আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস

শ্রমিকের স্বার্থ ও কল্যাণের দিকটি অবহেলা করে সত্যিকার উন্নতি সম্ভব নয়

ছবি : বণিক বার্তা

বঞ্চনা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বিশ্বের শ্রমিকেরা প্রতি বছর আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস তথা মে দিবস পালন করেন। বাংলাদেশের শ্রম পরিবেশ অতীতের তুলনায় যতটা এগিয়েছে, তার পেছনেও রয়েছে শ্রমিকের ত্যাগ ও সংগ্রাম। কিন্তু যাদের নিয়ে এই দিবস, তারা এ সম্পর্কে কতটা অবগত? অনেক শ্রমিক জানেনই না এর ইতিহাস। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে এ দিবস পালনের এত বছর পরও শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য মজুরির দাবি এখনো উপেক্ষিত, এখনো তাদের বিরাট অংশ মৌলিক মানবাধিকার থেকেও বঞ্চিত। কায়িক শ্রম এবং মেধাশ্রম প্রদানকারী উভয়ই শ্রমিক। উভয় শ্রমের বিনিময়ে জীবন ধারণ যারা করেন তারাই শ্রমজীবী। এক্ষেত্রে উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত যেকোনো ব্যক্তি, সে কৃষি বা শিল্প যে ক্ষেত্রই হোক না কেন, তিনিই শ্রমিক। মানুষের শ্রম ও চেতনা এই দুই হলো সব সামাজিক সম্পদের উৎস। তাদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। 

বর্তমানে শ্রমজীবী সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব প্রকৃত শ্রমজীবী মানুষের হাতে নেই। ফলে কত শ্রমিক কীভাবে নিপীড়িত হচ্ছে, বঞ্চিত হচ্ছে তার সঠিক উপাত্ত বের করা কঠিন। মনে রাখতে হবে, বর্তমানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার বড় অংশ শ্রমজীবী মানুষ, যাদের বেশির ভাগ আজও অধিকারবঞ্চিত। শ্রমিকেরাই হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে খাদ্য-বস্ত্র উৎপাদন করেন, বাসস্থান নির্মাণ করেন। এই শ্রেণীর লোকদের কঠোর শারীরিক শ্রম ছাড়া নিজেদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করাই মুশকিল হয়ে পড়ে। পৃথিবীর অনেক দেশেই শ্রমিকদের অধিকার-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সনদ আজও পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। যেসব দেশে কার্যকর হয়েছে, সেসব দেশে প্রায়ই তা লঙ্ঘিত হতে দেখা যাচ্ছে।

মে দিবসের ধাক্কা বিশ্বের শ্রমিকদের সংহতি যেমন বাড়িয়েছে, তেমনি তাদের ওপর শোষণের বিরুদ্ধেও প্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে। মে দিবসের পথ ধরেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমিকদের অধিকার, বিশেষ করে ন্যূনতম মজুরি, কাজের পরিবেশ, সুযোগ-সুবিধা—এসব ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। কিন্তু গত দুই দশকে বিশ্বায়নের ফলে অর্থনৈতিক গতিশীলতা ও সমৃদ্ধি বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে বৈষম্য ও বঞ্চনা। বাংলাদেশের শ্রমিকদের, বিশেষ করে পোশাক শিল্প, জাহাজ শিল্প, ইমারত নির্মাণ শিল্পসহ অনানুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে কর্মরত লাখো শ্রমিক উপযুক্ত পারিশ্রমিক ও অন্যান্য অধিকার পান না। মৌলিক চাহিদা পূরণ করে মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজন জাতীয়ভাবে ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করা কিন্তু কাগজের সেই নিয়মের বাস্তবায়ন এখনো হয়নি। 

২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জনে কর্মক্ষেত্র নিরাপদ ও শ্রম আইন যথাযথ বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কারখানায় মনিটরিং ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ঘোষণার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ কাম্য। শ্রমিককে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আনা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা উন্নয়নে তাদের প্রশিক্ষণ এবং শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন করার সব বাধা দূর করতে পদক্ষেপ নিতে হবে।  

বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক কর্মরত। পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার ৫০০ টাকা। বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে শ্রমিকের এই ন্যূনতম মজুরি অত্যন্ত কম, যা দিয়ে শ্রমিককে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। শ্রমিকের জীবনযাপন ব্যয় ভালোভাবে পরিচালনা করতে ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো উচিত। প্রতিটি তৈরি পোশাক কারখানায় ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ হয় প্রতিদিন। ওভারটাইম করতে আগ্রহী না থাকলেও বাধ্য হয়ে তা করতে হয়। সেই ওভারটাইমের টাকাও ঠিকমতো পাওয়া যায় না বা দিতে নানান ছলচাতুরী করে মালিক পক্ষ। শুধু গার্মেন্ট শিল্প নয়, অধিকাংশ খাতে এমন পরিস্থিতি আমরা দেখতে পাই।

কর্মক্ষেত্রে নিহত, আহত বা ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের কর্মদিবসের আয় অনুযায়ী আর্থিক বা দৈহিক ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে। সামর্থ্যের বাইরে শ্রমিকদের ওপর কাজের বোঝা চাপানো যাবে না এবং তাদের সঙ্গে সৌজন্যমূলক সদাচরণ করতে হবে। অথচ বাস্তব জীবনে কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও স্থায়ী পঙ্গুত্ব যেন শ্রমিকের নিয়তি! অগ্নিকাণ্ড বা মর্মান্তিক কোনো দুর্ঘটনার পর নিহত শ্রমিকের পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণের নিশ্চয়তা যেন আরেক ট্র্যাজেডি! শ্রমিকের অধিকারসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কনভেনশন অনুসারে জাতীয়ভাবে শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মানদণ্ড নির্ধারণ করতে হবে। আর দুর্ঘটনার জন্য দায়ী মালিক পক্ষগুলোকে শ্রমিকদের এ ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করতে হবে। মালিক পক্ষ শ্রমিকদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেবে অথবা যথাসময় এমন মজুরি দেবে, যাতে তাদের প্রয়োজন মেটে। তাতে শ্রমিক ও মালিক পক্ষের দূরত্ব অনেকখানি কমে আসবে। 

দারিদ্র্যপীড়িত বাবা-মা অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করছেন। উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে শিশুদের ব্যবহার করছেন তারা। মাঝপথে প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের বড় অংশ বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ছে। যাদের ঠাঁই হচ্ছে শিশুশ্রমিক রূপে, নির্মাণকাজসহ বিভিন্ন অসংগঠিত শিল্পে। এর জন্য সামাজিক-অর্থনৈতিক কারণই দায়ী। বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সহায়ক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে শিশুরা। ভিক্ষাবৃত্তির কাজেও ব্যবহার করা হচ্ছে এদের। রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন স্থানে পথশিশুদের দেখা যাচ্ছে। শ্রম আইনে বলা রয়েছে, শিশুদের কয়েকটি নির্দিষ্ট পেশায় এবং কাজে নিয়োগ করা যাবে না। আইন লঙ্ঘন করে কোনো ব্যক্তি কোনো শিশুকে নিয়োগ করলে জেল ও জরিমানার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? আইনে ৬-১৪ বছর বয়সী শিশুদের বিনামূল্যে এবং আবশ্যিকভাবে স্কুলে পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। জাতীয় শিশুশ্রম নীতি অনুসারে শিশুশ্রমিকদের পুনর্বাসনে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। বিপজ্জনক পেশায় নিযুক্ত শিশুদের পুনর্বাসনে নজর দিয়ে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থায় যুক্ত করা এবং তাদের বিশেষ স্কুলে পুনর্বাসনের পরিকল্পনাও গৃহীত হয়, কিন্তু শুধু আইন প্রয়োগ করে সমাধান সম্ভব নয়। শিশুদের বিশেষ বিদ্যালয়ে পুনর্বাসন এবং তাদের পরিবারগুলোর আর্থিক অবস্থার উন্নতিও দরকার।

আন্তর্জাতিক মে দিবসের মূল যে দাবি—৮ ঘণ্টা কাজ করে বাঁচার মতো মজুরি, তা থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতের শ্রমিক মেহনতি মানুষ অনেক দূরে। বেশির ভাগ শিল্প-কারখানায় ন্যূনতম বাঁচার মতো মজুরি, ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবস, নিয়োগপত্র, সাপ্তাহিক ছুটি, কাজ ও কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা—এর সব বা অধিকাংশই অনুপস্থিত। শ্রমিক শ্রেণীর বর্তমান গঠনের কারণে সব খাতের শ্রমিকদের মধ্যে অস্থায়ী, দিনভিত্তিক, খণ্ডকালীন, অনানুষ্ঠানিক শ্রমিকের সংখ্যাই এখন বেশি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি অনেকটাই বদলেছে। ১৩১ বছর পেরিয়ে যাওয়া অতীতের সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা হয়তো আজ আর নেই। সারা বিশ্বে দৈনিক ৮ ঘণ্টার কাজ নির্ধারিত হয়েছে বহুদিন।  

আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের গুরুত্ব¡ ও তাৎপর্য অনুধাবন করে শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে প্রশাসন এবং মালিক শ্রেণীকে অনেক বেশি আন্তরিক হতে হবে। মে দিবস পৃথিবীতে বঞ্চনা ও শোষণ থেকে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির বার্তা নিয়ে এসেছে, তা তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে যখন শ্রমিক শ্রেণী তাদের মৌলিক অধিকার ফিরে পাবে। মালিকদের উপলব্ধি করতে হবে শ্রমিকদের ঠকিয়ে শিল্পের বিকাশ বা মুনাফা অর্জন করা যাবে না। শ্রমিকরা দেশের সম্পদ, তাদের কারণে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে। এ কারণে তাদের অবহেলার চোখে দেখার কোনো সুযোগ নেই। আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের কাজের অধিকার সুরক্ষা ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। শ্রমিকরাই সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ। শ্রমিকের স্বার্থ ও কল্যাণের দিকটি অবহেলা করে তাই কোনো সত্যিকার উন্নতি সম্ভব নয়। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন