কেবল তালগাছ বা লাইটনিং অ্যারেস্টার লাগিয়ে বজ্রপাতে হতাহতের সংখ্যা কমানো যাবে না

ছবি : বণিক বার্তা

আশরাফ দেওয়ান গবেষণা পরিচালক, স্কুল অব আর্থ অ্যান্ড প্ল্যানেটারি সায়েন্সেস, কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া। অধ্যাপনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগেও। একই বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে তিনি জাপানের ওকাইয়ামা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন ও নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্টডক্টরাল ফেলোশিপ করেন। পরিবেশ, নগর পরিকল্পনা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি নিরসন সম্পর্কিত বিশ্বের বড় বড় গবেষণা সাময়িকীতে তার শতাধিক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। উপকূলীয় পরিবেশ, নগরীয় উষ্ণায়ন, জলবায়ু পরিবর্তনে মানুষের ভূমিকা এবং বজ্রপাত তার গবেষণার বিষয়। সম্প্রতি বাংলাদেশের বজ্রপাত মোকাবেলার নানা বিষয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাবরিনা স্বর্ণা

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বজ্রপাতের ঘটনা বেড়েছে, এর পেছনে কারণ কী?

এ কথার সঙ্গে আমি দ্বিমত পোষণ করি। বজ্রপাতের ঘটনা বাড়েনি, মানুষের এক্সপোজার বেড়েছে। আমার ছোটবেলায় বজ্রপাত হতো, এখনো হচ্ছে। বলা হয়ে থাকে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে বজ্রপাত বাড়বে। এ পরিপ্রেক্ষিতে যদি আমি প্রশ্ন করি, পুরো এপ্রিলজুড়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রচণ্ড গরম ছিল, সে সময় কতটা বজ্রপাত দেখা গেছে? মোটেও দেখা যায়নি। বজ্রপাতের সংখ্যা বেড়েছে বলা হচ্ছে কিন্তু তা পরিসংখ্যান বিবেচনায় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়েনি। তবে সব জায়গায় অল্পবিস্তর বেড়েছে। বজ্রপাত বাড়ছে এ প্রশ্নের চেয়ে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হতে পারে কেন মানুষ বেশি মারা যাচ্ছে। এর কারণ বজ্রপাতের ধর্ম। বজ্রপাতের বৈশিষ্ট্যই হলো, যদি কেউ খালি মাঠে বা পানির পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, তবে সমতল ভূমির তুলনায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির উচ্চতা বেশি হওয়ায় সে সরাসরি বজ্রপাতের শিকার হতে পারে। যে কারণে মানুষ যখন খেতখামারে কৃষিকাজ করে কিংবা মাছ ধরে তারা বজ্রপাতের শিকার হয়। গত সাত-আট বছর আমরা কাজ করে দেখছি কোন কোন আবহাওয়াগত বিষয় বজ্রপাতের ঘটনার জন্য দায়ী। আমাদের কাজটি এখনো চলমান। কিন্তু এটি বলতে পারি, মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে এক্সপোজার ও অজ্ঞতার কারণে। আবার কিছুদিন পরপর সংবাদমাধ্যমে মানুষের মৃত্যুসংখ্যা বাড়ছে প্রকাশ পেলেও পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে সংখ্যাটি ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে না। বজ্রপাতের সংখ্যাটিও তেমন। আমাদের দেশের সমস্যা এটি, একটি বিষয় সামনে এলে, চড়াও হলে নির্বিশেষে সবাই এক সুরে কথা বলা শুরু করে। কিন্তু বিজ্ঞান বা পরিসংখ্যান তা বলছে না।

আমরা স্বল্পমেয়াদে বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি, প্রাণহানি কমাতে কী করতে পারি?

বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি রোধে অনেক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। তবে প্রকল্প গ্রহণের জন্য আমাদের অর্থের সক্ষমতা থাকলেও আমরা মানসিকভাবে দৈন্য। আমরা অর্থের প্রয়োগ সঠিকভাবে করতে পারি না। লাইটনিং অ্যারেস্টার বসানো হলো, তালগাছ প্রকল্প নেয়া হলো সেসব জানা গেছে। কিন্তু সেগুলো কাজ করছে কিনা তা জানা যায় না। সেসবের প্রয়োগ আমরা দেখি না। কেন দেখি না? এর কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যাবে এসবের রক্ষণাবেক্ষণ নেই। এ পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে হলে, বিশেষ করে গ্রামে যারা থাকেন, তাদের সচেতন করতে হবে। বজ্রপাতে শহরের মানুষ তেমন একটা মারা যায় না, অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি হয় বেশি। গ্রামের মানুষ মারা যায়, কারণ একজন কৃষককে ফসল তুলতে মাঠে যেতেই হবে। সে বজ্রপাতের কথা ভেবে ঘরে বসে থাকে না। এক্ষেত্রে শিক্ষা ও সচেতনতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। উদাহরণস্বরূপ আমরা ঘূর্ণিঝড়ের কথা বলতে পারি। একসময় ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক প্রাণহানি হতো, কিন্তু এখন আর সেভাবে মানুষ মারা যায় না। কারণ ঘূর্ণিঝড় বিষয়ক পূর্বপ্রস্তুতি ও সচেতনতা দুটোই বেড়েছে।

একসময় দেখেছি ‘বাঁচতে হলে জানতে হবে’ এমন ধরনের নানা ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানো হতো। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে কোন মাধ্যমে আমরা বজ্রপাত সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে পারি? 

স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে বজ্রপাত সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হবে। ম্যাজিস্ট্রেট, এসিল্যান্ড, মসজিদের ইমাম প্রমুখ ব্যক্তির সাহায্যে কোন কোন সময় বজ্রপাতের সম্ভাবনা রয়েছে তা এলাকাবাসীকে জানাতে হবে। কেননা আমাদের কাছে এ বিষয়ে এলাকা ও সময়ভিত্তিক তথ্য থাকে। যে তথ্যের ভিত্তিতে তাদের জানাতে পারি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বাইরে যাওয়া থেকে বিরত থাকার কথা। নয়তো কেবল অহেতুক অর্থ অপচয় হবে সরকারের। বজ্রপাত এতটা এলাকাভিত্তিক ও বৈচিত্র্যময় ঘটনা যে স্থানীয় বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় এর সমাধান করতে হবে। একই সঙ্গে বজ্রপাতের সময় কী করতে হবে সে শিক্ষাটাও জরুরি। বজ্রপাত থেকে বাঁচার একটা ‘থার্টি-থার্টি (৩০ সেকেন্ড ৩০ মিনিট) নিয়ম আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এটি বেশ প্রসিদ্ধ পদ্ধতি। সাধারণত আমরা প্রথমে বজ্রপাতের আলো দেখি ও পরে শব্দ শুনে থাকি। দেখা ও শোনার মধ্যকার সময় ৩০ সেকেন্ডের কম হয়, তবে সঙ্গে সঙ্গে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে হবে। আর বজ্রপাতের সর্বশেষ শব্দ শোনার ৩০ মিনিট পর্যন্ত নিরাপদ স্থানে থাকতে হবে। আমাদের দেশে সম্পদের সংকট যেমন আছে তেমনি অপচয়ও প্রচুর। সেগুলোর সমন্বয়ে বজ্রপাত মোকাবেলা করতে হবে। কেবল তালগাছ বা লাইটনিং অ্যারেস্টার লাগিয়ে এতে হতাহতের সংখ্যা কমানো যাবে না। তালগাছ বড় হতে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন। আবার লাইটনিং অ্যারেস্টার লাগানো হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেগুলোর দেখভাল নেই। ফলে সেগুলো কার্যকারিতা হারাচ্ছে। বিকল অ্যারেস্টারের নিচে ছাউনি করে মানুষকে বাঁচানো সম্ভব না। সুতরাং আমাদের দেশের সব প্রকল্পের তদারকি প্রয়োজন এবং সবচেয়ে জরুরি হলো সঠিক জ্ঞান, যা ছাড়া বজ্রপাত থেকে মানুষকে বাঁচানোর বিকল্প নেই।

বজ্রপাতের প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণে জাতীয় কিংবা বৈজ্ঞানিক কোনো পরিসংখ্যান আমাদের নেই। সঠিক তথ্য ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ঘাটতিও কি বজ্রপাত মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা?

কোনো সমস্যা হলে বিদেশীরা এসে সমাধান করবে—এটি আমাদের দেশে এক ধরনের প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর আমাদের গবেষণা খাতের একটি সমস্যা হলো তথ্য-উপাত্ত সংকট। যে তথ্য-উপাত্ত আমরা পেয়ে থাকি সাধারণত, সেগুলো অনেক যাচাই-বাছাই করে নিতে হয়। উদাহরণস্বরূপ আমাদের সংবাদপত্রের খবরগুলোর দিকে নজর দেয়া যেতে পারে। একেকটি পত্রিকায় বিভিন্নভাবে খবর প্রকাশ করেছে। প্রকৃত মৃতের সংখ্যা নিয়েও গরমিল রয়েছে। অথচ নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে সঠিক তথ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তথ্যই যদি ভুল হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই পদক্ষেপটিও ভুল হবে। অন্যদিকে সবাই বলে থাকে গবেষণায় জোর দিতে হবে। কিন্তু গবেষণায় জোর দেয়ার জন্য দক্ষ গবেষক ও পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। এখানে আমাদের ঘাটতি আছে। বাঙালি জাতি মেধাবী, আমাদের সক্ষমতা আছে। কিন্তু সুযোগের অভাবে আমরা কাজে লাগাতে পারি না। যেমন ঢাকা শহর বা নগরগুলোর একটা পলিসি আছে যে নগর উন্নয়নের জন্য জলাশয় ভরাট করা যাবে না। কিন্তু কেবল ঢাকার দিকে যদি লক্ষ করি—জলাশয় কোথায়! অর্থাৎ পলিসিগুলোকে নির্ভুলভাবে নির্ধারণ করা ও বাস্তবায়নে আমাদের দুর্বলতা আছে। এর পেছনে আমরা সবাই দায়ী। এক্ষেত্রে শুধু সরকারকে দোষ দিলে চলবে না। সরকার আমাদেরই একজন; আমরা দায়িত্ব দিয়েছি সরকারকে। এটি আমরা সাধারণ মানুষ বুঝতে চাই না এবং সরকারকে সহযোগিতাও করি না। এ চর্চা থেকেও মানুষের বের হওয়া দরকার। আমরা জানি বজ্রপাতে কোন অঞ্চল ও কোন সময়টা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এ তথ্যগুলোকে ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারলে মৃত্যু কমানো সম্ভব। আবারো বলছি, এক্ষেত্রে সচেতনতার বিকল্প নেই। 

আপনাদের গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছিল, যত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, তার মধ্যে ৭২ শতাংশ কৃষক। প্রতি অঞ্চল থেকে যদি এভাবে একজন কৃষকও মারা যান তাহলে তা কৃষি উৎপাদন ও সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের সংকট হয়ে দাঁড়াবে। আবার কৃষিকাজ করা থেকে আমরা তাদের বিরতও রাখতে পারি না। এ অবস্থায় কৃষকদের বাঁচাতে তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের করণীয় কী হতে পারে? 

কৃষকদের বজ্রপাত থেকে বাঁচাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি কৌশল অবলম্বন করা হয়। কৃষকদের জন্য কৃষিখেতের পাশে বজ্র নিরোধক দণ্ডসহ বড় বড় গাড়ি রাখা হয়। কৃষকরা যখন বজ্রপাত হওয়ার সম্ভাবনা দেখে তখন তারা এসব বাস বা গাড়ির ভেতরে গিয়ে আশ্রয় নেন। এ কৌশল আমাদের দেশে, বিশেষ করে দুর্যোগপূর্ণ অঞ্চলগুলোয় অবলম্বন করা যেতে পারে। এখন কৃষকদের বোরো ধান ওঠানোর সময়। আর বোরো ধান সব অঞ্চলে হয় না। নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে হয়। সেসব অঞ্চলে এসব গাড়ি বা বাস পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা যেতে পারে। আর কৃষকদের জানাতে হবে তারা বজ্রপাত বা কালো মেঘ দেখলে সেখানে আশ্রয় নিতে পারে। অনেক সময় মাঠে অবকাঠামো বা ছাউনি তৈরি করা হয় বজ্রপাত থেকে বাঁচতে বা কৃষকের বিশ্রামাগার হিসেবে। এতে ওই খেত বা জায়গা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেটা না করে খেতের পাশে একটা গাড়ি বা অস্থায়ী ঘর রাখা যেতে পারে। সেগুলো অন্য কাজেও ব্যবহার হতে পারে। বজ্রপাতে স্কুলের ছেলেমেয়েদের মৃত্যুহারও কম নয়। আমাদের দেশে অনেক কিছুতে অব্যবস্থাপনা আছে। আমরা নিরাপত্তাকে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে অন্য কিছুকে বেশি গুরুত্ব দিই। স্কুলের ছেলেমেয়েদের বড় অংশের মৃত্যুর কারণ বজ্রপাত। সেজন্য সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে বাস ব্যবহার ধারণা রয়েছে সেটা পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। গণমানুষ বিশেষ করে কৃষক শ্রেণী ও মৎস্যজীবী—এদের মধ্যে যদি ভয় ঢুকে যায় বা তারা যদি কাজে না যায় তাহলে খাদ্য শহরে আসবে না। শহরের খাদ্য তারাই সরবরাহ করে থাকে। সুতরাং তাদের সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া উচিত। অবশ্য সরকার এ বিষয়ে নজর দিচ্ছে। তবে আরো পরিকল্পিত উপায়ে নজর দিলে মৃত্যুহার অনেকাংশে কমিয়ে আনা যাবে।

সম্প্রতি বণিক বার্তাকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পরিচালক জানিয়েছেন, এরই মধ্যে ১৫টি জেলায় ৩৬০টি লাইটনিং অ্যারেস্টার বসানো হয়েছে। এছাড়া সরকার আরো কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে যার মাধ্যমে ৬০০টি মেশিন বসানো হবে। এ পরিকল্পনাকে আপনি কীভাবে বিবেচনা করবেন? 

সাধারণভাবে লাইটনিং অ্যারেস্টার এক ধরনের আর্থিং। এর কিছু বৈদ্যুতিক মেকানিজম আছে। লাইটনিং ডিটেক্টর বসিয়েছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর (বিএমডি)। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ব্যবস্থাপনা নেই। যদি ব্যবস্থাপনা না করা হয় তাহলে তা বসিয়ে তো লাভ নেই। এক্ষেত্রে প্রয়োজন দেশে কেন্দ্রীয় লাইটনিং ডিটেকশন সিস্টেম তৈরি। পূর্বাভাসগুলো আসে বিএমডি থেকে। কিন্তু বিএমডির সেই সক্ষমতা আছে? নেই। অফিশিয়াল কর্তৃপক্ষ হিসেবে এদের মূল উদ্দেশ্য হবে মানুষকে সচেতন করা। কিন্তু তাদের মধ্যে সেই সক্ষমতাই নেই। পাঁচ-ছয় বছর আগে ৮-১০টি লাইটনিং ডিটেক্টর বসিয়েছে, সেগুলোর কোনো হদিস নেই। এখনো অ্যারেস্টার বসানো হচ্ছে, তবে সন্দিহান সেগুলো পাঁচ বছর পরে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। আমি মনে করি, টেকসই উপায়ে চিন্তা করা উচিত। এক্ষেত্রে হয়তো সরকারের সদিচ্ছার অভাব নেই। সদিচ্ছা থাকলেও এসব খাতে যে অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে তা জনগণেরই অর্থ। এ ব্যয়ের মাধ্যমে ফলাফল যাতে ভালো হয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। 

টেকসই পদক্ষেপগুলো কী হতে পারে?

