দ্রোহের এমন রঙ দেখেছিল কেউ?

আহমেদ দীন রুমি

ছবি: সংগৃহীত

জিয়াউদ্দিন বারানী চতুর্দশ শতাব্দীর ঐতিহাসিক। ইতিহাসের আকরগ্রন্থ ‘তারিখে ফিরোজশাহী’ লিখে সুপরিচিত। বাংলার ইতিহাস বলতে গিয়ে তিনি এ অঞ্চলকে অভিহিত করেন বুলগাকপুর নামে। বুলগাকপুর অর্থ বিদ্রোহের নগরী। বারানীর দাবি ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে প্রমাণ করেছে বঙ্গীয় জনপদ। ছয়শ বছর পর এসেও নিজেদের সে পরিচয় থেকে সরে আসেনি বাংলার মানুষ। জুলাইজুড়ে অবিস্মরণীয় গণ-আন্দোলন ফের সে কথাই মনে করিয়ে দিয়েছে। ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানে পতন ঘটেছে দেড় দশকের স্বেচ্ছাচারী ও দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনের। ধাক্কা লেগেছে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি অংশে। ভেঙে পড়েছে অনেক কিছু। নাড়িয়ে দিয়েছে প্রচলিত ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-দর্শন, মূল্যবোধ, গতানুগতিক রাজনীতি ও সংস্কৃতিকে। সেই বিপুল আলোড়ন থেকে বাদ পড়েননি শিল্পীরাও। অবশ্য শিল্পীরা তো আর সমাজবহির্ভূত কিছু নন। সমাজের শান্তি ও যুদ্ধ, স্থিরতা ও অস্থিরতা প্রতিবিম্বিত হয় সেখানকার সংস্কৃতি, সাহিত্য আর শিল্পকলায়। সমাজের সবচেয়ে সংবেদনশীল মানুষই শিল্পচর্চায় ব্রতী হয়। নিজেদের সৃষ্টিশীল সত্তা নিয়ে একীভূত হয় জনপদের কান্না-হাসি, আন্দোলন ও সংগ্রামের স্রোতে। ফলে বিপ্লবের দিনগুলোয় শিল্প হয়ে ওঠে ভিন্ন ধারার দলিল।

জুলাই বিপ্লবের আগে ও পরে সমগ্র দেশ পরিণত হয়েছিল ক্যানভাসে। যে যেভাবে পেরেছে গ্রাফিতি ও স্ট্রিট আর্টের মধ্য দিয়ে করেছে বিদ্যমান অচলাবস্থার প্রতিবাদ। রাঙিয়ে তুলেছে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়াল। এক্ষেত্রে সবার আগে স্মরণ করা যায় সুবোধের কথা। উসকোখুসকো চুল। বহুদিনের না কামানো দাড়ি। আর হাতে বাক্সবন্দি সূর্য। অথচ কী তীব্র অভিব্যক্তি তার চোখে-মুখে! নতুন প্রজন্ম তাকে চেনে সুবোধ নামে। কয়েক বছর ধরেই রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় দেখা মিলেছে তার। কেবল দেয়ালে অঙ্কিত দেহভঙ্গির জন্য নয়, পাশে লিখে রাখা বিভিন্ন বক্তব্য তাকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। সে সুবোধকে বিপ্লবের জেরে দেখা গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায়। মেট্রো স্টেশনের দেয়ালে আঁকা সুবোধ এবার প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ। তার লাথির আঘাতে দূরে ছিটকে পড়ছে একটা চেয়ার। মাথায় তার রাজমুকুট। যেন অত্যাচারীর সিংহাসন সরিয়ে সুবোধ এবার নিজের কাঁধে তুলে নিল দায়িত্ব। জনতার বিজয়ের পরের দিন অর্থাৎ ৬ আগস্ট অঙ্কিত এ চিত্রকর্ম বাংলাদেশের নতুন আগামীকেই বরণ করে নেয়া।

আন্দোলনজুড়ে সরব ছিলেন দেবাশীষ চক্রবর্তী, সুলতান ইসতিয়াক ও আদি রায়ের মতো অনেকে। তাদের লেখা স্লোগান ও চিত্রকর্মগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই কেবল ছড়িয়ে পড়েনি, সেগুলোকে অনুকরণ করে তরুণ-তরুণীরা রাঙিয়ে তুলেছেন তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দেয়াল। এজন্য বিভিন্ন স্কুলের দেয়ালে দেখা যায় সে চিত্রকর্ম ও স্লোগান। সেটা ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের দেয়াল হোক কিংবা খাগড়াছড়ি স্কুলের। বাংলার ইতিহাসে দেয়াল অংকনের এমন জোয়ার সম্ভবত আর কখনো দেখা যায়নি। ঢাকা শহরে এমন কোনো রাস্তা নেই, যেখানে স্লোগান কিংবা চিত্রকর্ম পাওয়া যাবে না। অপেশাদার কিংবা আনাড়ি হাতের অঙ্কনগুলো আন্দোলনকে আরো বেগবান করেছে। ৫ আগস্টের আগে যারা দেয়ালে গ্রাফিতি করেছেন, তাদের অধিকাংশই হয়েছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। পুলিশি টহল কিংবা সরকারি দলের সশস্ত্র ও মারমুখী অবস্থানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গেরিলার মতো চুপি চুপি এঁকে এসেছেন দেয়ালে দেয়ালে। অধিকাংশই রাতের আঁধারে। তাড়াহুড়ায় লেখা আঁকাবাঁকা লাইন কিংবা দুয়েকটা বানান ভুল বিপ্লবকে যেন আরো জীবন্ত করে তুলেছে।

চিত্রকর্মের বিষয়বস্তু নানা রকম। মওলানা ভাসানীর আবক্ষ প্রতিকৃতি থেকে শুরু করে আন্দোলনে হারিয়ে যাওয়া শহীদদের উপস্থিতি সরব। শিল্পীরা তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের মানচিত্র, লাল-সবুজের পতাকা ও আন্দোলনের নানা মুহূর্তকে। উঠে এসেছে নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ও সম্প্রীতির চেতনা। রংপুরে আবু সাইদ কিংবা ঢাকায় শহীদ হওয়া মুগ্ধকেও চিনে নেয়া যায় চিত্রকর্ম থেকে। চেনা যায় সেসব মুখও, যারা বিভিন্ন সময় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন পুলিশের হাতে। 

আন্দোলনকে ঘিরে অনেকগুলো বিষয় ছিল ব্যতিক্রম, তার একটা ‘৩৬ জুলাই’। রক্তাক্ত জুলাইকে গ্রাফিতির মাধ্যমে দেয়ালে ফুটিয়ে তুলেছেন শিক্ষার্থীরা। যেহেতু জুলাইজুড়ে আন্দোলন চলেছে। আন্দোলন ক্রমে রূপ নেয় এক দফায়। ছাত্ররাও প্রতিশ্রুতি নেয়, এক দফা পূরণ তথা শেখ হাসিনার পদত্যাগ করার আগ পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। ফলে জুলাইও তার গতানুগতিক ৩১ দিন থেকে প্রলম্বিত হতে থাকে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন। দিনটিকে ৩৬ জুলাই হিসেবে চিহ্নিত করেন আন্দোলনকারীরা। দেশের বিভিন্ন জায়গায় সেটাও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ৩২ জুলাই, ৩৩ জুলাই, ৩৪ জুলাই হিসেবে। এছাড়া ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিতে তারা স্মরণ করেছেন দেয়ালে। 

বিপ্লবের নতুন একটা আবিষ্কার সম্ভবত ক্যালিগ্রাফি। অনেকটা আড়ালে থাকা এ শিল্পকর্ম বাংলাদেশে কতটা নান্দনিক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে, তা হয়তো আগে কেউ সেভাবে ঠাহর করতেই পারেনি। ঢাকার কেরানীগঞ্জ, সিলেটে ও চট্টগ্রামের দেয়ালে অভাবনীয় ক্যালিগ্রাফি এঁকেছেন ছাত্ররা। পাশাপাশি বাংলা ও আরবি ক্যালিগ্রাফি ঠাঁই পেয়েছে। সত্যি বলতে আগামীর বাংলাদেশে শিল্পকলায় ক্যালিগ্রাফির সমূহ সম্ভাবনা দৃশ্যমান। সামনে আসার সুযোগ তৈরি হয়েছে সংশ্লিষ্ট শিল্পীদের। আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সমান্তরালে অংশগ্রহণ করেছে মাদ্রাসার ছাত্ররাও। শহীদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। আন্দোলন শেষেও তারা অংশ নিয়েছে দেয়ালকে রাঙিয়ে তোলার মিশনে। আন্দোলনে একই কাতারে দাঁড়িয়েছে পাহাড় ও সমতল, শহর ও গ্রাম, নারী ও পুরুষ। মিশেছে সব শ্রেণী, পেশা ও ধর্মের মানুষ। এ গভীর ঐক্য শিগগিরই যেন বৈষম্যহীন বাংলাদেশ তৈরি করতে যাচ্ছে, দেয়ালে অনভ্যস্ত হাতের ছড়িয়ে থাকা রঙগুলো সেটাই ইঙ্গিত করে। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন