![](https://bonikbarta.net/uploads/news_image/news_386042_1.jpg?t=1718895932)
মো. কামরুল ইসলাম চৌধুরী। দায়িত্ব পালন করছেন মার্কেন্টাইল ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও)। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ব্যাংকটির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন তিনি। ২৫ বছরে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের অর্জন, পরিকল্পনা, দেশের ব্যাংক খাতের গতিপ্রকৃতিসহ নানা বিষয়ে সম্প্রতি কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাছান আদনান
২৩ বছর ধরে আপনি মার্কেন্টাইল ব্যাংকে আছেন। এর মধ্যে পাঁচ বছর শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দীর্ঘ এ সময়ে আপনার কাছ থেকে মার্কেন্টাইল ব্যাংক কী পেয়েছে?
দেশের ব্যাংক খাতে আমার কর্মজীবন প্রায় ৪২ বছরের। এর মধ্যে ২৩ বছরই মার্কেন্টাইল ব্যাংকে কাটিয়েছি। সে হিসেবে ব্যাংকটি আমার জীবন ও পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কর্মজীবনের শুরু থেকে আমি পেশাদারত্ব, সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছি। এর প্রতিদানও পেয়েছি। মার্কেন্টাইল ব্যাংকে যোগদান করি ২০০১ সালে। শাখা ব্যবস্থাপক থেকে শুরু করে এ ব্যাংকের প্রতিটি ধাপে কাজ করেছি। ব্যাংকের পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের প্রত্যাশা পূরণে কখনো ব্যর্থ হইনি।
মার্কেন্টাইল ব্যাংকের বয়স এখন ২৫ বছর। এর মধ্যে ২৩ বছরই আমি এ ব্যাংকের সঙ্গে আছি। তার মানে ব্যাংকের প্রতিটি অর্জনের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা রয়েছে। দীর্ঘ এ সময়ে কখনই ব্যাংকটি ছেড়ে অন্য কোনো ব্যাংকে যাওয়ার চিন্তা করিনি। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে আমি এ ব্যাংকের এমডি ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। চলতি বছরের নভেম্বরে এ পদ থেকেই অবসরে যাব। এটি ব্যাংকার হিসেবে আমার জন্য গৌরবের।
শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের কোন দিকগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন?
মার্কেন্টাইল ব্যাংককে প্রযুক্তিগত দিক থেকে ঢেলে সাজানোর প্রতি সবচেয়ে বেশি মনোযোগী ছিলাম। বিশ্বের সর্বাধুনিক কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার দিয়ে আমরা গ্রাহকসেবা দিচ্ছি। এজেন্ট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং, ডিজিটাল ব্যাংকিংসহ আধুনিক সব সেবার সমন্বয়ে মার্কেন্টাইল ব্যাংককে সাজানো হয়েছে। আর অর্থায়নের ক্ষেত্রে আমরা ভালো গ্রাহক বাছাইয়ে সচেষ্ট ছিলাম। এ কারণে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এখন ঋণ আদায়ে আরো বেশি জোর দিচ্ছি। আমার আগের এমডি চেয়েছিলেন, মার্কেন্টাইল ব্যাংক যেন দেশের শীর্ষ পাঁচ ব্যাংকের মধ্যে জায়গা করে নেয়। আমি চাইব, আগামীতে এ ব্যাংক শীর্ষ তিনটি ব্যাংকের মধ্যে স্থান করে নিক।
মার্কেন্টাইল ব্যাংক আজ ২৫ বছর পূর্ণ করেছে। দীর্ঘ এ পথচলায় ব্যাংকটির অর্জন কী?
দেশের তৃতীয় প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে ১৯৯৯ সালের ২ জুন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের যাত্রা। সমসাময়িক সময়ে দেশে আরো অনেক ব্যাংকের জন্ম হয়েছে। গত দুই দশক দেশের সব ব্যাংকই তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে নিজেদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছে। এর মধ্যে মার্কেন্টাইল ব্যাংক যে অবস্থানে এসেছে সেটি গৌরবের। সাফল্য ও গর্বের সঙ্গেই ব্যাংকটি ২৫ বছর পার করতে পেরেছে। সমসাময়িক অন্য ব্যাংকগুলোর তুলনায় মার্কেন্টাইল ব্যাংকের অবস্থান অনেক সুদৃঢ়। বাংলাদেশের হাতেগোনা যে কয়টি ব্যাংকের আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং প্রতিষ্ঠান মুডি’সের রেটিং আছে, মার্কেন্টাইল ব্যাংক তার একটি। আদর্শ ব্যাংকের যে কয়টি বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার, মার্কেন্টাইলে তার সবক’টিই রয়েছে। মূলধনের পর্যাপ্ততা, মানসম্পন্ন সম্পদ, সুষম আয়, মজবুত তারল্য ও ঝুঁকি মোকাবেলার সক্ষমতার দিক থেকে আমাদের অবস্থান সুদৃঢ়। সেই সঙ্গে পরিচালনা পর্ষদের বিচক্ষণ নীতি ও সিদ্ধান্ত এবং ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরলস প্রচেষ্টায় মার্কেন্টাইল ব্যাংক আজকের অবস্থানে আসতে পেরেছে। এক্ষেত্রে ব্যাংকের সম্মানিত গ্রাহকদের আস্থা ও বিশ্বাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সম্প্রসারণ ও আর্থিক সূচকগুলো সম্পর্কে জানতে চাই।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মার্কেন্টাইল ব্যাংক প্রবৃদ্ধির ধারায় রয়েছে। গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত আমাদের কাছে গ্রাহকদের ৩২ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকার আমানত জমা ছিল। সেখান থেকে আমরা গ্রাহকদের ২৮ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছি। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) মুনাফা পেয়েছি ১৮৩ কোটি টাকা। একই সময়ে ৪ হাজার ৯০ কোটি টাকার রফতানি ও ৬ হাজার ৯৯ কোটি টাকার আমদানি বাণিজ্য হয়েছে। আমানত সংগ্রহ, ঋণ বিতরণ, আমদানি, রফতানিসহ ব্যাংকের সব খাতেই ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সেবা পৌঁছে দিতে আমরা উপশাখা ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে জোর দিচ্ছি। পাশাপাশি ব্যাংকের প্রযুক্তি ব্যবস্থাকে সর্বাধুনিক করে গড়ে তোলা হচ্ছে। গ্রাহক যাতে ব্যাংকে না এসে ঘরে বসে সব ধরনের সেবা উপভোগ করতে পারেন, সে উদ্যোগও বাস্তবায়নের পথে। এ মুহূর্তে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের শাখা রয়েছে ১৫২টি। ৪২টি উপশাখা ও দুই শতাধিক এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেটও চালু করা হয়েছে। প্রচলিত ধারার ব্যাংকিংয়ের পাশাপাশি মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ইসলামী ব্যাংকিংও বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এরই মধ্যে আমরা প্রায় ৫০টি শাখায় ইসলামিক ব্যাংকিং উইন্ডো চালু করেছি। আগামীতে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে আমাদের আরো বিস্তৃত পরিকল্পনা রয়েছে।
ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে কোন খাতকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন?
শুরু থেকে মার্কেন্টাইল ব্যাংক করপোরেট খাতকে গুরুত্ব দিয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছে। তবে গত কয়েক বছরে এ নীতির পরিবর্তন হয়েছে। ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে এখন আমরা কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি (সিএমএসএমই) খাতকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। কৃষি খাতেও ঋণ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ঋণ পোর্টফোলিওর প্রায় ২৫ শতাংশ এখন সিএসএমই। বাকি ৭৫ শতাংশ করপোরেট, কৃষিসহ অন্যান্য খাতের। কৃষিতে আমরা সাধ্যমতো অবদান রাখছি। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সিএসআর তহবিল থেকে আমরা দেশব্যাপী কৃষকদের মধ্যে সার, বীজ, ও কৃষি যন্ত্রপাতি বিতরণ করছি। একই সঙ্গে কৃষি গবেষণায়ও অনুদান দেয়া হচ্ছে। এছাড়া শাখাগুলোকে নারী উদ্যোক্তা, পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগ, নতুন উদ্যোক্তাদের ঋণদান এবং সেবা ও শিল্প খাতে ঋণ বিতরণে আলাদা লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেয়া হচ্ছে। আমাদের ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সিএমএসএমই খাতে অর্থায়নের বিষয়ে অত্যন্ত দায়িত্বশীল। লক্ষ্য অর্জনে পর্ষদ থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও নীতিসহায়তা দেয়া হচ্ছে।
এ মুহূর্তে ব্যাংকের কৌশলগত অগ্রাধিকার কী?
চলতি বছর বৈশ্বিক বিভিন্ন অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ থাকলেও আমরা ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ আশাবাদী। এ মুহূর্তে আমাদের কর্মকৌশলের মূলে থাকবে গ্রাহককেন্দ্রিকতা, পরিচালন দক্ষতা, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও ডিজিটাল রূপান্তর। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার জাতীয় লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ বৃদ্ধির মাধ্যমে স্মার্ট ব্যাংকিং অব্যাহত রাখা আমাদের অগ্রাধিকার হিসেবে থাকবে। তাছাড়া মানসম্পন্ন সম্পদ বৃদ্ধির মাধ্যমে ঝুঁকি ও মুনাফার মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে আমরা মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সুদৃঢ় অবস্থান আরো সুসংহত করার প্রয়াস চালিয়ে যাব। এ লক্ষ্যে গ্রাহক ঋণ, অগ্রিমের কেন্দ্রীকরণ পরিহার ও বৈচিত্র্যকরণ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। তারল্য ব্যবস্থাপনায় সুষম আমানত কাঠামো সুদৃঢ় করার চেষ্টা চালিয়ে যাব। এক্ষেত্রে রিটেইল আমানত বৃদ্ধির পাশাপাশি করপোরেট আমানতের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোয় জোর দেয়া হবে। ২০২৪ সালে ব্যাংক সন্তোষজনক প্রবৃদ্ধির জন্য নিট সুদ মার্জিনের স্থিতিশীলতা অর্জন, শেয়ারহোল্ডারদের সন্তোষজনক রিটার্ন প্রদানের পাশাপাশি মূলধন ভিত্তি বাড়ানো এবং মন্দ ঋণের পরিমাণ আরো কমিয়ে এনে সম্পদের গুণগত মান বজায় রাখার বিষয়ে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
সম্প্রতি মাস্টারকার্ডের সঙ্গে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের চুক্তি হয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা অতিশিগগিরই গ্রাহকদের মাস্টারকার্ডের সব সেবা দিতে পারব। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা এমবিএল রেইনবো অ্যাপের বাংলা কিউআর কোডের মাধ্যমে পেমেন্ট পরিষেবা চালু করা হয়েছে। এর মাধ্যমে গ্রাহক যেকোনো শপিং আউটলেটে নির্ভুল, দ্রুত ও সহজে লেনদেন করতে পারছেন।
মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাই।
বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মার্কেন্টাইল ব্যাংক শুরু থেকেই সতর্কতার সঙ্গে এগিয়েছে। এ কারণে আমাদের খেলাপি ঋণের হার কখনই বিপৎসীমার ওপরে ওঠেনি। বর্তমানেও এর হার ৫ শতাংশের নিচে রয়েছে। বিগত ২৫ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে আগামী ২৫ বছরে মার্কেন্টাইল ব্যাংককে একটি শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে। একই সঙ্গে বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সর্বাধুনিক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করে ব্যাংকে দক্ষ ও স্মার্ট মানবসম্পদ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
দেশের ব্যাংক খাতে তারল্য ও ডলার সংকট চলছে। এক্ষেত্রে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের অবস্থা কী?
মার্কেন্টাইল ব্যাংকের একটি পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে গত ২৫ বছরে। এ কারণে বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যেও আমাদের আমানত প্রবাহ বাড়ছে। তারল্যের ক্ষেত্রে দেশের অনেক ব্যাংক সংকটে থাকলেও মার্কেন্টাইলের কোনো সংকট নেই। আমাদের হাতে বিনিয়োগযোগ্য পর্যাপ্ত তারল্য রয়েছে। আবার ডলার পরিস্থিতির ক্ষেত্রেও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের অবস্থান বেশ ভালো। এলসি দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে আমাদের কোনো বদনাম নেই।
তার পরও ডলারের সংস্থান বাড়াতে মার্কেন্টাইল ব্যাংক অফশোর ব্যাংকিং ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট চালু করেছে। প্রবাসীরা এ অ্যাকাউন্টে ডলার, ইউরো, পাউন্ড জমা করে নির্দিষ্ট মেয়াদে আকর্ষণীয় মুনাফা অর্জন করতে পারেন। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের আরএফসিডি অ্যাকাউন্টে বৈদেশিক মুদ্রা জমা রাখলেও আকর্ষণীয় মুনাফাসহ বিভিন্ন সুবিধা দেয়া হচ্ছে। দেশের বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স উৎসাহিত করতে আমরা বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিয়েছি। তবে এক্ষেত্রে বিদেশে বাংলাদেশী দূতাবাসগুলোকেও দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে। প্রবাসীদের ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত করতে উদ্যোগ নেয়া দরকার।
এবার ব্যক্তিগত বিষয়, ৪২ বছরের কর্মজীবন শেষে অবসরে যাচ্ছেন। অবসরের এ সময়টায় কী করবেন?
নিজেকে সামাজিক বিভিন্ন কর্মসূচির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে চাই। বাকি জীবনে আর কোনো চাকরি করার ইচ্ছে নেই। সমাজ উন্নয়নে কাজ করতে হলে রাজনীতিরও দরকার হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে দেশের সমৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে চাই।