ভালো করে তদারকি (মনিটরিং) করতে হবে। কোনো অঞ্চলে ১০০টি লাইটনিং ডিটেক্টর লাগানো হলো। লাগানোর পর কতটা বজ্রপাত ডিটেক্ট করা হয়েছে এবং কতগুলো মানুষ মরেছে সেগুলোর পরীক্ষা করতে হবে। পরীক্ষার ফলাফল যদি আগের তুলনায় ভালো হয় সেক্ষেত্রে আরো ৬০০টি লাগানোর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। কিন্তু যদি যন্ত্রগুলো কাজ না করে তাহলে? আমরা অনেক ধরনের পরিকল্পনা নিতে পারি, পরিকল্পনাগুলোকে যদি অর্থবহ করতে হয় তাহলে সুনির্দিষ্ট কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে যেতে হবে। গবেষণা করে দেখতে হবে। একটি কথা আমি সবসময় বলে থাকি, অস্ট্রেলিয়া থেকে কোনো প্রযুক্তি দেশে স্থাপন করা হলে কোনো মানুষ বাঁচতে পারবে না। কারণ এ প্রযুক্তি অস্ট্রেলিয়ার জন্য করা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছুদিন আগে বলেছিলেন, ‘‌বাংলাদেশের স্থানীয় বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে চিন্তা করতে হবে।’ আমার মনে হয়, সেই জায়গায় অনেক ঘাটতি এখনো আছে। তাই দেশের বিভিন্ন সংস্থার স্থানীয় বৈশিষ্ট্যকে গুরুত্ব দিয়ে জলবায়ুর পদক্ষেপগুলো নেয়া উচিত। যদি এটা না করা হয় তাহলে যতই অ্যারেস্টার বসানো হোক তাতে কোনো কাজে আসবে না। শুধু অর্থের অপচয় হবে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে যা কিছু করা হয়েছে, বিশেষ করে বজ্রপাত সম্পর্কিত কোনো পদক্ষেপই কাজে আসেনি। 

স্থানীয় বৈশিষ্ট্য ও বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আমাদের কোন প্রযুক্তির দিকে সর্বপ্রথম যাওয়া উচিত? 

লাইটনিং সম্পর্কে বজ্রপাতের যে পূর্বাভাস দেয়া হয় তা সারা পৃথিবীর বড় দেশগুলোয় খুবই কার্যকর। সেই পূর্বাভাস সেসব দেশের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে হয়েছে। সেসব দেশের লাইটনিং ম্যানেজমেন্ট ফলপ্রসূ। আমরা এ প্রযুক্তির আলোকেই আমাদের স্থানীয় বৈশিষ্ট্যকে নিয়ে পরিকল্পনা করতে পারি। সেসব দেশে হলে বাংলাদেশে হবে না কেন? বাংলাদেশ তো কোনো বিচ্ছিন্ন জায়গা না, আমাদের এ পৃথিবীরই একটি অংশ। সেসব দেশে হলে আমাদের দেশেও হবে। সেক্ষেত্রে আমাদের চাহিদা অনুপাতে তা তৈরি করতে হবে, তাহলেই তা সম্ভব। চাহিদা অনুপাতে তৈরি না করে অন্যদের কথামতো তৈরি করলে তা কাজে আসবে না। 

দেশে যা কিছুই করা হয় বিদেশীদের প্রেসক্রিপশনে। যেন বিদেশী বিশেষজ্ঞ হলে তার কথা মহামূল্যবান আর দেশী বিশেষজ্ঞ হলে তিনি কিছু জানেন না। এমন সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশীরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খুবই ভালো অবস্থানে রয়েছে। সরকার চাইলে তাদের ব্যবহার করতে পারে। বজ্রপাত এমন একটি দুর্যোগ, যা কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই সংঘটিত হয়। বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের মতো বজ্রপাতের কোনো দীর্ঘ সময় আগে পূর্বাভাস পাওয়া যায় না। স্থানীয় বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে যদি কোনো পরিকল্পনা না নেয়া হয়, যত ধরনের অ্যারেস্টার বসানো বা ছাউনি তৈরি করা বা তালগাছ লাগানো হোক না কেন সেসব প্রকল্প কোনো কাজে আসবে না। শুধু অর্থের অপচয় হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ১০০ কোটি টাকা নয়, ৫০ কোটি টাকার মধ্যেই এ সমস্যার মিনিমাইজ অর্থাৎ ঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব। বজ্রপাত সমাধান করা যাবে না, কিন্তু পরিকল্পনা অনুসারে করলে মানুষের মৃত্যুঝুঁকি ও ক্ষয়ক্ষতি অবশ্যই অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন