ষেত্রে যারা কর ফাঁকি দেয় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়। আবার অটোমেশনের মাধ্যমে পদ্ধতি সহজ করলেও মানুষের মধ্যে আস্থা বাড়বে, ভয় কমবে। তখন রাজস্ব আয় বাড়বে।’ 

অর্থনীতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ব্যবহার করেও দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন অনেক অর্থনীতিবিদ। তাদের দাবি, আমদানি-রফতানির মূল্য কম দেখিয়ে, একই সঙ্গে আমদানির পণ্যমূল্য কম দেখিয়ে শুল্ক ফাঁকি দেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আয় করতে পারছে না এনবিআর। আমদানি দায় পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থাকলেও দেশের রফতানি আয় যথাসময়ে প্রত্যাবাসিত হচ্ছে না। 

সার্বিক বিষয়ে সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিক খাতকেই আমরা পুরোপুরি করের আওতায় আনতে পারিনি। এ খাতের প্রায় এক-চতুর্থাংশ মানুষ কর দেয় না। এখানে অনেক কর ফাঁকি আছে। এটা আমাদের প্রশাসনিক ও সক্ষমতার বিষয়। ইচ্ছাকৃত কেউ কর দেয় না। তাই করযোগ্য মানুষকে চিহ্নিত করে তা আদায় করতে হবে। মিষ্টির দোকান, ডাক্তার ও শিক্ষকের আয় বেশি হলে তাদের থেকে কর চাইতে পারে এনবিআর।’ 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন